শিশু সংশোধনকেন্দ্র ধুঁকছে, কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বাড়ছে
২০ অক্টোবর ২০২৩শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (সংশোধন কেন্দ্র) একটি শিশুর একদিনের খাবারের জন্য বরাদ্দ ১০০ টাকা। সকাল ও বিকালের নাস্তা এবং দুপুর ও রাতের খাবার এই চার বেলার খাবার দিতে হয় এই টাকায়। কোনো চিকিৎসক নেই। প্রাথমিক চিদিৎসারও ব্যবস্থা নেই। পাঁচটি ট্রেডে প্রশিক্ষণের জন্য একজন প্রশিক্ষক কাগজে-কলমে থাকলেও তার দায়িত্ব অন্য জায়গায়।
এই হলো আদালতের মাধ্যমে শাস্তি পাওয়া বা মামলায় জড়ানো শিশু-কিশোরদের সংশোধন কেন্দ্রের অবস্থা।
বাংলাদেশে এরকম শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র আছে মোট তিনটি। সামাজ সেবা অধিদপ্তর এগুলো পরিচালনার দায়িত্বে আছে। কেন্দ্রগুলোর মধ্যে দুইটি গাজীপুরে। গাজীপুরের টঙ্গীর কেন্দ্রটি ছেলেদের জন্য। আর মেয়েদের কেন্দ্র গাজীপুরের কোনাবাড়িতে। আরেকটি কেন্দ্র আছে যশোরের পুলের হাওটে৷ সেটা ছেলেদের জন্য। টঙ্গীর কেন্দ্রটিতে ৩০০ কিশোরের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও এই প্রতিবেদন লেখার দিন (বৃহস্পতিবার) সেখানে মোট ৭৫০ জন ছিল। কখনো কখনো সংখ্যাটা এক হাজারও ছাড়িয়ে যায়। আর যশোরের কেন্দ্রটিতে ধারণক্ষমতা ১৫০ জন, কিন্তু আছে ৪০০। কোনাবাড়িতে মেয়েদের কেন্দ্রের ধারণক্ষমতা ১৫০, তবে সেখানে ধারণক্ষমতার চেয়ে কম আছে।
শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে শিশুদের কেস ওয়ার্ক, গাইডেন্স, কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে মানসিকতার উন্নয়ন, ডাইভারশন, ভরণপোষন, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন করে কর্মক্ষম ও উৎপাদনশীল নাগরিক হিসেবে সমাজে পুনর্বাসিত করা এবং আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তাদের সেখানে অনকেটা বয়স্ক আসামির মতোই রাখা হয়। ফলে ওই কেন্দ্রগুলোতে প্রতি বছরই কোনো না কোনো অঘটন ঘটে। এরমধ্যে সংঘর্ষ, কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, পালিয়ে যাওয়া, কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়ার মতো ঘটনাও আছে । ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তিন কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কেন্দ্রের লোকজনের নির্যাতনে আহত হয় আরো ১২ কিশোর। কেন্দ্রের অনিয়ম আর দুর্নীতির প্রতিবাদ করলে তাদের ওই নির্মম পরিণতি হয় বলে জানা যায়। ওই একই কেন্দ্রে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক কিশোর আত্মহত্যা করে। ২০২১ সালের জুন মাসে ওই কেন্দ্রে দুই গ্রুপ কিশোরের মারমারিতে কয়েকজন আহত হয়।
২০২১ সালে টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে শিহাব মিয়া নামে এক কিশোর খুন হয়। সেই হত্যাকাণ্ড কিশোরদের মধ্যে মারামারির কারণে বলে তখন কর্তৃপক্ষ দাবি করে। চলতি বছরের ২৪ আগস্ট রফিকুল ইসলাম নামে এক কিশোর মারা যায়। অভিযোগ ওঠে তার সুচিকিৎসা হয়নি৷ ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে রিয়াজুদ্দিন নামে এক ভারতীয় কিশোরের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। এই কেন্দ্র থেকে কিশোরদের অনেক বার পালিয়ে যাওয়ার রেকর্ড আছে।
২০২২ সালের নভেম্বরে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক প্রতিবেদনে এই শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা এবং ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শিশু ও কিশোর থাকার কথা তুলে ধরা হয়। তারা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র আরো বাড়ানো এবং অনিয়ম দূর করার কথা বলেন। কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বৃহস্পতিবার বলেন, "ওইসব কেন্দ্রের যা অবস্থা তাতে শিশু-কিশোররা ভালো মানুষ হওয়ার পরিবর্তে আরো খারাপ হয়। তারা মানবেতর জীবন-যাপন করে সেখানে। আমরা আরো ছয়টি নতুন কেন্দ্র করার সুপারিশ করেছি। সরকার এর মধ্যে দুইটি নতুন কেন্দ্র নির্মাণ করছে।”
তিনি বলেন, " কিশোর অপরাধ কমাতে হলে ওই শিশুদের ভালো জীবনের দিকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আর উন্নয়ন কেন্দ্রের বাইরেও রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের দায়িত্ব আছে।”
যশোর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক ( সহকারি পরিচালক) মো. মঞ্জুরুল হাছান বলেন, "ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি শিশু-কিশোর রাখাই হলো আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ফলে আমাদের সীমিত জনবল দিয়ে তাদের দেখভাল করা কঠিন হয়ে পড়ে। কেন্দ্রে কোনো চিকিৎসক নেই। আর প্রতিজনের জন্য দিনে যে ১০০ টাকা খাবারের বরাদ্দ দেয়া হয়, তার মধ্যে জ্বালানি খরচও আছে। নাস্তা ও খাবারসহ একজনের জন্য প্রতিবেলায় ২৫ টাকারও কম বরাদ্দ আছে।”
তিনি বলেন, "এই কেন্দ্রে অনুমোদিত জনবল আছে ৪৯ জন। কিন্তু ওইসব পদের বিপরীতে লোক আছে ২৪ জন। পর্যাপ্ত জনবল আর থাকার পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলে এই শিশু- কিশোরদের ম্যানেজ করা কঠিন কোনো কাজ নয়।”
টঙ্গী কেন্দ্রের একজন কর্মকর্তা দাবি করেন, "এই কেন্দ্রটি তৈরি হয়েছিল ২০০ জনের জন্য। পরে সেটা ৩০০ জনের জন্য অনুমোদন করা হয়। তারপরও এখন আছে ৭৫০ জন। কখনো কখনো এক হাজারেরও বেশি হয়।”
তিনি বলেন, "এখানে অনুমোদিত জনবল ৫৭ জনের মধ্যে আছে ৩৭ জন। কিন্তু তারও একটি অংশ এখানো নিয়োগ দেখিয়ে কাজ করানো হয় অন্য জায়গায়। কম্পিউটারসহ পাঁচটি ট্রেডে প্রশিক্ষণের জন্য প্রশিক্ষক আছেন একজন। তাকেও আবার অন্য কাজে লাগানো হয়।”
তার কথা, " আমার অভিজ্ঞাতায় দেখেছি এখানে যে শিশু -কিশোররা আসে তারা সঠিক পথে যেতে চায়। তারা অনুতপ্ত। কিন্তু তাদের যে সাপোর্ট দেয়া দরকার সেটা এখানে নাই। তাদের মানসিক এবং শারীরিক বিকাশের ব্যবস্থা নেই।”
অধিদপ্তরের সূত্র জানিয়েছে, কিশোরগঞ্জ ও চট্টগ্রামে ছেলেদের দুইটি নতুন শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র নির্মাণ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এই দুইটির কাজ শেষ হলে পুরোনো কেন্দ্রের ওপর চাপ কিছুটা কমবে। আর বাজেট বাড়ানোর প্রক্রিয়াও চলছে।
বাংলাদেশের এই শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র তিনটি মূলত শিশু-কিশোর সংশোধন কেন্দ্র। ২০১৩ সালের শিশু আইনে এগুলো পরিচালিত হওয়ার কথা। কেন্দ্রগুলোতে নানা অপরাধে অভিযুক্ত এবং দন্ডিত শিশুদের রাখা হয়। মূল উদ্দেশ্য হলো তাদের সংশোধনের মাধ্যমে সামাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, " বাংলাদেশ দন্ডবিধি ১৮৬০-এ বলা হয়েছে ৯ বছর পর্যন্ত কোনো শিশুর অপরাধ কোনোভাবেই অপরাধ হিসেবে গণ্য হবেনা, যদি সেটা হত্যাকান্ডও হয়। কারণ ওই বয়সে শিশুদের কোনটা অপরাধ আর কোনটা অপরাধ নয় সেই জ্ঞানই হয় না। এরপর থেকে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের শাস্তির মাত্রা কম হবে। তাদের বিচার হবে শিশু আদালতে।”
তিনি বলেন, " কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে শিশু আদালত আলাদাভাবে নেই। জেলাগুলোতে অন্য আদালতের বিচারকদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়। আর থানা থেকে পুলিশ শিশুদের ইচ্ছেমতো বয়স বাড়িয়ে দিয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক দেখানো হয়। ফলে শিশুরা শুরুতেই হয়রানির শিকার হয়। শিশু আইনের সুবিধা পায় না। পরে আদালতে আবেদন করে বয়স নির্ধারণ করতে পারলে সেই সুবিধা পায়। তার আগেই তাদের ক্ষতি হয়ে যায়। প্রাপ্ত বয়স্কদের সাথে কারাগারে রাখা হয়। সাধারণ আদালতে প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো হাজির করা হয়।”
সমাজ সেবা অধিদপ্তরে প্রবেশন অফিসার রয়েছেন। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে থানার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে কোনো শিশু আটক হলে তাদের বয়স নির্ধারণে সহায়তা করা। কিন্তু তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেন না। তাদের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে নিয়মিত গিয়ে দেখার কথা, তা তারা করেন না। আবার জেলায় জেলায় কমিটি থাকলেও তারা কোনো কাজ করে না।”
ইশরাত হাসান বলেন, " শিশু আইনের সুবিধা যারা পায়, তাদের যখন শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয় তারা আরো খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে। সংশোধন হওয়ার পরিবর্তে তাদের অপরাধী হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় পরিবেশের কারণে। ”
বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে। আর কিশোর গ্যাং নিয়ে খোদ পুলিশ বাহিনিতেই এখন উদ্বেগ আছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২২৫টি। ওই সদস্যরা আলাদা আলাদাভাবে ১১০টি গ্যাংয়ের সদস্য। আর ১১০টি গ্যাং-এর সদস্য প্রায় এক হাজার। ওই সময়ে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের ৫২৯ জন সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)-র তালিকাভুক্ত কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ৫২টি। সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০০। ঢাকায় মিরপুরে এখন কিশোর গ্যাং সবচেয়ে বেশি। পুলিশের হিসাবে পুলিশের মিরপুর বিভাগে ১৩টি কিশোর গ্যাং-এর ১৭২ সদস্য সক্রিয়। কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা এলাকাভিত্তিক মাদকের কারবার, মাদকসেবন, মাদক সরবরাহ, ছিনতাই, ইভটিজিং, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি এমনকি খুনের মতো অপরাধেও জড়িত বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।
কিশোর অপরাধ গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান মনে করেন, "এই শিশু কিশোরদের অপরাধের জন্য দায়ী করে পার পাওয়া যাবে না। এর দায় রয়েছে রাষ্ট্র সমাজের ও পরিবারের। শিশুদের শিক্ষাসহ আরো যেসব সুযোগ সুবিধা পাওয়া দরকার তা তারা না পেলে বিপথে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই হচ্ছে। আর অপরাধীরা শিশুদের ব্যবহার করে। তাই শিশুদের জন্য পরিবেশ দিতে হবে।”
তার কথা, "আমাদের এই সমাজ শিশু বান্ধব নয়। তাই শিশুদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে শিশুরা অপরাধ করেনা। তারা ভুল করে। তাই সবখানেই তাদের সংশোধনের পরিবেশ থাকতে হবে। এখন শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আমরা যে পরিবেশের কথা শুনি তাতে তো শিশু শেষ পর্যন্ত অপরাধী হয়ে ওঠার আশঙ্কা আছে।”