1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এমপি যখন শিক্ষক নির্যাতনকারী

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৪ জুলাই ২০২২

বাংলাদেশে শিক্ষক নির্যাতনে এমপিরাও পিছিয়ে নেই। আর ম্যানেজিং কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, প্রভাবশালী চক্র, ছাত্র কেউই শিক্ষক পেটানো, লাঞ্ছনা, হামলায় পিছিয়ে নেই।

https://p.dw.com/p/4E8Ml
Zwei Frauen ohrfeigen sich
ছবি: picture-alliance/E.Topcu

এমনকি নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও প্রভাবশালীদের কারণে নির্যাতনের শিকার শিক্ষক তা প্রকাশ করতে পারেন না। উল্টো নির্যাতনের ঘটনা গোপন করতে বাধ্য হন। যেমন ঘটেছে রাজশাহীতে।

রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী গত ৭ জুলাই রাতে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সেলিম রেজাকে তার ব্যক্তিগত চেম্বারে ডেকে নিয়ে মারপিট করেন। তখন সেখানে গোদাগাড়ী উপজেলার বিভিন্ন কলেজের আরও কয়েকজন অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ উপস্থিত ছিলেন। মারপিটের কারণে তিনি জ্ঞানও হারান।  কিন্তু ভয়ে ওই অধ্যক্ষ তখন তা প্রকাশ করেননি। পরে দুইদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হলে বৃহস্পতিবার রাজশাহীর সংসদ সদস্য ওই অধ্যক্ষকে সঙ্গে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে সংসদ সদস্য নিজে মারপিটের ঘটনা অস্বীকার করেন। আর অধ্যক্ষ সেলিম রেজা বলেন," সংসদ সদস্যের উপস্থিতিতে তাদের অধ্যক্ষদের মধ্যে কথা কটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। সংসদ সদস্য তাকে মারেননি।”

প্রকৃত ঘটনা কী?

দৈনিক যুগান্তরের রাজশাহী প্রতিনিধি তানজিমুল হক বলেন," আমি ওই অধ্যক্ষের সাথে নিজে দেখা করে কথা বলেছি। তখন তিনি আমাকে সংসদ সদস্য যে তাকে মারপিট করেছেন তা জানিয়েছেন। তাকে হকি স্টিক দিয়েও পিটানো হয়। ১৫ মিনিট ধরে মারপিটের পর সেখানে উপস্থিত অন্য কলেজের কয়েকজন অধ্যক্ষের একজন তাকে উদ্ধার করে সংসদ সদস্যের চেম্বারের বাইরে পাঠিয়ে দেন। তারপর তিনি  একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। ঘটনার পর অধ্যক্ষ  ভয়ে ও লজ্জায় কয়েকদিন মোবাইল ফোন বন্ধ রাখেন এবং বাসা থেকে বের হননি।”

তানজিমুল হক

এখন অধ্যক্ষ ঘটনা অস্বীকার কেন করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন,"এই এমপি সাহেবের অতীতেও শিক্ষক পিটানোর রেকর্ড আছে। শিক্ষকদের চড়-থাপ্পড় মারা তার স্বভাব। এর আগেও তিনি আরেকজন অধ্যক্ষকে ও প্রাইমারি স্কুলের এক শিক্ষককে মারপিট করেন। একজন উপজেলা প্রকৌশলীকে মারপিট করেন। এসবের কোনো বিচার হয়নি। ফলে ভয়ে এই অধ্যক্ষ এখন ঘটনা গোপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।”

তিনি বলেন,"আজকে(বৃহস্পতিবার) তিনি সংবাদ সম্মেলনের সময় তার পিঠে, কনুইয়ে ও কোমরে আঘাতের চিহ্নগুলো ঢেকে রাখেন। তবে তার চোখের নিচে কালো দাগ স্পষ্ট ছিলো।” 

গাজী টেলিভিশনের রাজশাহীর সাংবাদিক রাশেদ ইবনে ওবায়েদ বলেন,"তিনি আগে সংসদ সদস্যের হাতে নির্যাতনের কথা আমাদের জানালেও এখন ভয়ে তা অস্বীকার করছেন বলে ধারণা করি। কারণ এমপি সাহেব অনেক প্রভাবশালী। প্রিন্সিপাল নিয়োগসহ আরো অনেক বিষয় তার নিয়ন্ত্রণে।”

বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনের পরপরই অধ্যক্ষ তার মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেন। আর সংসদ ওমর ফারুক চৌধুরী টেলিফোনে বলেন,"সাংবাদিকদের কাজ হলো সম্মানিত মানুষের সম্মানহানি করা। অধ্যক্ষরা প্রায়ই আমার চেম্বারে গল্পগুজব করতে আসেন। তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়েছে। আমি ছিলাম সেখানে। ঘটনার দিনই সেটা মিটমাট হয়ে যায়।”

তিনি এর আগেও শিক্ষকদের মারপিটের অভিযোগ অস্বীকার করেন।

তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান মনে করেন," এমপি ওই অধ্যক্ষকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে আবারো তার ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন।”

এটাই প্রথম নয়

এমপিদের হাতে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগে গত মে মাসে ঝিনাইদহ-৪(কালীগঞ্জ) আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার তার দলবল নিয়ে কালীগঞ্জ সরকারি মাহতাব উদ্দিন কলেজে ঢুকে অধ্যাপক সাজ্জাদ হোসেনকে মারধর করেন। তিনি তার প্রিয় এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার কাগজপত্রও গায়েব করতে না পেরে ওই শিক্ষককে পিটান।

২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জের পিয়ার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে প্রকাশ্যে কান ধরে উঠবস করানো হয় প্রভাবশালী সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের উপস্থিতিতে।

অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু

শিক্ষকদের সবাই মারে

গত ২৫ জুন সাভারের আশুলিয়ার ইয়ারপুর ইউনিয়নে হাজি ইউনুস আলী স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিটিয়ে আহত করে ওই স্কুলেরই দশম শ্রেণির ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু। পরে তিনি মারা যান। জিতুর পরিবারের সদস্যরাই ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির হর্তাকর্তা। 

১৮ জুন নড়াইলে মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো হয় পুলিশের সামনে।

২২ মার্চ মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ধর্ম অবমাননার ভুয়া অভিযোগ তুলে তাকে হেনস্তা করা হয়। কিন্তু তাকে নিরাপত্তা না দিয়ে উল্টো পুলিশ ও প্রশাসন তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠায়।

গত বছরের ৭ অক্টোবর বগুড়ার নন্দীগ্রামে তেতুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাজ্জাদুল ইসলাম দুদুকে মারপিট করে তিনটি দাঁত ফেলে দেন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শামিম হোসের লিটন।

২০১৮ সালে বরিশালের বাকেরগঞ্জের কাঁঠালিয়া ইসলামিয়া দারুচ্ছুন্নাত দাখিল মাদ্রাসার সুপারের মাথায় মল ঢেলে দেয়া হয়। তার অপরাধ তিনি মাদ্রাসার জমি দখলে প্রভাবশালী মহলকে বাধা দিয়েছিলেন। ওই ঘটনার ভিডিও  প্রকাশ হওয়ার আগে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

কেন তারা শিক্ষকদের ওপর চড়াও হন

দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন স্থানীয় এমপি, রাজনৈতিক নেতা এবং প্রভাশালীরা নিয়ন্ত্রণ করেন। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের দৌরাত্ম্য চরমে। প্রাইমারি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে থাকতে হলে কমপক্ষে স্নাতক পাস হতে হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের গভর্নিং বডিতে এধরনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সরকার সংসদ সদস্যদের গভর্নিং বডিতে না থাকার আদেশ দিলেও বাস্তবে তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। এমপিরা আসলে এখন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বলতে গেলে দখল করে রেখেছেন। তারা যা চান তাই হয়। এর বাইরে গেলে শিক্ষক, অধ্যাপক, অধ্যক্ষ মারপিটের শিকার হন। চাকরি চলে যায়। আর  এমপিদের সঙ্গে আছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বাশিস) সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি বলেন," এমপি সাহেব, রাজনৈতিক নেতা, ম্যানেজিং কমিটি, প্রভাবশালী ব্যক্তি সবাই এখন শিক্ষকদের মারধর করেন। তাদের ইচ্ছামত নিয়োগ, উন্নয়নের অর্থ নিজেদের পকেটে না পেলেই তারা চড়াও হন।  আমার জানামতে এখন বিভিন্ন আদালতে শিক্ষকদের  কমপক্ষে ১০ হাজার মামলা আছে চাকরি ফিরে পাওয়ার জন্য। ম্যানেজিং কমিটির কথামত কাজ না করায় তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।” আর এইসব কারণে শিক্ষকরা আত্মহত্যাও করেন বলে জানান তিনি।

তার অভিযোগ,"শিক্ষক নির্যাতনে বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোনো ব্যবস্থা নেয় না। মামলা করেও কোনো ফল হয়না। আর এমপিরা যদি শিক্ষকদের মারধোর করেন তাহলে বাকিরা উৎসাহিত হন।”

এজন্য সমিতির পক্ষ থেকে শিক্ষক সুরক্ষা আইনের দাবী করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ শাহজাহান আলম সাজু বলেন, এ পর্যন্ত কতজন শিক্ষক নির্যাতন ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন সেই হিসাব তাদের কাছে নেই। তবে গত ছয় মাসে ১০-১২ জনের বেশি শিক্ষক মারধর ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। একজনকে হত্যা করা হয়েছে। তার কথা,"অনেক চড়-থাপ্পড়ের ঘটনা আমরা জানিও না। তারা ভয়ে প্রকাশ করেন না। বাস্তবে অনেক ঘটনা ঘটে।”

তার কথা,"শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দলীকরণ হয়ে গেছে। এখানে এমপিসহ দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রভাব। ফলে তারা তাদের ইচ্ছে মত সব কিছু চালাতে চায়। না হলেই শিক্ষকদের ওপর নির্যাতন নেমে আসে। তাদের দুর্নীতির দায়ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের বহন করতে হয়।”

তিনি বলেন," এমপি সাহেবরা যখন শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলেন তখন আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে  যাই। তারা আইন প্রণয়ন করবেন। কিন্তু তারাই যদি আইন ভঙ্গ করে আইন হাতে তুলে নেন বাকি সবাই তো তাদের মতই করবেন। তাই নীরিহ শিক্ষকদের এখন যিনি পারছেন তিনিই নির্যাতন করছেন।”

পাশে দাঁড়াবে জাতীয়  বিশ্ববিদ্যালয়

রাজশাহীতে অধ্যক্ষকে নির্যাতনের ঘটনায় জাতীয়  বিশ্ববিদ্যালয়  একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটি প্রতিবেদন দেয়ার পর ব্যবস্থা নেবে বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।  বিশ্ববিদ্যালয়ের  উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান বলেন," সম্প্রতি আমরা তিনটি ঘটনায় দেখেছি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্ষমতার বাড়াবাড়ি শুরু হয়েছে। শিক্ষকদের ক্ষমতায়ন না হওয়ায় তাদের নির্যাতন করা হচ্ছে। আমরা এর আগে একজন সাবেক এমপির বাড়াবাড়ি ঘটনা থামিয়েছি। রাজশাহীতে এমপি সাহেব কিন্তু পুলিশের একজন কনেস্টবলকে মারতে পারতেন না। কিন্তু অধ্যক্ষকে মেরেছেন। কারণ তার তথাকথিত সামাজিক ক্ষমতা নেই। এই এমপি সাহেব আজকে(বৃহস্পতিবার) আবার  ওই অধ্যক্ষকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। এটাও ক্ষমতার বাড়াবাড়ি। এটাও আমরা দেখব।”

তিনি বলেন,"জাতীয়  বিশ্ববিদ্যালয়  শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াবে। এভাবে চলতে পারেনা। রাজশাহীর সংসদ সদস্যকে জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা করব।”