পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার ভাস্কর্যগাঁথা
১১ ডিসেম্বর ২০২০পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া৷ প্রায় ২৬ কোটি জনগণের ৯০ শতাংশই মুসলিম৷ প্রায় ১৭ হাজার দ্বীপ নিয়ে এই রাষ্ট্রের ইতিহাস, মানুষ ও সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময়৷ মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়াকে যুক্ত করেছে আফগানিস্তান৷ সেখানকার ৯৯.৫% মানুষ মুসলিম৷ দেশটিতে কট্টরপন্থি তালেবানের অস্তিত্ব সেখানকার জীবনযাত্রা অনেক বদলে দিয়েছে৷ হামলা, বোমাবাজি, মৃত্যু এসব সেখানকার নিত্যদিনের খবর৷ দেশটিতে শান্তি স্থাপনের একটি প্রক্রিয়া চলমান৷ পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ৷ এটি একটি ইসলামিক রাষ্ট্র৷ ২১ কোটি জনসংখ্যার ৯৫-৯৮ ভাগ মুসলিম৷
এই তিনটি দেশেই গণতন্ত্র চালু আছে৷ সেখানে ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দল আছে৷ কোথাও তাদের প্রভাব বেশি, কোথাও কম৷ ভাস্কর্য ইস্যুতে এসব দেশেও বিতর্ক হয়েছে ও হচ্ছে৷ কিন্তু কেমন সে বিতর্ক? বাংলাদেশে এখন যা চলছে, তার সঙ্গে এর মিল আছে? ডয়চে ভেলেকে এসব কথা বলেছেন এই তিন দেশের তিন সাংবাদিক৷
‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ফায়দা লোটাই উদ্দেশ্য’
রিজকি নুগ্রাহা, ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ায় অনেক ভাস্কর্য আছে৷ সেগুলোকে প্রধানত দু'টি ভাগে ভাগ করা যায়৷ একভাগে রয়েছে জাতীয় বীরদের বা গৌরব প্রকাশ করে এমন ভাস্কর্য, এবং অন্যভাগে রয়েছে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রকাশ করে এমন৷ ধর্মীয় স্থাপনা ও মূর্তি তো আছেই৷ প্রাগৈতিহাসিক আমলের পেগ্যান ধর্মের মূর্তিও আছে৷
তবে এখানে ভাস্কর্য বা মূর্তির বিরোধিতাও আছে৷ কট্টর ইসলামপন্থিরা এর বিরোধিতা করে থাকেন৷ সাধারণভাবে দুই শ্রেণিকে এরা শত্রু বলে জ্ঞান করেন৷ এক, সরকার বা সরকারি দল, যারা তাদের কট্টরপন্থার সঙ্গে সুর মেলান না, এবং দুই, সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী৷
এই দুই পক্ষ সবসময়ই একে অপরের বিপক্ষে মাঠে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়তা দেখান৷ যেমন, বোর্নিও দ্বীপের কথাই ধরুন৷ সেখানে কট্টরপন্থি মুসলিমরা মূর্তি ও ভাস্কর্যবিরোধী চাপ তৈরি করলেও সাংস্কৃতিক ও নৃগোষ্ঠীদের প্রতিবাদের মুখে সুবিধা করতে পারেননি৷
কিন্তু আচেহ ও পশ্চিম সুমাত্রায় কট্টরপন্থিদের প্রভাব অনেক৷ সেখানকার মানুষও অনেক রক্ষণশীল৷ তাই সেখানে তাদের রাজনৈতিক সুবিধা তৈরি করতে ভাস্কর্য বা মূর্তি বিরোধিতার গুটি খেলতে হয় না৷ তারপরও সেসব এলাকায় বৌদ্ধমন্দির আছে৷ আর মিলিটারিরা প্রাণিমূর্তি তৈরি করে থাকেন৷ বিশেষ করে বাঘের মূর্তি, যাতে তাদের গৌরব প্রকাশ করতে পারেন৷
তো বিরোধ মূলত ধর্মীয় ন্যারেটিভের সঙ্গে জাতীয়তাবাদী ও সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভের৷ উদারপন্থি মুসলিমরা ভাস্কর্যকে দেখেন দেশের গৌরব, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হিসেবে৷ এখন এই দুই পক্ষের মধ্যে অবশ্যই উদারপন্থিদের পাল্লা ভারি৷ এদের অনেকেই বর্তমান জোকো উইদোদো সরকারের উদারপন্থি মনোভাবের সমর্থক৷ এরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সক্রিয়৷ কট্টরপন্থিদের চাপিয়ে দিতে চাওয়া মনোভাবের সমালোচনা সেখানেই বেশি করেন এরা৷
কিন্তু এই দুই পক্ষের বাইরে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ মুসলিমরা৷ এদের দুই পক্ষের যে যাই বোঝান, তারা তখন তাই বোঝেন৷ ধর্মের যুক্তিও মানেন৷ আবার জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্যও সংস্কৃতিকেও ভালবাসেন৷ তাই এদের কাছে কে পৌঁছাচ্ছেন, সেটি গুরুত্বপূর্ণ৷
আরেকটি দিক হলো, যখনই স্থানীয় বা জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচন ঘনিয়ে আসে, বা তখনই কট্টরপন্থি মুসলিমরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন এসব ইস্যু নিয়ে৷ এদের রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবহার করে৷ আর এরাও আর্থিক ও রাজনৈতিক ফায়দা লুটে৷ তাই ধর্মের কথা বলে এই যে বিরোধিতা, তা আসলে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে, আর কিছু নয়৷
‘বুদ্ধমূর্তি ভেঙে ভুল স্বীকার করেছেন তালেবান নেতা’
খালিদ হাকিমি, আফগানিস্তান
আফগানিস্তানের অল্প কিছু শিখ বাদে বাকি প্রায় সবাই মুসলিম৷ এই দেশটির সংস্কৃতি ও সাহিত্য দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে কিছু যেমন মিল আছে, তেমনি পারস্য ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গেও আছে৷ কিন্তু একটি বিষয় স্বতন্ত্র৷ তা হল এখানে ভাস্কর্য বা মূর্তিকে দেখা হয় বিদেশি ধর্মের প্রতীক হিসেবে৷ ইসলাম এখানে আসার পর থেকেই এই ব্যবস্থা৷
একটা সময় সিল্ক রুটের অংশ ছিল আফগানিস্তান৷ ইরান ও ইউরোপে পণ্য যেত৷ সে সময় অনেক বৌদ্ধ মূর্তি স্থাপিত হয়েছিল৷ সবচেয়ে বড় মূর্তিটি সেন্ট্রাল আফগানিস্তানের বামিয়ান উপত্যকায় পাহাড়ের গা কেঁটে তৈরি করা হয়েছিল৷ প্রায় ১৮০ ফুট উঁচু এই বুদ্ধমূর্তিটি তৈরি করা হয় ৬১৮ খ্রিস্টাব্দে৷ এর পূর্ব দিকে আরেকটি বুদ্ধমূর্তি তৈরি করা হয় ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে৷ এর উচ্চতা ছিল ১২৫ ফুট৷ তৎকালীন গান্ধারা অঞ্চলের এই শিল্পকর্মগুলো ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় জায়গা করে নেয়৷
এই শিল্পকর্মগুলোকে ২০০১ সালে মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের তালেবান সরকার মূর্তি বলে ঘোষণা করে৷এরপর এগুলোকে ধ্বংস করা হয়৷ কিন্তু তাদের এই কর্মকাণ্ড স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচিত হয়৷ এমনকি পরবর্তীতে তালেবান নেতা মোতাসিম আঘা জান এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেন যে, তারা কাজটি ভুল করেছেন৷ জোশের বশে তখন কাজটি করা হয়েছিল৷
আগেই বলা হয়েছে, আফগানিস্তানের সঙ্গে মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার সাযুজ্য আছে৷ কিন্তু ইরান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তানসহ অনেক দেশে ঐতিহাসিক ভাস্কর্য দেখা গেলেও তা আফগানিস্তানে দেখাই যায় না বলতে গেলে৷ তবে এখানে সংখ্যালঘু শিখ সম্প্রদায় বাস করেন৷ বর্তমান সরকার তাদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল৷ তাদের স্থানীয় ও প্রাদেশিক সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নেয়া হয়েছে৷ কাবুলে তাদের গুরুদুয়ারাও আছে৷ আফগানিস্তান পুরো বিশ্বকে দেখাতে চাইছে যে, তারা সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র্যে বিশ্বাসী৷ একটা ইতিবাচক ইমেজ গড়তে চায় এই সরকার৷
‘সাধারণ জনগণের কাছে ভাস্কর্য ও মূর্তির পার্থক্য পরিষ্কার’
আতিফ তৌকির, পাকিস্তান
পাকিস্তানে অনেক ভাস্কর্য আছে৷ ভাস্কর্য নিয়ে বিতর্কও আছে৷ তবে এর মানে এই নয় যে, তারা ভাস্কর্য দেখলেই হামলে পড়ছেন৷ আমরা সিরিয়া কিংবা ইরাকে যেমনটি দেখেছি, তেমনটি এখানে নেই৷ তবে তালেবান যে অংশে সক্রিয় সেখানে কিছু হামলা হয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তানে সাধারণ জনগণের মাঝে ভাস্কর্য নিয়ে সমস্যা নেই৷
আফগানিস্তানের বামিয়ানে যখন বুদ্ধমূর্তি ধ্বংস করা হয়, তখন পুরো পাকিস্তানে এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়৷ তখন এর সমালোচনা হয় সব পর্যায় থেকে৷ বলা হয়, বামিয়ানের মতো ঘটনা যেন পাকিস্তানে না ঘটে৷ কেউ যেন ইতিহাস ধ্বংস না করে৷
এমনকি লাহোরে সম্প্রতি শিখ শাসক রনজিত সিংয়ের একটি ভাস্কর্য তৈরি করা হয়৷ এটি তৈরির সময়ও বিতর্ক হয়েছে৷ বলা হয়েছে, পাকিস্তান ইসলামিক রাষ্ট্র৷ এখানে কেন এই ‘মূর্তি?’ কিন্তু তা ধোপে টেকেনি৷ কারণ জাতীয়তাবোধের জায়গা থেকে মানুষ এগিয়ে এসেছেন৷ বলেছেন, এই ভাস্কর্য পাঞ্জাবের গৌরবের প্রতীক, প্রতিরোধের প্রতীক৷
ভাস্কর্য বনাম মূর্তি এই বিতর্ক পাকিস্তানেও আছে৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ কোনটিই ধ্বংসের পক্ষে নন৷ সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের নিন্দা যেমন করেন তারা৷ তেমনি ভাস্কর্যের সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক বা বিরোধ নেই, তাও তারা মনে করেন৷ রনজিত সিংয়ের ভাস্কর্য তার প্রমাণ৷
কট্টরপন্থি মুসলিমরা বরাবরই ছবি, ভাস্কর্য এসবের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন৷ কিন্তু তাদের এই মতবাদ মোটেই কোন জনপ্রিয় ধারণা নয় পাকিস্তানে৷ এখানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়েছে৷ তাদের মন্দিরে ভাঙচুর করা হয়েছে৷ তাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে৷ কিন্তু ভাস্কর্য ‘হারাম’ এই যুক্তিতে কেউ সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিক ভাস্কর্য ভাঙতে যায়নি কেউ৷
করাচি, লাহোরসহ বড় বড় শহরগুলোতে নানা ধরনের ভাস্কর্য আছে৷ হয়ত মানুষের ভাস্কর্যের সংখ্যা তুলনামূলক হিসেবে খুব বেশি নয়৷ এখানে মানুষের ভাস্কর্য তৈরির যে ‘ট্রেন্ড’ বা ‘ফ্যাশন’ তা হয়ত নেই৷ কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এটি এখানে চলে না৷ তাই ভাস্কর্যের বিষয়টি পাকিস্তানের জনগণের কাছে একেবারেই পরিষ্কার৷