বাহিনী রুখতে সুপ্রিম কোর্টে আর্জি রাজ্য ও কমিশনের
১৭ জুন ২০২৩নির্বাচনে হিংসাকে নির্মূল করতে কড়া ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রাজ্যপাল। আজ তিনি যান ক্যানিংয়ে।
শীর্ষ আদালতে কমিশন-রাজ্য
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন কেন্দ্রীয় বাহিনীর তত্ত্বাবধানে হোক, এই দাবিতে বিজেপি ও কংগ্রেস মামলা করে কলকাতা হাইকোর্টে।তার ভিত্তিতে একাধিকবার বাহিনী মোতায়েনের কথা বলে আদালত। প্রথমে সাতটি স্পর্শকাতর জেলায় আধাসেনা মোতায়েনের পরামর্শ দিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার আদালত ছেড়েছিল কমিশনের উপর।
কিন্তু এর পর উত্তর থেকে দক্ষিণবঙ্গে মনোনয়ন পর্বে কয়েকজনের মৃত্যু হয়।এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার কড়া অবস্থান নিয়ে হাইকোর্ট বলে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সব জেলার জন্য আধাসেনা চাইতে হবে কমিশনকে। সেই সময়সীমা শেষ হওয়ার দিনই সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানাল রাজ্য সরকার ও নির্বাচন কমিশন। শনিবার শীর্ষ আদালত বন্ধ থাকায় ই-ফাইলিং করা হয়েছে।
এই সম্ভাবনা আঁচ করে আগেই ক্যাভিয়েট দাখিল করেছেন কংগ্রেস সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী। এর ফলে রাজ্য ও কমিশনের আবেদনে শুনানির সময় কংগ্রেস আদালতে বক্তব্য রাখার সুযোগ পাবে।
বিরোধীরা সমস্বরে বাহিনী চাইছে। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তীর প্রশ্ন, "রাজ্য সরকার অন্য রাজ্যের পুলিশ আনতে চাইছে। তা হলে কেন্দ্রীয় বাহিনীতে আপত্তি কোথায়?" মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুক্রবার বাহিনী মোতায়েনের বিরোধিতা করে বলেন, "২০১৩ সালে আধাসেনা দিয়ে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছিল। সেবার ৩৯ জনের মৃত্যু হয়। বাহিনী মণিপুরে কেন হিংসা থামাতে পারছে না?"
ভাঙড় সফরে রাজ্যপাল
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস শুক্রবার ভাঙড় সফরে যান। উপদ্রুত এলাকা ঘুরে দেখেন। কথা বলেন স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে। মনোনয়ন পর্বে তিন দিনের হিংসায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে এখানে। এই সফরের পর রাজ্যপালের কড়া বার্তা, "হিংসাকে বলি দিতে হবে। যারা হিংসা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইন ও সংবিধান মেনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।"
শনিবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিনহাকে তলব করেন রাজ্যপাল। যদিও মনোনয়ন সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত থাকবেন বলে রাজভবনে যাননি কমিশনার। এর পর দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ে যান বোস।
নৌশাদ-বিজেপি যোগ?
ভাঙড়ে অশান্তির জন্য মুখ্যমন্ত্রী দায়ী করেছেন সেখানকার আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীকে। তার অভিযোগ, বিজেপির থেকে টাকা নিয়েছেন নওশাদ। তৃণমূল নেত্রীর এই দাবির পর তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তার সমর্থনে টুইট করেন। শাসকের দাবি খারিজ করে নওশাদের বক্তব্য, টাকা নেয়ার প্রমাণ দেখাতে হবে।
ভাঙড়ে হিংসা নিয়ে ইতিমধ্যে রিপোর্ট তলব করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। মঙ্গলবারের মধ্যে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে।
'বিরোধীশূন্য' পঞ্চায়েত
পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়ন পর্ব শেষ হয়েছে বৃহস্পতিবার। তার পরেই অনেক জায়গায় শাসকদলের বিজয়োল্লাসের ছবি সামনে এসেছে। বিরোধী প্রার্থী না থাকায় অনেকগুলি পঞ্চায়েত দখল করেছে তৃণমূল কংগ্রেস।
এর মধ্যে রয়েছে পশ্চিম বর্ধমানের বারাবনির তিনটি পঞ্চায়েত। মনোনয়নকে কেন্দ্র করে রক্ত ঝরেছে উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায়। সেখানে গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ মিলিয়ে খান দুই আসনে বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পেরেছে। একই ছবি দেখা গিয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফলতায়।
বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি-সহ অন্যান্য জেলা থেকেও ভোটের আগে শাসকের বোর্ড দখলের খবর আসছে। সর্বত্রই বিরোধীরা শাসকদলের বিরুদ্ধে বাধাদানের অভিযোগ তুললেও তৃণমূল তা খারিজ করেছে।
তবে প্রবীণ সাংবাদিক শিখা মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "অন্যান্য রাজ্যেও শাসক জিতে যায় বিরোধী প্রার্থী না থাকায়। এই রাজ্যে গত পঞ্চায়েতে ৩৪ শতাংশ আসনে বিনা ভোটে তৃণমূল জিতেছিল। এবার এই সংখ্যা কম হবে। তবে যতই ভয়ের পরিবেশ বলুন, মানুষ সুযোগ পেলে নিজের ভোট ঠিকই দেয়।"
মনোনয়ন প্রত্যাহারে 'চাপ'
মনোনয়ন দেশের পর্ব শেষ হতে প্রত্যাহারের প্রক্রিয়ায় শুরু হয়ে গিয়েছে। জেলায় জেলায় অভিযোগ উঠেছে, শাসকদলের মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীরা মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য বিরোধী দলের প্রার্থীদের উপর চাপ দিচ্ছে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুরে বিজেপির মহিলা প্রার্থীর স্বামীকে মারধর করা হয়েছে।একই জেলার বারুইপুরে প্রার্থীর বাড়ির মহিলা সদস্যদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে সাদা থান কাপড়। হাওড়ার ডোমজুড় ও নদিয়ার তেহট্টে সিপিএমের দুই মহিলা প্রার্থী একই ধরনের অভিযোগ এনেছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে। যদিও শাসকদলের দাবি, ভোটে হার নিশ্চিত বুঝে মিথ্যা অভিযোগ করছে বিরোধীরা।
শনিবারও বিক্ষিপ্ত হিংসার ঘটনা ঘটেছে। কোচবিহারের দিনহাটায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিকের কনভয়ে হামলার অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূল নেতৃত্ব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ভোটের হাওয়া কোনদিকে
ভোটগ্রহণের সপ্তাহ তিনেক আগেই তপ্ত বাংলার রাজনীতি। তৃণমূল কি এবারও হইহই করে জিতবে? প্রবীণ সাংবাদিক দেবাশিস দাশগুপ্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কয়েকটি জায়গায় বিরোধীরা যে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, তা গত পঞ্চায়েত ভোটে ছিল না। এতে সাধারণ মানুষেরও কিছুটা যোগও আছে। ১২ বছর ক্ষমতায় থাকায় প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা রয়েছে, তার সঙ্গে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তাই ভোটগ্রহণ অবাধ হলে শাসকের চিন্তা বাড়বে।" প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সংখ্যালঘু ভোট এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মইদুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''চোপড়া বা ভাঙড়ের মতো কিছু এলাকায় সংখ্যালঘু ভোটের একটা অংশ এবার তৃণমূলের বিরুদ্ধে আছে। উন্নয়নের প্রত্যাশা সকলের পূরণ হয়নি। আবার দুর্নীতির মাশুল দিতে হচ্ছে সংখ্যালঘুদেরও। তবে নারীদের কী মনোভাব সেটা দেখতে হবে। কিন্তু পুরুষদের একাংশ ক্ষুব্ধ সেটা মনোনয়ন পর্বে বোঝা গিয়েছে।''