তাঁতী লীগ সদস্যের মামলায় বিপর্যস্ত এক মাদ্রাসা শিক্ষক
২৬ জুলাই ২০২২এখন একটার পর একটা ওয়ারেন্টে পুলিশ খুঁজে বেড়াচ্ছে চাঁদপুরের হাজিগঞ্জের এক মাদ্রাসার শিক্ষক ইকবাল হোসেনকে৷ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে মরিয়া ইকবাল হোসেনকে সোমবার দেখা যায় সুপ্রিম কোর্টের মাজার গেটের পাশে৷ প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিষয়টিতে তার হস্তক্ষেপের দাবি জানাতে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ সেখানে অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি৷
তার বিরুদ্ধে কেন এত মামলা? ইকবাল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘২০১৬ সালে চাঁদপুরের শাহরাস্তি থানার সাংহাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিচালনা পর্যদে অভিভাবক প্রতিনিধি হিসেবে মনোনয়ন ফর্ম সংগ্রহ করি আমি এবং আমার স্ত্রী৷ তখন ওই স্কুলের পরিচালনা পর্যদের সভাপতি ছিলেন আজিজুল হক পাটওয়ারী৷ তার অনুমতি ছাড়া মনোনয়ন ফরম কেনায় তিনি ক্ষুব্ধ হন৷ আমাদের দেখে নেওয়ার হুমকি দেন৷ তখন উনি আমাদের বিরুদ্ধে টাকা পাওয়ার একটি মামলা করেন৷ পরে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আলোচনা করে সমোঝোতা করে দেন৷ ২০১৭ সালে তিনি আর কোনো মামলা করেননি৷ এরপর ২০১৮ সাল থেকে আজিজুল হক পাটওয়ারী, তার ছেলে এবং অজ্ঞাত লোকজন দিয়ে একটার পর একটা মামলা দিচ্ছে৷ বিভিন্ন দফতরে ১২৫টি অভিযোগ দিয়েছে৷''
ইকবাল হোসেন হাজীগঞ্জের কাঁকৈরতলা ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসার গণিতের শিক্ষক৷ তার বাড়ি চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে৷ তার দাবি, তার বিরুদ্ধে শুধু মামলা করে এবং করিয়েই ক্ষান্ত হননি আজিজুল হক পাটওয়ারী৷ ওই মাদ্রাসা থেকে তার চাকরি খাওয়ার চেষ্টাও করেছেন৷ দিয়েছেন লিখিত অভিযোগ৷ তবে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সেসব অভিযোগের কোনো সত্যতা পাইনি৷
কাঁকৈরতলা ইসলামিয়া আলিমমাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা তাফাজ্জেল হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইকবাল হোসেন একজন ভালো শিক্ষক৷আজিজুল হক পাটওয়ারী নামের এক ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে আমার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিল, কিন্তু আমরা তদন্ত করে কোনো সত্যতা পাইনি৷ ইকবাল হোসেনকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য তিনি আমাকে চাপও দিয়েছেন৷ কিন্তু কোনো অভিযোগ ছাড়া কেন আমরা তাকে বাদ দেবো? তিনি অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি৷ ছাত্ররাও তাকে পছন্দ করে৷ ভালো মানের শিক্ষক তিনি৷ আসলে আমার মনে হয়েছে, আজিজুল পাটওয়ারী সাহেব কোনো কারণে ইকবাল হোসেন সাহেবের পেছনে লেগেছেন৷ কিন্তু কী কারণে সেটা আমি জানি না৷''
সোমবার এসব মামলা থেকে মুক্তির দাবিতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মাজার গেটের পাশে ব্যানার নিয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন ইকবাল হোসেন৷ সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ঘণ্টাখানেক অবস্থান করেন তিনি৷ পরে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেয় পুলিশ৷ ব্যানারে মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা থেকে মুক্তি এবং আজিজুল হক পাটওয়ারী নামের এক ব্যক্তি ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ কামনার কথা লেখা ছিল৷ এ সময় ওই শিক্ষকের সঙ্গে স্ত্রী, ছেলে ও সাড়ে চার বছর বয়সি কন্যাশিশুকেও ব্যানার নিয়ে দাঁড়াতে দেখা যায়৷ তার অন্য দুই মেয়ের একজন চট্টগ্রাম পলিটেকনিকের ছাত্রী এবং আরেক মেয়ে স্নাতকের ছাত্রী৷ পরীক্ষার কারণে তারা আসতে পারেনি বলে জানান ইকবাল হোসেন৷
কেন একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এত মামলা?তদন্তে আসলে পুলিশ কী পেয়েছে? এসব প্রশ্নের জবাবে চাঁদপুরের শাহরাস্তি থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আব্দুল মান্নান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর একটি মামলাও আমাদের থানায় হয়নি৷ একটি মামলার তদন্তও আমরা করছি না৷ আমাদের কাছে বিভিন্ন মামলার ওয়ারেন্ট আসে৷ সেগুলো তামিল করাই আমাদের দায়িত্ব৷ এখন ইকবাল হোসেনের বিরুদ্ধে কেন মামলা হচ্ছে, কারা করছে, এসবের কিছুই আমরা বলতে পারবো না৷ কিছুদিন পরপর আমাদের কাছে ওয়ারেন্ট আসে, আমরা তখন গ্রেপ্তারের চেষ্টা করি৷ কিন্তু উনাকে ঠিকানা অনুযায়ী পাওয়া যায় না, সেটা আমরা জানিয়ে দেই৷''
ইকবাল হোসেন জানান, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা জজ কোর্টে তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো করা হয়৷ আজিজুল হক পাটওয়ারী নিজে ১৩টি, তার ছেলে ৩টি এবং বাকিগুলো ওই ব্যক্তির চক্রের লোকেরা দায়ের করেছেন৷ জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে তিনটি মামলা করা হয়৷ এছাড়া ১২৫টি অভিযোগও করেছেন৷ ২১টির মধ্যে ৩টি মামলার আসামি না হয়েও ৩৫ দিন জেল খাটতে হয়েছে ইকবাল হোসেনকে৷ জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে ওই সিন্ডিকেট বিভিন্ন জেলা ও থানায় মামলাগুলো করে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাদীর জাতীয় পরিচয়পত্র অস্পষ্ট, আবার কোনোটিতে সংখ্যা কম, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলায় উল্লিখিত ঠিকানায় বাদীকে পাওয়া যায় না৷
গত দেড় দেড় বছর ধরে বাড়িতে যেতে পারছেন না বলেও দাবি করেন ইকবাল হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘তিন মেয়ে ও এক ছেলের কেউই বাবাকে পাচ্ছে না৷ ঠিকমতো চাকরি করতে পারছি না৷ জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে৷'' তিনি আরো বলেন, ‘‘২১টির মধ্যে ১৬টি মামলা খারিজ হয়ে গেছে৷ অপর পাঁচটিতে জামিন হয়েছে৷ অপহরণ, প্রতারণা, টাকা নেওয়া, এমন সব অভিযোগে এসব মামলা করা হয়েছে৷ আমার বিরুদ্ধে আসলে ঠিক কতগুলো মামলা আছে, জানি না৷''
জানা গেছে, আজিজুল হক পাটওয়ারী শুধু ইকবাল হোসেন নয় আরো অনেকের বিরুদ্ধেই এমন মামলা করেছেন৷ হাজীগঞ্জের স্থানীয় একজন সাংবাদিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "হঠাৎ করেই আওয়ামী লীগের হয়ে বেশ টাকা পয়সার মালিক হয়েছেন তিনি (আজিজুল হক পাটওয়ারী)৷ তিনি এখন কেন্দ্রীয় তাঁতী লীগের এক নম্বর সদস্য৷ একটি পত্রিকা ও একটি অনলাইনও আছে তার৷ চাকরি দেওয়ার নাম করে অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন, কিন্তু চাকরি হয়নি, টাকাও ফেরত দেয়নি- এমন অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে৷ এখন শাহরাস্তিতে বেশ প্রভাবশালী তিনি৷''
২০২০ সালের ২৬ জুলাই আজিজুল হক পাটওয়ারীর বিরুদ্ধে থানায় একটি জিডি করেন চাঁদপুরের তৎকালীন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফজাল হোসেন৷ আজিজুল হকের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগের তদন্তের দায়িত্ব ছিল আফজাল হোসেনের৷ তদন্তে সহযোগিতা না করে উল্টো হুমকি দেওয়ার অভিযোগে তখন ওই জিডিটি করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার৷
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আজিজুল হক পাটওয়ারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইকবাল হোসেনের কাছে আমি ১২ লাখ টাকা পাই৷ সেই টাকা তিনি দিচ্ছেন না৷ এই কারণে আমি একটি মামলা করেছি, সেই মামলায় তার কারাদণ্ড হয়েছে৷ উল্টো ইকবাল হোসেন ও তার ভাইয়েরা আমাদের বিরুদ্ধে ৮টি মামলা করেছে৷ কোনো মামলাতেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি৷'' ইকবাল হোসেনকে ১২ লাখ টাকা ধার দেয়ার কারণ চাইলে আজিজুল হক পাটওয়ারী বলেন, "প্রতিবেশীকে দিতেই তো পারি৷ আসলে আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি, আর সে জামায়াত-শিবিরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে৷''
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফজাল হোসেন কেন তার বিরুদ্ধে জিডি করেছিলেন জানতে চাইলে আজিজুল হক বলেন, ‘‘তিনি মাদকাসক্ত ছিলেন৷ আমি একজন নাগরিক হিসেবে পুলিশ সুপারের কাছে তার ডোপ টেস্টের আবেদন করেছিলাম৷ তিনি আসলে ইকবালের পক্ষ নিয়েছিলেন৷ এ কারণে আমার উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন৷'' আর চাকরি দেওয়ার নাম করে অনেকের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘এসব অভিযোগ সত্য না৷ স্থানীয় সাংবাদিকরা অনেক কথাই বলেন, কিন্তু কোনো প্রমাণ দিতে পারবেন না৷''
আজিজুল হক পাটওয়ারী সম্পর্কে শাহরাস্তি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান মিন্টুর কাছ থেকেও প্রকৃত তথ্য জানার চেষ্টা করেছে ডয়চে ভেলে৷ তিনি বলেছেন, “আজিজুল হক পাটওয়ারীকে একজন প্রতারক ও মামলাবাজ হিসেবেই এলাকার মানুষ জানে। মামলা করাই তার পেশা। এলাকার বহু মানুষের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করেছেন। এমনকি আমি যখন উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই, তখন তিনি এই নির্বাচন বাতিল, গেজেট বাতিলসহ এই নির্বাচন নিয়েই তিনটি মামলা করেছিলেন। আমি আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি আমার বিরুদ্ধে যদি তিনটি মামলা করে, তাহলে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী বুঝতেই পারছেন। আমি আওয়ামী লীগের একটা দায়িত্বে থাকায় আমার বিরুদ্ধে মামলা করে সুবিধা করতে পারেননি। আসলে এলাকায় তার কোনো অবস্থান নেই। ঢাকায় বসেই তিনি এসব করেন। কিভাবে তাঁতী লীগে তিনি ঢুকলেন সেটাও আমরা জানি না। দলীয় ফোরামে বিষয়টা আমরা জানিয়েছি। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এই লোক আগে জাতীয় পার্টি করতে, তারপর বিএনপি এবং এখন আবার আওয়ামী লীগে এসেছেন। ২০০৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধন করেছিলেন। সেই খবর তখন সব পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। এই বিষয়টিও আমরা দলীয় ঊর্ধ্বতনদের অবহিত করেছি। এখন তিনি এলাকা এলে পুলিশ তার বাড়িতে যায়। কেন যায়, সেটা জানি না। তবে এটা বলতে পারি, তার মামলার কারণে বহু নিরীহ মানুষ এখন নিঃস্ব। এর একটা প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন।’’