1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শপথ সংঘাতে রাজ্যপাল ও রাজ্য

পায়েল সামন্ত
২৭ জুন ২০২৪

নবনির্বাচিত দুই বিধায়কের শপথ ঘিরে সংঘাতে রাজভবন ও বিধানসভা। ধর্নায় বসেছেন নতুন সদস্যরা। রাজ্যপাল কলকাতা থেকে চলে যাওয়ায় আপাতত ঝুলে রয়েছে বিধায়কদের শপথ।

https://p.dw.com/p/4hZaG
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা
কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভবনছবি: Payel Samanta/DW

লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের দুটি বিধানসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়। ভগবানগোলা ও বরাহনগর বিধানসভা দুটিতে  জয়ী হয় তৃণমূল। মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলায় জেতেন রেয়াত হোসেন সরকার ও উত্তর ২৪ পরগনার বরাহনগরে জয়ী হন সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত চার জুন ফল প্রকাশিত হলেও এখনো তারা বিধায়ক হিসেবে শপথ নিতে পারেননি।

বিধায়কদের ধর্না

বুধবার রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস রাজভবনে নতুন সদস্যের শপথের আয়োজন করেছিলেন। বেলা বারোটায় শপথের অনুষ্ঠান ছিল। কিন্তু সেখানে যাননি রেয়াত ও সায়ন্তিকা। উল্টে তারা ধর্নায় বসেন বিধানসভা ভবনে। তাদের হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা ছিল, 'আমরা শপথ নিতে রাজ্যপালের আগমনের জন্য অপেক্ষা করছি'।

সদ্য নির্বাচিত দুই সদস্যকে বুধবার রাজভবনে ডাকা হয়েছিল। কিন্তু নবান্ন ও রাজভবনের টানাপোড়েনে তারা সেখানে যাননি। শপথ অনুষ্ঠানের নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ার পর রাজ্যপাল বোস শহর ছেড়েছেন কয়েক দিনের জন্য। ফলে তিনি কলকাতায় না ফেরা পর্যন্ত রেয়াত ও সায়ন্তিকার শপথ নেয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

নির্বাচিত সদস্যরা দাবি তুলেছেন, তারা অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শপথ নেবেন। রেয়াত ও সায়ন্তিকা বলেন, "আমরা স্পিকারের কাছে শপথ নিতে চাই। অনুগ্রহ করে রাজ্যপাল সেই ব্যবস্থা করুন।" জয়ের তিন সপ্তাহ পরেও শপথের টানাপোড়েন নিয়ে ক্ষোভ জানান সায়ন্তিকা। বলেন, "বিধানসভা নির্বাচনের আগে মাত্র বছর দেড়েক মেয়াদ আমাদের। শপথ পিছিয়ে যাওয়ায় এলাকার মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার কাজ করা যাচ্ছে না।"

শেষ ধাপে তৃণমূলের দুই প্রার্থীর শেষ নির্বাচন

বুধবারের ধর্নার পর অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দুই সদস্য বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। অধ্যক্ষ বলেন, "অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সাংবিধানিক পদে থেকে রাজ্যপাল এই জটিলতার দ্রুত অবসান না করলে, রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে।"

মুখ্যমন্ত্রীর আক্রমণ

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়টি নিয়ে রাজ্যপালকে আক্রমণ করেছেন। বৃহস্পতিবার নবান্ন সভাঘরে আয়োজিত বৈঠকে তিনি বলেন,  "জেতার পর এক মাস বসে রয়েছেন আমার বিধায়করা। রাজ্যপাল শপথ নিতে দিচ্ছেন না। শপথ নিতে না দেওয়ার কি অধিকার রয়েছে রাজ্যপালের? তিনি স্পিকার অথবা ডেপুটি স্পিকারকে নিযুক্ত করবেন, নইলে নিজে বিধানসভায় আসবেন।"

সম্প্রতি রাজভবনের এক নারী কর্মী রাজ্যপালের বিরুদ্ধে থানায় শ্লীলতাহানির অভিযোগ দায়ের করেছেন। এনিয়ে কটাক্ষ ছিল মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে। তিনি বলেন, "রাজভবনে কেন যেতে হবে সবাইকে? রাজভবনের যা কীর্তি, তাতে মেয়েরা যেতে ভয় পাচ্ছে। আমার কাছে অভিযোগও এসেছে।"

মুখ্যমন্ত্রী আইনমন্ত্রী মলয় ঘটককে নির্দেশ দিয়েছেন এ ব্যাপারে অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে। অধ্যক্ষও জটিলতা কাটাতে আইনি পরামর্শ নিচ্ছেন।

রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি রাজ্য সরকারের সমালোচনা করেছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, "অধ্যক্ষ বিধানসভা চত্বরে যাবতীয় ধর্না, অবস্থান নিষিদ্ধ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও কীভাবে শাসকদলের সদস্যরা ধর্না দিলেন? রাজ্যপাল ঠিক করতে পারেন, শপথ কোথায় হবে, কে করাবেন। রাজ্য সরকার বেআইনি কাজ করছে।"

সিভি আনন্দ বোস রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে রাজ্য সরকারের সঙ্গে বিরোধ লেগেই রয়েছে। দুই সদস্যের শপথ ঘিরেও সেই বিরোধ অব্যাহত। এবার তার আঁচ পৌঁছতে পারে দিল্লিতে।

তৃণমূল কংগ্রেস দলীয়ভাবে বিষয়টি লোকসভায় তুলতে চাইছে। সাংবিধানিক সংকটের প্রশ্নটি সামনে রাখতে চাইছে। লোকসভায় তৃণমূলের নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার সংবিধান রক্ষার পক্ষে সওয়াল করেন সংসদে। রাজ্যপালের ভূমিকাকে সেই দৃষ্টিভঙ্গিতেই ব্যাখ্যা করতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেস।

বিধানসভার পক্ষ থেকেও বিষয়টি দিল্লির দরবারে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন অধ্যক্ষ। রাজভবন যদি শপথ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে কোনো সর্বসম্মতিতে না পৌঁছতে পারে, তাহলে যে সংকট তৈরি হবে, সেটাই তুলে ধরতে চান তিনি।

চলছে টানাপোড়েন

কয়েক দিন ধরেই শপথের বিষয়টি নিয়ে টানাপোড়েন চলছে। রাজভবন অধ্যক্ষকে এড়িয়ে দুই নির্বাচিত সদস্যকে আমন্ত্রণ জানায় শপথের জন্য। এতে অধ্যক্ষ ক্ষুব্ধ হন। তিনি গত সপ্তাহে রাজ্যপালকে চিঠি দিয়ে সংবিধানের সওয়াল তুলে ধরেন। নির্বাচিত সদস্যরাও রাজভবনকে জানিয়ে দেন, তারা অধ্যক্ষের কাছ থেকে শপথ নেবেন।

‘তৃণমূল বিধায়কদের রাজভবনে শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক’

এই টালবাহানার মধ্যে মঙ্গলবার রাজভবন সমাজ মাধ্যমে একটি বিশদ ব্যাখ্যা উপস্থিত করে। তাতে বলা হয়, রাজভবনের সাংবিধানিক মর্যাদাকে অবজ্ঞা করেছেন রাজ্য বিধানসভার অধ্যক্ষ। সংবিধান অনুযায়ী শপথের ব্যাপারে শেষ কথা বলতে পারেন রাজ্যপাল।

এরপর আবার রেয়াত ও সায়ন্তিকাকে চিঠি পাঠিয়ে রাজভবনে আসার অনুরোধ করে রাজভবন। বুধবার বিকেল সাড়ে তিনটে পর্যন্ত রাজ্যপাল তাদের জন্য অপেক্ষা করেন। এরপর দিল্লি চলে যান তিনি। সেই সময়, বিকেল চারটে পর্যন্ত মিনিট দশকের দূরত্বে বিধানসভায় ধর্নায় বসেছিলেন দুই তৃণমূল সদস্য। তারা অবস্থান চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

শপথের অতীত

নতুন নির্বাচিত সদস্যদের শপথ যেমন বিধানসভায় হয়, তেমনই রাজভবনেও এই অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। দুই ধরনের নজিরই রয়েছে। কিন্তু এবার দুই পক্ষের মধ্যে একটা অনড় অবস্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র বলেন, "রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্যের যে বিরোধ চলছে, তারই একটা পর্ব শপথের অনুষ্ঠান। রাজ্যপাল নানা ব্যাপারে রাজ্যের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। তাই শাসক দলের বিধায়করা রাজভবনে গিয়ে শপথ নিতে চাইছেন না। এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।"

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, "সংবিধান অনুসারে রাজ্যপালই বিধানসভার সদস্যদের শপথ গ্রহণের বিষয়ে শেষ কথা বলবেন। কিন্তু সংসদীয় রীতি অনুসারে, নতুন সদস্যদের রাজ্যপাল শপথ বাক্য পাঠ করান বিধানসভায় এসে।"

এবারের লোকসভা নির্বাচনে একক বৃহত্তম দল হলেও বিজেপি নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পায়নি। তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে জোটসঙ্গীদের উপর। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যপালরা বিভিন্ন রাজ্যে আগের মতো কতটা তৎপর থাকবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

শুভাশিস বলেন, "পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের সঙ্গে রাজ্যের যে বিরোধ দেখা গিয়েছে, সেটা আগামী এক-দেড় মাসে কোন জায়গায় পৌঁছয়, সেটা দেখতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারে বিজেপি এখন আর আগের মতো শক্তিশালী নয়। তার প্রতিফলন রাজ্যপালদের গতিবিধিতে পড়তে পারে। শপথ অনুষ্ঠান নিয়ে যে বিরোধ চলছে, তার পরিণতি দেখে বিষয়টা কিছুটা আজ করা যেতে পারে।"

চলতি অচলাবস্থায় সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করছেন অধ্যাপক ভট্টাচার্য। তিনি ডি ডব্লিউকে বলেন, "রাজ্যপাল ও অধ্যক্ষের অহং বোধের জন্য দুই সদস্যের শপথ আটকে গিয়েছে। এর ফলে দুটি বিধানসভা কেন্দ্রের মানুষ বিধানসভার অভ্যন্তরে তাদের প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কোনো এক পক্ষকে অহং সরিয়ে রেখে নির্বাচিত সদস্যদের বিধানসভার কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া উচিত।"