পিটিয়ে আলোচিত শাসক দলের এমপিরা
১৭ জুলাই ২০২২সর্বশেষ আলোচনায় এসেছেন কুমিল্লা-৪ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরাজি মোহাম্মদ ফখরুল৷ তিনি দেবিদ্বার উপজেলা চেয়ারম্যান আবুল কালোম আজাদকে কিল ঘুসি মেরে রক্তাক্ত করে হাসপাতালে পাঠিয়েছেন৷ খোদ সংসদ ভবনের ভিতরেই এই ঘটনা ঘটে৷ শনিবার বিকেলে জাতীয় সংসদের এলডি হলে দেবিদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির বৈঠকে তৃণমূলে কমিটি গঠন এই কিল ঘুসির ঘটনা ঘটে৷ উপজেলা চেয়ারম্যানও কিল-ঘুসির পাল্টা জবাব দিয়েছেন বলে জানা যায়৷
গত ৭ জুলাই রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার রাজাবাড়ি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে তার ব্যক্তিগত চেম্বারে ডেকে নিয়ে মারপিট করেন রাজশাহী-১ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী৷ ওই অধ্যক্ষকে তিনি ১৫ মিনিট ধরে কিল ঘুসি ছাড়াও হকি স্টিক দিয়ে পেটান৷ অধ্যক্ষের অপরাধ তিনি সংসদ সদস্যের কথা মত একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত ছাড়া তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে রাজি হননি৷
এভাবে মারপিট করে সরকার দলীয় আরো যেসব সংসদ সদস্য আলোচনায় আছেন তারা হলেন শওকত হাচানুর রহমান রিমন, আনোয়ারুল আজীম, কাজী মনিরুল ইসলাম মনু,আবদুর রহমান বদি প্রমুখ৷
গত ১৯ মে ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার সরকারি মাহতাব উদ্দিন কলেজে ঢুকে দুই সহকারী অধ্যাপককে মারধর করেন ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার৷ সংসদ সদস্যের এক প্রিয় শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার কাগজপত্র চেয়ে না পেয়ে তিনি এই কাজ করেন বলে অভিযোগ৷
বরগুণা-২ আসনের এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমনের বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ রয়েছে৷ তিনি গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর পাথরঘাটা এলাকায় এক সভামঞ্চে উঠিয়ে নজরুল ইসলাম নামে এক মাছ ব্যবসায়ীকেমারধর করেন৷ নজরুল ইসলামের মাইক্রোবাস সংসদ সদস্যের গাড়ি বহরকে রাস্তায় জায়গা ছাড়তে দিতে করায় তিনি এভাবে প্রকাশ্যে শাস্তির ব্যবস্থা করেন৷ গত ২১ মে ফোরকান নামে এক চায়ের দোকানদারকেও মারধোর করেন তিনি৷
ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য কাজী মনিরুল ইসলাম মনু গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর দলিল লেখক আনোয়ার হোসেনকে তার অফিসে দলবল নিয়ে গিয়ে মারধর করেন৷
কক্সবাজারের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি সংসদ সদস্য থাকার সময়েও এমন করেছেন৷ গত ২২ এপ্রিল তিনি টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় তার দলবল নিয়ে প্রতিপক্ষের নেতা-কর্মীদের মারধর করেন৷ তার পছন্দমতো কমিটি না হওয়ায় তিনিওই হামলা চালান৷ এরা সবাই শাসক দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য৷ মারপিটের ঘটনার পর তাদের বিরুদ্ধে কোনো পুলিশি বা দলীয় ব্যবস্থা নেয়ার কোনো খবর পাওয়া যায়নি৷
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোরসেদ বলেন, ‘‘ সংসদ সদস্যদের কাজ সংবিধানে স্পষ্ট করা আছে৷ তাদের কাজ দেশের আইন প্রণয়ন করা৷ কিন্তু এখন দেখছি তারা মারপিট করছেন৷ আসলে যেমন সংসদ সদস্য তেমন তারা আচরণ করছেন৷ দল থেকেও তাদেরই চাওয়া হয়েছে৷ নয়তো তারা মনোনয়ন পেয়েছেন কীভাবে! তিনি মনে করেন, তাদের আচরণ দেখেই এই সংসদের কী ভাবমূর্তি আছে তা বোঝা যায়৷ কেউ সংসদের ভাবমূর্তি নিয়ে ভাবলে তারা সংসদ সদস্য হতে পারতেন না৷ আর দলও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত৷ কিন্তু ব্যবস্থা তো নেয়না৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সাহস পায়না৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, ‘‘সংসদ সদস্যরা এখন বেসামাল হয়ে উঠেছেন৷ তারা সব জায়গায় আধিপত্য বিস্তার করতে চান৷আর যেখানেই তারা বাধা পান সেখানেই তারা আগ্রাসী হয়ে উঠছেন৷ এমনকি তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও দখল করতে চাইছেন৷ সেখানে তাদের মধু আছে৷ তাই তারা শিক্ষকদেরও ছাড়ছেন না৷ তার কথায়, ‘‘এটা দল এবং সরকারের দেখা উচিত৷ তা না হলে তো শৃঙ্খলা থাকবে না৷
তবে আওয়ামী লীগের সাংগাঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, ‘‘যে সব সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তা অবশ্যই তদন্ত করে দেখা হবে৷ যদি অভিযোগ প্রমাণ হয় তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ তারা কিন্তু দলের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদে নাই৷ তারা যা করছেন তা আওয়ামী লীগের নীতি ও আদর্শবিরোধী৷ তাদের কাজ নিন্দনীয়৷ শেখ হাসিনা তাদের ক্ষমা করবেন না৷ এমনও হতে পারে আগামী নির্বাচনে তারা আর মনোনয়ন পাবেন না৷''
এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা তো দেখা যাচ্ছেনা-এই কথার জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এটা একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেয়া হয়, তাই সময় লাগে৷ এর আগে তখনকার সংসদ সদস্য লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে৷ গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে৷
এদিকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংসদ সদস্যেদের হাতে অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের মার খাওয়ার ঘটনার বিচারের ভার জাতীয় সংসদের স্পিকারের হাতে দিয়েছেন৷ তিনি রবিবার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো উত্থাপন হওয়ায় খুব বিব্রতকর৷ আর সেগুলো যদি সত্য হয়, সত্য প্রমাণিত হয় সেগুলো আরো বিব্রতকর৷ তবে যদি কোনো সংসদ সদস্য এ ধরনের কাজে যুক্ত থাকেন সেক্ষেত্রে সেই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আমরা মন্ত্রণালয় হিসেবে সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না৷ যেটি আমরা করতে পারি, তা হল, আমরা স্পিকারের শরণাপন্ন হতে পারি এবং তার মাধ্যমে তার কাছে অভিযোগ উত্থাপন করে আমরা এটির একটি সমাধান চাইতে পারি৷''
এ বিষয়ে চেষ্টা করেও জাতীয় সংসদের স্পিকারে বক্তব্য পাওয়া যায়নি৷