২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর। ভারতের ইতিহাসে একটা কালো দিন। ২৩ বছর বয়সি ফিজিওথেরাপির ইন্টার্নকে একটি ফাঁকা বাসে ছয়জন মিলে ধর্ষণ, মারধর ও ভয়ংকর অত্যাচার করেছিল। তার বন্ধুকে মারধর করে আগেই ফেলে দেয়া হয়েছিল। তারপর মৃতপ্রায় নির্ভয়াকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল বাস থেকে। দুই দিন পর তার মৃত্যু হয়। যে ছয়জন তার উপর অত্যাচার করেছিল, তার মধ্যে একজন ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক। তার ১৮ বছর বয়স হতে কয়েকমাস বাকি ছিল।
ভারতের নিয়মানুসারে অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিচার হয় জুভেনাইল কোর্টে। তাদের জন্য নির্দিষ্ট আইন আছে। তাতে শাস্তির পরিমাণ খুবই কম। নির্ভয়ার বিরুদ্ধে অমানবিক অত্যাচার করা একজন বন্দি থাকা অবস্থায় মারা যায়। চারজনের ফাঁসি হয়। আর সেই অপ্রাপ্তবয়স্কর মাত্র তিন বছর জেল হয়। অথচ, নির্ভয়াকে অত্যাচার করার ক্ষেত্রে সে কারো থেকে পিছিয়ে ছিল না। কিন্তু জুভেনাইল আইনে সেটাই ছিল সর্বোচ্চ শাস্তি।
তারপর এনিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। দাবি উঠেছে, ১৬ বছর বয়স হলেই তাকে প্রাপ্তবয়স্ক ধরে নিতে হবে এবং সেভাবে শাস্তি দিতে হবে। সেই বিল এলো ২০১৪ সালে। ২০১৫ সালে আইন হলো, ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সিরা যদি ধর্ষণ, হত্যা ও অন্য কোনো গুরুতর অপরাধ করে, তাহলে তাদেরও প্রাপ্তবয়স্কের মতো বিচার করা যাবে।
কে ঠিক করবে তাদের অপরাধ গুরুতর কি না? তার জন্য আইনে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড তৈরি করার কথা বলা হলো। তাতে মনোবিজ্ঞানী, সমাজকর্মীদের রাখা হলো। তারাই ঠিক করে ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের কোন অপরাধ গুরুতর এবং তা বড়দের আইনে বিচার করা হবে। তারপর আদালত সিদ্ধান্ত নেয়।
এর আগে অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার কারণে দিল্লি-সহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় অপরাধীদের শাস্তির মেয়াদ খুবই কম হয়েছে। দিল্লিতেই ১৭ বছরের এক অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৮ বছর বয়সি একজন প্রতিবন্ধীকে খুন করে তার বাড়ি থেকে প্রচুর সোনাদানা, টাকা হাতিয়ে বিহারে পালাবার চেষ্টা করেছিল। পুলিশ তাকে ট্রেন থেকে গ্রেপ্তার করে। দিল্লিতেই বিলাসবহুল গাড়ি চালিয়ে গভীর রাতে একজন ডেলিভারি ম্যানকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায় দুই অপ্রাপ্তবয়স্ক। একজন ১৯ বছর বয়সি আবার তার দুই অপ্রাপ্তবয়স্ক বন্ধুকে নিয়ে একজন ছাত্রীকে গুলি করে। কারণ, সামাজিক মাধ্যমে আলাপ হওয়া সেই ছাত্রী তাদের সঙ্গে কথা বলছিল না।
তখন আইনে পরিবর্তন করা হয়নি। ফলে তাদের লঘু শাস্তিই হয়েছে। ভারতে অপরাধের সংখ্যাতত্ত্ব রাখে ন্য়াশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের মোট অপরাধের ৭৬ শতাংশই করেছে ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সিরা।
এর মধ্যে বড় শহরগুলির তুলনায় দিল্লির অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। দিল্লিতে ২০২১ সালে দুই হাজার ৬১৮টি অপরাধ করেছে অপ্রাপ্তবস্করা। মুম্বইতে এই সংখ্যাটা মাত্র ৩৩২। দিল্লিতে অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, অপহরণ, হত্যা, নারীনিগ্রহের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে চুরি, ডাকাতির অভিযোগও রয়েছে। তবে চুরি-ডাকাতির তুলনায় অন্য অভিযোগ অনেক বেশি গুরুতর। ২০২১ সালে রাজধানীতে যে অপ্রাপ্তবয়স্করা অপরাধ করেছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মাধ্যমিক পাসও করেনি। ৩০ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রাথমিক পর্যন্ত। ২০ শতাংশ পুরোপুরি অশিক্ষিত। এর মধ্যে ২১৪ জন গৃহহীন। এই সংখ্যাতত্ত্ব থেকে সামাজিক অবস্থানও অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায়।
অপ্রাপ্তবস্করা অপরাধ করলে কেন তাদের শাস্তির পরিমাণ কম রাখা হয়েছে। কারণ, তারা ভুল করে কিছু করে ফেলতে পারে, কিন্তু তা সংশোধন করার সুযোগ ও সময় তাদের হাতে আছে। তাই তাদের বোঝানো হয়, ভুল সংশোধন করার সুযোগ করে দেয়া হয়। তাদের পাঠানো হয় জুভেনাইল হোমগুলিতে। সেখানকার অবস্থাটা কেমন?
২০১৯ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রেকর্ড বলছে, গুজরাটের জুভেনাইল হোম একেবারেই নিরাপদ নয়। সেই হোমের কেয়ারটেকার বা দায়িত্বে থাকা মানুষরা বাচ্চাদের বিরুদ্ধে অপরাধ করে। ২০১৯ সালে এরকম ৬১টি অপরাধ হয়েছে।
টাইমস অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্টে একজন সাবেক জুভেনাইল হোমের কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, হোমগুলিতে উপযুক্ত সংখ্যক কর্মী নেই। ফলে অপ্রাপ্তবয়স্কদের এমন সব কাজ করতে হয়, যা তাদের করার কথা নয়। অনেক সময় মাত্র একবার তাদের কাউন্সেলিং করা হয়েছে, তার ফলো আপ পর্যন্ত করা হয়নি।
গুজরাটে অনেক বেশি অপ্রাপ্তবয়স্ককে হোমে পাঠানো হয়। ২০ লাখের বেশি জনসংখ্যার শহরের মধ্যে সুরাতে সবচেয়ে বেশি অপ্রাপ্তবয়স্ককে ২০১৯ সালে হোমে পাঠানো হয়েছিল।
কিন্তু এই জুভেনাইল হোম নিয়ে, তার অব্যবস্থা নিয়ে, সেখানে বাচ্চাদের বিরুদ্ধে অত্য়াচার নিয়ে সংবাদপত্রে কম রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। কেয়ারটেকারদের অত্যাচারের কথা আগেই বলেছি। ফলে বাচ্চাদের চরিত্র সংশোধন বা মানসিকতা বদলের বদলে তা আরো খারাপ হতেই পারে। শাস্তি শেষ করে বেরোবার পর তারা আগের ভুল বুঝতে পারবে নাকি, আবার সেই অপরাধের রাস্তায় যাবে, তার কোনো গ্যারান্টি থাকে না।