1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বড়দের ব্যর্থতা ছোটদের পথে নামায়

ডয়চে ভেলের মাল্টিমিডিয়া সাংবাদিক আরাফাতুল ইসলাম মূলত রাজনীতি, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা, শরণার্থী এবং অভিবাসন সম্পর্কিত ইস্যু কভার করেন৷ পাশাপাশি জার্মানি ও ইউরোপে জীবনযাপনের নানা দিকও তুলে ধরেন তিনি৷
আরাফাতুল ইসলাম
৩ ডিসেম্বর ২০২১

স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়েরা শিশু৷ এই শিশুদের একটি সুন্দর, নিরাপদ বর্তমান আর সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার দায়িত্ব বড়দের৷ কিন্তু বড়রা সেটা কতটা করতে পারছেন?

https://p.dw.com/p/43lwd
Hamburg Greta Thunberg bei Klimastreik
২০১৯ সালে হামবুর্গে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভছবি: Getty Images/A. Berry

জার্মানির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিককেন্দ্র হামবুর্গে ২০১৭ সালে গিয়েছিলাম জি-টোয়েন্টি সামিট কভার করতে৷ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প থেকে শুরু করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ানসহ বিশ্বের বড় বড় নেতারা হাজির সেই সম্মেলনে৷

নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে গিয়ে পুরো শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল পুলিশ৷ তবে জার্মান কর্তৃপক্ষ একটি বিষয় নিশ্চিত করেছিল৷ বড় বড় বিশ্ব নেতাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো যাবে, শুধু সহিংস প্রতিবাদ এবং কেউ যাতে সহিংসতার শিকার না হন সেটা দেখবে নিরাপত্তা বাহিনী৷

জি-টোয়েন্টি কভার করতে তখন হামবুর্গের কাছাকাছি গিয়ে পড়লাম বিশাল যানজটে৷ শহরের ভেতর ব্যক্তিগত গাড়ি ঢুকতে দিচ্ছে না পুলিশ৷ আমি সাংবাদিক, আমার গাড়ি ঢুকতে পারবে৷ তবে সেজন্য আলাদা যে লেন সেই লেন অবধি পৌঁছাতে পারছিলাম না যানজটের কারণে৷

এরইমধ্যে অভাবনীয় এক দৃশ্য চোখে পড়লো৷ শহরের এক কোণা থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া৷ সেই ধোঁয়ার দিকে আকাশ পথে ছুটে যাচ্ছে হেলিকপ্টার৷ আর রাস্তায় সাইরেন বাজিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য গাড়ি৷ কোনোটি ফায়ার সার্ভিসের, কোনোটি পুলিশের৷ সব মিলিয়ে এক ধরনের যুদ্ধাবস্থার আভাস পাচ্ছিলাম৷ 

হামবুর্গে সেসময় বেশ কয়েক হাজার পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল৷ তবে পুলিশ আগেই জানিয়েছে, প্রতিবাদ দমনে গুলি চালানো হবে না৷ জলকামান, মরিচের গুঁড়া ছিটানো থেকে শুরু করে লাঠিপেটা, ক্রমাগতভাবে গাড়ি সাজিয়ে কিংবা মানব দেয়াল তৈরি করে প্রাণঘাতী নয় এমন সব উপায়ে প্রয়োজনে সহিংস আন্দোলনকারীদের ঠেকানো হবে৷

সেসময় জার্মানি এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বাম দলের অনেক সমর্থক জড়ো হয়েছিলেন হামবুর্গে৷ শহরটির তৎকালীন মেয়র ওলাফ শলৎস, যিনি শীঘ্রই চ্যান্সেলর হতে চলেছেন, প্রতিবাদকারীদের বাধা দেয়ার বিরোধী ছিলেন৷ কোনো ইস্যুতে প্রতিবাদ, আন্দোলন মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, সেটা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন তিনি৷

আর সেই সুযোগে কিছু অতিউৎসাহী প্রতিবাদকারী সাধারণ প্রতিবাদ কর্মসূচির পাশাপাশি রাস্তায় টায়ারে আগুন দিয়ে, দামি গাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে, দোকানপাট ভাঙ্চুর করে এবং পুলিশের উপর আক্রমণ করে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল যা সাম্প্রতিক অতীতে জার্মানিতে দেখা যায়নি৷ তবুও সহিংস আন্দোলনকারীদের দিকে শিসা গুলি ছোঁড়েনি পুলিশ৷ তারা প্রাণঘাতী নয় এমন সব উপায়ে সহিংস আন্দোলনকারীদের নিবৃত্ত করেছে৷

এরকম সহিংস যখন শহরের পরিস্থিতি, তারই মাঝে এক সকালে দেখি হামবুর্গের রাস্তায় হাজার হাজার শিশু-কিশোর৷ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ঠেকাতে বিশ্বনেতাদের ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে রাজপথে নেমেছে তারা৷ শহরের এ-মাথা থেকে ও-মাথা অবধি তাদের সেই প্রতিবাদ লাইভ কভার করেছিলাম৷ শিশুরা চাচ্ছিলো জলবায়ু পরিবর্তনরোধে বিশ্বনেতাদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি এবং সক্রিয় উদ্যোগ৷

লক্ষ্যণীয় হচ্ছে, শিশুদের সেই প্রতিবাদ সমাবেশ যাতে কোনোরকম বাধাবিপত্তি ছাড়া শেষ হয়, হেলমেট পরে লাঠি হাতে কেউ যাতে সেই শিশুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারে, সেটা নিশ্চিত করেছিল পুলিশ৷ শহরের নানা জায়গায় সহিংস পরিস্থিতির মধ্যেও শিশুরা তাই নির্বিঘ্নে তাদের কর্মসূচি পালনে সক্ষম হয়েছে৷

জার্মানির রাস্তা-ঘাটে শিশুদের এমন প্রতিবাদ ইদানীং মাঝেমাঝেই দেখা যায়, তাদের আন্দোলন পুরোপুরি পরিবেশকেন্দ্রিক৷ সেই আন্দোলনের লক্ষ্য একটাই- ভবিষ্যৎ পৃথিবীটা সুন্দর আর নিরাপদ রাখতে জলবায়ু পরিবর্তনরোধে আরো সক্রিয় পদক্ষেপ নিশ্চিত করা৷ বড়রা এখনো এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি, বরং একেক সময় একেকরকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিষয়টি নিয়ে রাজনীতি করছে৷ বাস্তব উদ্যোগ কমই দেখা যায়৷ শিশুরা এই অবস্থার পরিবর্তন চায়৷

জার্মানির ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, গত শতাব্দির ষাটের দশকেও এভাবে ফুঁসে উঠেছিল জার্মান কিশোর-তরুণ-যুবারা৷ সেসময় বিশ্বব্যাপী যুব আন্দোলনের ঢেউ ভালোভাবেই লেগেছিল পশ্চিম জার্মানিতে৷ বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা তাদের যুদ্ধের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গড়ে দিয়েছিল৷ রাজনীতিবিদদের নানা ব্যর্থতা তাদের চরম বিরক্ত করে তুলেছিল৷ ফলে নিজেদের আর্থিক, সামাজিক স্বাধীনতার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক অধিকার পুরোপুরি নিশ্চিতে মাঠে নেমেছিল তারা৷

সেই আন্দোলন জার্মানিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক নীতি বদলে দিয়েছে৷ বড়দেরকে ছোটদের কথা শুনতে, রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি যুদ্ধবিরোধী এবং ‘ছোটবান্ধব’ করতে বাধ্য করেছে৷

গত কয়েকবছর ধরে বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদেরকেও রাজপথে নামতে দেখা যাচ্ছে৷ তাদের মূল দাবি, নিরাপদ সড়ক৷ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ যাচ্ছে শিশু শিক্ষার্থীদের৷ এই পরিস্থিতির পরিবর্তন চায় তারা৷

হতাশার কথা হচ্ছে, শিশুদের এই ন্যায্য দাবি মানার ক্ষেত্রে বড়দের, অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের চেষ্টার ঘাটতি প্রকট৷ বরং তাদের বর্বরভাবে পিটিয়ে রাজপথ থেকে সরানোর চেষ্টাই বেশি দেখা যায়৷ দাবি মানার বদলে সড়ক দুর্ঘটনার জন্য উল্টো তাদেরকেই দায়ী করা হয়৷ 

জার্মানির সঙ্গে এটা এক বড় পার্থক্য৷ এক দেশ শিশুদের দাবি মেনে জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোকে নতুন সরকারের অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করছে, অন্য দেশ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সড়ক নিরাপদ করার বদলে শিশুদের পিটিয়ে রাজপথ আন্দোলনমুক্ত রাখতে চাচ্ছে৷ এটা কোনো গণতান্ত্রিক চর্চা নয়৷

আরাফাতুল ইসলাম, ডয়চে ভেলে
আরাফাতুল ইসলাম, ডয়চে ভেলেছবি: DW/Matthias Müller

জার্মানি আর বাংলাদেশের আরেকটি ব্যবধান দেখতে পাই বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতির দিক দিয়ে৷ জার্মানিতে রাজনৈতিক দলগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্র সংগঠন নেই৷ তবে, বাংলাদেশে আছে৷ দেশটির প্রায় সব রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠন রয়েছে, যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে সক্রিয়৷ এই ছাত্র সংগঠনগুলো নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ২০০৭-২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত সরকার হটাতে কিংবা গত দশকের শুরুর দিকে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে৷

তবে, জনসম্পৃক্ত জাতীয় ইস্যুতে বর্তমানে এসব ছাত্র সংগঠনের শক্তিশালী আন্দোলন তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না৷ বরং শিশুরাই রাজপথে তাদের তুলনায় বেশি সক্রিয়৷        

শেষ করার আগে হামবুর্গের বিষয়ে আরেকটি তথ্য দিয়ে রাখি৷ জি-টোয়েন্টি সম্মেলনের পর শুধু জার্মানি নয়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে সেসব সহিংস আন্দোলনকারীদের খুঁজে বের করা হয়েছিল, যারা হামবুর্গে জ্বালাও-পোড়াও করে জানমালের ক্ষতি করেছিল৷ সহিংসতার ভিডিও ফুটেজ ঘেঁটে তাদের সনাক্তের পর বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল৷

কথা হচ্ছে, সহিংস আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্তদের বিচারে যেমন উদ্যোগী হতে হবে, তেমনি অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে তুলে ধরা যৌক্তিক দাবি-দাওয়া মেনে নেয়ার মানসিকতাও থাকতে হবে৷ এই মানসিকতায় কোথাও কোথাও কি ঘাটতি দেখা যায়?

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য