বিচারকদের প্রতিবাদে এক সাংবাদিকের খটকা
১৩ ডিসেম্বর ২০২০চট্টগ্রামে বিচারকদের মানববন্ধন ও সমাবেশের খবরটি দেখা যাক৷ সমাবেশের একটি ছবিও প্রকাশ করেছে বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম৷ ছবিতে বিচারকেরা যে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়েছেন সেটিতে লেখা, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ভাস্কর্য ভাংচুর এবং ভাস্কর্য বিরোধী প্রচারণায় উসকানির প্রতিবাদে প্রতিরোধ এবং প্রতিবাদ সমাবেশ৷’
‘বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম জেলা কমিটি’র ব্যানারে এই মানববন্ধন করেন বিচারকেরা৷
জানলাম কেবল চট্টগ্রাম নয়, দেশের বিভিন্ন জেলায় বিচারকেরা সমাবেশ করেছেন, রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছেন৷
এই ঘটনার দুটি ব্যাখ্যা দেয়া যায়৷ একটি আইনী দৃষ্টিকোণ অন্যটি নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে৷ কেউ কেউ বলেন, আইনে যত না ধারা থাকে তার চেয়ে বেশি থাকে ফাঁক৷ প্রশ্ন করেছিলাম একজন অভিজ্ঞ ব্যারিস্টারকে, ‘‘এমন কাজ কি বিচারকেরা পারেন?’’ তার উত্তর ছিল, ‘‘তাদের কারো চাকরি থাকার কথা না৷’’
কয়েকজন বন্ধুস্থানীয় জুডিশিয়াল বিচারকের সঙ্গে কথা বললাম৷ তাদের অনেকেই বিচারকদের প্রতিবাদের মূল ভাষ্যের সঙ্গে একমত হলেও প্রকাশ্যে রাস্তায় নামার বিষয়ে খুব বিব্রত বোধ করছেন৷
আরো স্পষ্ট ব্যাখ্যা খুঁজতে সাবেক একজন বিচারক এবং দীর্ঘদিন আইন বিষয়ক সাংবাদিকতা করা এক বড় ভাইয়ের সঙ্গেও কথা হলো৷ দীর্ঘ আলোচনায় এটা মনে হলো, আইন বা সংবিধান অনুসারে বিচারকদের এমন প্রতিবাদ জানাতে হয়তো সরাসরি কোনো বাধা নেই৷
বঙ্গবন্ধু জাতির জনক বলে তিনি নির্দিষ্ট কোনো দলের না, সমগ্র জাতির৷ এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারকদের প্রতিবাদ সমাবেশটি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থনে হচ্ছে না, সেটা বলা যায়৷
আগেই বলেছি, আইনের আলোচনায় আমি যাচ্ছি না৷ আসি এথিক্স বা নৈতিকতার আলোচনায়৷
রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি বিষয়ে যারা জানেন তারা জানেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভ- আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ৷ আইন বিভাগ বা জাতীয় সংসদ সংবিধান অনুসারে আইন প্রণয়ন করবে, নির্বাহী বিভাগ তা বাস্তবায়ন করবে এবং বিচার বিভাগ আইন ও তার প্রয়োগ ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা তা নজরদারি করবে৷
ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা বজায় রাখতে এই তিনটি বিভাগের স্বাধীনতা জরুরি৷ তা না হলে সরকার ইচ্ছামতো আইন প্রণয়ন করে, সেটি নির্বাহী বিভাগ দিয়ে বাস্তবায়ন করিয়ে বিচার বিভাগ দিয়ে তার বৈধতাও আদায় করিয়ে নিতে পারে৷ এটা রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য চরম বিপর্যয়ের কারণ৷
আমার খটকা প্রধানত দুটো বিষয়ে৷ প্রথমত, চট্টগ্রামের বিচারকদের ব্যানারে কেবল বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নয়, অন্য যেকোনো ভাস্কর্যবিরোধী প্রচারণার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে৷ স্পষ্ট করে বলি, কেবল বঙ্গবন্ধুর নয়, যেকোনো ভাস্কর্যবিরোধী প্রচারণার প্রতিবাদ করেছেন বিচারকেরা৷
দ্বিতীয়ত, বিচারকেরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন৷
শুরুতে প্রথম খটকার বিষয়টিতে আসি৷ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে যেকোনো বিষয়ে স্বাধীন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের সবার রয়েছে৷ ফলে সাংবাদিক, বিচারক বা পুলিশ, ব্যক্তি হিসেবে তিনি একটি দল বা যেকোনো মত সমর্থন করতেই পারেন৷ কিন্তু সেটি যখন তার পেশাগত পরিচয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি করে, তাকে কেউ কেউ নৈতিকতা বিবর্জিত বলেই মনে করেন৷
রাষ্ট্রের আইন পুলিশ কার্যকর করবে৷ কিন্তু সেই আইন ঠিক কিনা, বা পুলিশ সেটা অপব্যবহার করছে কিনা তা জনগণ চ্যালেঞ্জ করতে পারে বিচারকদের কাছেই৷
আমি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পক্ষে৷ ফলে ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ভাস্কর্য থাকবেই', এটাই আমার মত৷ কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে আমার নৈতিকতা বলে- যে ভাস্কর্য থাকবে না মনে করে, তার মতও গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা উচিত৷
দুটো বিষয় একেবারে আলাদা৷ একটি ভাস্কর্য থাকা উচিত না মনে করা, অন্যটি ভাস্কর্য ভাঙা বা ভাঙতে উৎসাহিত করা৷ দ্বিতীয়টা অপরাধ, কিন্তু প্রথমটা নাগরিকের অধিকার নয় কি?
সরকার দেশে ভাস্কর্য থাকবে মনে করলে সেটার পক্ষে প্রচারণা চালাবে, জনমত গড়ে তুলবে৷ কেউ যদি ভাস্কর্য ভাঙার অপরাধ করে থাকে পুলিশ অপরাধীদের আটক করবে, মামলা হবে, বিচারকেরা সাজা দেবেন৷ কিন্তু কেউ ভাস্কর্য না থাকার পক্ষে মত দিতে চাইলে, তার মত প্রকাশ কি কেউ আটকাতে পারে?
আসি দ্বিতীয় খটকার বিষয়ে৷ আমাদের আইন বা সংবিধান কী বলে? কেউ যদি মনে করেন বাংলাদেশে ভাস্কর্য থাকায় তার সমস্যা হচ্ছে, তিনি কি সেটা আদালতের কাছে আর্জি জানাতে পারবেন? আমি মনে করি পারবেন৷ তার আপত্তি আমলে নেওয়া বা না নেওয়া আদালতের এখতিয়ার৷ কিন্তু কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তাকে এ বিষয়ে আদালতে আবেদন করা থেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না৷
কিন্তু এক্ষেত্রে কী হলো? বিচারকেরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভাস্কর্যবিরোধী প্রচারণার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন৷ এতে করে কি ‘ভাস্কর্য চাই না’ আবেদন নিয়ে বিচারকদের কাছে যাওয়ার আর কোনো পথ থাকলো?
বিডিনিউজ বলছে চট্টগ্রামের সমাবেশে মহানগর দায়রা জজ আশফাকুর রহমান তার বক্তব্যে বলেছেন, ‘‘যখন খুব ছোট ছিলাম, দেখতাম এলাকায় যারা দুষ্টু ছিল, বাবা-মা বলত মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য মাদ্রাসায় দাও৷ এই করতে করতে মাদ্রাসা লাইনটা আমরা শেষ করে ফেলেছি৷ আমরা আমাদের মেধাবী সন্তানদের এখানে দিই না৷ একারণে এখন যাদের পাচ্ছি তারা ক্ষতি ছাড়া কোনো উপকার করছে না৷’’
বিচারক কি বলে দিলেন যে মাদ্রাসা আমাদের ক্ষতি করছে? দেশের আইনের সাথে বিচারকের কথা কি সাংঘর্ষিক হলো?
বিচারকেরা যা বলেছেন, তার অনেক কথার সঙ্গে আমি একমত৷ কিন্তু তারা যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় বলেছেন, তার সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না৷