এর বড় একটা অংশ করে থাকে কিশোর গ্যাং৷
নিজ দলের নাম লিখে পাড়ায় বা এলাকায় অস্তিত্ব জানান দেয় তারা৷ দেয়াল থেকে এসব নাম মুছে ফেলা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি ‘কিশোর গ্যাং' নামে যে অপসংস্কৃতি তা উপড়ে ফেলা৷ কম বয়সীদের এই অপরাধ-চক্র বড়দের প্রক্রিয়ায় থামানো সম্ভব নয়৷ আমাদের আইনও সে কথাই বলে৷
বয়স আঠারোর নিচে হলে সাজার চেয়ে নিজেকে ইতিবাচক পরিবর্তনের দিকে নেওয়ার সুযোগ বেশি পায় কিশোরকালের অভিযুক্তরা৷ যেন ‘ভীতি পুলিশ' নয়, ‘নীতি পুলিশ' এখানে বেশি কেজো৷ তা কী আদৌ কাজে আসছে- সেই প্রশ্নও থাকতে পারে৷ আবার দেশের কিশোর সংশোধনকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ও দায়িত্বরতদের সদিচ্ছার বিষয়টিও সামনে আসতে পারে৷ আবার আইনের প্রয়োগে প্রাথমিক ধাপে যারা আছেন, সেই থানা-পুলিশ প্রসঙ্গও আলোচনার বাইরে থাকতে পারে না৷
কিশোর গ্যাংয়ের ডাকু বা দস্যুপনা নয়, আমাদের পুলিশের প্রায়ই চোখ যায় ‘চুলে'৷ গত কয়েক বছরে আমরা দেখেছি, টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর কিংবা সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এলাকার কিশোর-তরুণদের মাথার কেতা কেমন হবে, সেটা নির্ধারণ করে দিতে চান৷ চুলের বিরুদ্ধে নামে অভিযানে৷ ছেলেদের বড় চুল, রাঙা চুল, এলো চুল যেন সব অপরাধের অভয়ারণ্য৷ অথচ আমরা দেখেছি, দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকেই মাথার ছাঁটে পুলিশের কাছাকাছি৷
‘চুলের স্বাধীনতা' পাওয়া কেউ কেউ অবশ্য বিষয়টির অপব্যবহারও করেছেন৷ এক্ষেত্রে আমরা আপাতত টিকটকের এক পরিচিত মুখের কথা মনে করতে পারি৷ তার চুল দেখে কেউ ‘রুচির দুর্ভিক্ষ' বলতেই পারেন, তবুও রঙ-নকশা কোনো অপরাধ হতে পারে না৷ তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কিশোর গ্যাং গড়ার চেষ্টা করছেন, এমন অভিযোগ যখন সামনে আসে, তখন চুলও তার জন্য ইতিবাচক ব্যাপার হিসেবে আর থাকে না৷ রাজধানীর উত্তরার রাস্তা দখল করে টিকটক ভিডিও করতে গিয়েই ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়েছিলেন সেই টিকটকার৷ তিন বছর আগের সেই ঘটনা মামলা অবধি গড়ায়৷ তাকে তখন গ্রেপ্তারও করা হয়৷
এই আগস্ট মাসে ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের একটি ডাকাতির ঘটনায় বেশ কয়েকজন কিশোরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ যেখানে ডাকাত দলটির নেতৃত্ব দেয় এক ‘কিশোরী'৷ এখানেও অভিযুক্তরা নাকি সবাই টিকটক ভিডিও করতো৷ আর তাদের অনেকেই নাকি আবার মাদকাসক্ত৷ এই মাদকের টাকা সংগ্রহ করতে গিয়েই অনেক কিশোর সংঘবদ্ধ হয়ে অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ছে৷ তাই ‘কিশোর গ্যাং' তৈরির মূলে যা কিছু আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো নেশাদ্রব্য৷ কিশোরদের মাদক থেকে দূরে রাখতে অভিভাবকদের সতর্ক থাকা জরুরি৷ কিন্তু মাদকের যোগান থাকার দায় গড়াবে আবার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা প্রশাসনের কাঁধে৷ পুলিশ সক্রিয় থাকলে একজন কিশোরের পক্ষে মাদক কেনা কোনোভাবেই সম্ভব নয়৷
মাদকের বাইরেও ঘটনা থাকে৷ পাড়ায় কে বড়, কে ছোট-এ নিয়ে দাদাগিরিও কিশোর গ্যাংয়ের পত্তনে ভূমিকা রাখে৷ এমন কারণেই গেল মে মাসে ঢাকার দনিয়ায় মুশফিক তাজুন নামে এক কিশোরকে প্রাণ দিতে হয়েছে৷ শহরতলী বা তৃণমূল তো নজরদারির বাইরেই বলা যায়, কিন্তু কেন্দ্রে বনানীর মতো এলাকায় যখন কিশোর গ্যাং উচ্চশব্দে গান বাজিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে যায়, মানুষকে উত্যক্ত করে, ছিনতাই-রাহাজানিতে জড়িয়ে পড়ে, তখন তার দায় নিতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের৷ সম্প্রতি তারা অবশ্য ‘পিচ্চি জয়' নামে কিশোর গ্যাংয়ের তিন সদস্যকে আটক করেছে৷ কিন্তু এ ধরনের কিশোর অপরাধী দল জন্মের শুরুতেই ঠেকানো যায়নি কেন? কিশোর গ্যাং নামে অপসংস্কৃতি যে চলছে, তার পেছনে পরিবারের অসচেতনতা, সমাজের গোঁড়ামি না রাষ্ট্রের গাফিলতি দায়ী? সব পক্ষকেই নিতে হবে সমান সমান দায়৷ নিজ নিজ জায়গায় যার যার ভূমিকা ঠিক থাকলে দেখা যাবে- ‘জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম অধ্যায় কৈশোরকাল', মনোচিকিৎসক ডা. মোহিত কামালের এই পঙতির কাছে পরাজিত হবে,
তারই রচিত আরেক পঙতি- ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়ও কৈশোরকাল'৷