তারকারা দোষের ঊর্ধ্বে নয়, তাদেরও শাস্তি হয়
২৬ মার্চ ২০২১ভারতে তখন বোলার বলতে শুধু স্পিনাররা৷ নতুন বলে কয়েক ওভার পেসারদের দিয়ে বল করতে হয় বলে গাভাস্কারই এক ওভার বল করলেন৷ নিয়মরক্ষার পর বল তুলে দেয়া হলো বেদী, প্রসন্ন বা চন্দ্রশেখরের হাতে৷ স্পিনাররা যাতে সাফল্য পান, সেইভাবে পিচ বানানো হতো৷ ভারতের ২২ গজকে তখন বলা হতো পেসারদের মৃত্যুভূমি৷ ফলে ভারতে ফাস্ট বোলার তৈরি হতো না৷ সেই জায়গা থেকে কয়েক দশকের মধ্যে ভারতের চেহারা এখন আমূল বদলে গেছে৷ এখন এতজন ফাস্ট বোলার আছেন যে, কাকে ছেড়ে কাকে রাখা হবে, সেটা ঠিক করতেই টিম ম্যানেজমেন্ট হিমশিম খাচ্ছে৷ পেসার, স্পিনার, অলরাউন্ডার, ব্যাটসম্যান, উইকেটকিপার, সব জায়গাতেই রাশি রাশি ভালো ক্রিকেটার৷ চাহিদার থেকে জোগান বেশি৷ বিরাট কোহলি না খেললেও অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে সেদেশে গিয়ে হারিয়ে আসছে ভারত৷ রোহিত শর্মাকে বাদ দিয়ে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি টিম হচ্ছে৷ অস্ট্রেলিয়ায় যারা ভারতকে জিতিয়ে আনলেন, তাদের অনেকে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টিমে সুযোগই পেলেন না৷
এই অবস্থাটা একদিনে তৈরি হয়নি৷ গত কয়েক দশক ধরে বোর্ডের পরিকল্পনা, ক্রিকেটের প্রতি দর্শকদের অনুরাগ, টিভির সৌজন্যে ভারতীয় ক্রিকেটে প্রচুর অর্থ চলে আসা, তার একটা অংশ ক্রিকেটারদের কাছে যাওয়ার মতো অনেক বিষয় কাজ করেছে৷ অবশ্যই বড় অবদান থেকেছে আইপিএলের মতো প্রতিযোগিতার৷ ভারতীয় ক্রিকেটের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের টাকার অভাব নেই৷ টেস্ট, ওয়ান ডে, টি-টোয়েন্টি বাদ দিন, ঘরোয়া রঞ্জি ট্রফিতে যারা খেলেন, তারা লিগ পর্যায়ে প্রতিদিন ৩৫ হাজার টাকা পান৷ চার দিন খেলা গড়ালে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা পান একটা ম্যাচ থেকে৷ লিগ পর্যায়ের ম্যাচ খেললে ১৪ লাখ টাকা তাদের বাঁধা রোজগার৷ নকআউট পর্যায়ে টিম উঠলে আরো বেশি৷ আম্পায়াররা পান প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা৷ সিনিয়র স্কোরাররা দিনে ১০ হাজার টাকা, এমনকি ভিডিও অ্যানালিস্টরা দিনে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা পান৷ কোনো প্লেয়ার আইপিএলে সুযোগ পেলে অন্তত ২০ লাখ টাকা তো বাঁধা৷ কারণ, সেটাই বেস প্রাইস৷ ফলে রঞ্জি পর্যায়ে ক্রিকেট খেলে অনেকে সংসার চালিয়ে নিতে পারেন৷
ভারতীয় ক্রিকেটের এই রমরমার পিছনে ক্রিকেট বোর্ড এবং ক্রিকেটার সকলের অবদান আছে৷ আবার বোর্ড ও ক্রিকেটারদের মধ্যে সংঘাতের ইতিহাসও আছে৷ বিভিন্ন সময়ে এই সংঘাতের ঘটনা সামনে এসেছে৷ কখনো বোর্ড ক্রিকেটারদের শাসন করেছে, কখনো তাদের দাবি মানতে বাধ্য হয়েছে৷ এই সংঘাত কখনো খুবই বিতর্কিত জায়গায় চলে গেছে৷ যেমন মহিন্দর অমরনাথের ঘটনা৷ অমরনাথকে বলা হতো 'কাম ব্যাক ম্যান'৷ এই অসাধারণ ক্রিকেটার এতবার টিম থেকে বাদ পড়েছেন এবং আবার ঢুকেছেন তার জন্য এই কাম ব্যাক ম্যানের শিরোপা৷ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও কয়েকবার বাদ পড়ে ফিরে এসেছেন ঠিকই, কিন্তু অমরনাথের কাছে তিনি ছিলেন শিশু৷ ক্রিকেটার লালা অমরনাথের এই পুত্রকে গাভাস্কার, ইমরান খান, ভিভ রিচার্ডস থেকে শুরু করে অনেকেই অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান বলেছেন৷ বিশেষ করে পেস বোলিংয়ের বিরুদ্ধে অমরনাথের ব্যাটিং ছিল আদর্শ৷ ডাকাবুকো এই ক্রিকেটার বার বার বাদ পড়ার পর নির্বাচকদের 'আ বাঞ্চ অফ জোকার্স' বা 'জোকারের দল' বলে অভিহিত করেছিলেন৷ ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে অন্যতম সাহসী মন্তব্য৷
অমরনাথের অবশ্য সাহসের কোনো অভাব ছিল না৷ ৮২-৮৩-র ঘটনা৷ ভারত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর করছে৷ মাইকেল হোল্ডিংয়ের বল লাগল অমরনাথের মাথায়৷ কয়েকটা স্টিচ করে পরে যখন আবার ক্রিজে ফিরলেন, তখন হোল্ডিং প্রথম বলটা বাউন্সার দিলেন৷ অকুতোভয় অমরনাথ সেই বল হুক করে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়েছিলেন৷
কপিল দেবের কাহিনিও কম চিত্তাকর্ষক নয়৷ ১৯৮৪ সালে ইডেনে টেস্ট টিম থেকে বাদ পড়লেন কপিল দেব৷ তখন রটেছিল, গাভাস্কারের সঙ্গে বিরোধের জেরেই বাদ পড়েছেন কপিল৷ কিন্তু ৩২ বছর পর গাভাস্কার জানিয়েছেন, তিনি অত বোকা নন যে, টিমের প্রধান বোলারকে বাদ দিয়ে ইডেনে নামবেন৷ আসলে তার আগে দিল্লিতে ফিরোজ শাহ কোটলায় অযথা ছয় মারতে গিয়ে আউট হয়ে টিমকে ডুবিয়েছিলেন কপিল৷ তাই নির্বাচকরা শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য কপিলকে বাদ দিয়েছিলেন৷ বিশ্বকাপ জেতানোর পর কপিলের মাপের একজন প্লেয়ারকে বাদ দেওয়া খুব সহজ কথা নয়৷ সেই কঠিন কাজটাই নির্বাচকরা করেছিলেন একটা বার্তা দেয়ার জন্য৷ দিতে পেরেওছিলেন৷
গ্রেগ চ্যাপেলের কাহিনি তো সকলের জানা৷ সৌরভ ও শচিনের পরামর্শে তাকে ভারতের কোচ করা হয়েছিল৷ দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি সৌরভ ও শচিনকে টিম থেকে ছেঁটে ফেলতে চেয়েছিলেন৷ শচিনকে পারেননি৷ সৌরভকে বলেছিলেন, অবসর নিতে হবে৷ সৌরভকে টিম থেকে ছেঁটে ফেলেছিলেন৷ বোর্ড কোচের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করেনি৷ সৌরভ আবার টিমে ফিরেছিলেন লড়াই করে ও ভালো পারফর্ম করে৷ মহিন্দর অমরনাথ, কপিল দেব, সৌরভ থেকে শুরু করে অনেক প্লেয়ারের ক্ষেত্রেই বোর্ডের বার্তা হলো, কেউই অপরিহার্য নয়৷ বোর্ডের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে৷ প্লেয়ার বাছাই নিয়ে নানান মত থাকতে পারে, জগমোহন ডালমিয়া, শ্রীনিবাসনের মতো ক্রিকেটার নয়, প্রশাসক বোর্ড কর্তাদের কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকতেই পারে, কিন্তু ঘটনা হলো, তারা ভারতীয় বোর্ডকে অত্যন্ত প্রভাবশালী, ধনী ও ক্ষমতাবান ক্রীড়া সংস্থায় পরিণত করেছেন৷
তবে ক্রিকেটাররা এখন যে বিপুল অর্থ পান, সেটাও সহজে হয়নি৷ বোর্ডের সঙ্গে ক্রিকেটারদের সংঘাত হয়েছে৷ কপিল দেব তো বোর্ডের নিষেধ সত্ত্বেও আইসিএলে যোগ দিয়েছিলেন৷ তিনি তখন বোর্ডের ক্রিকেট অ্যাকাডেমির প্রধান৷ আইসিএল করার অনেক কারণ ছিল, তার মধ্যে একটা তো ক্রিকেটারদের পর্যাপ্ত অর্থ দেয়া৷ আঞ্চলিক স্তরের ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক স্তরের ক্রিকেটারদের সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দেয়া, যেটা এখন আইপিএল করছে৷ অর্থ নিয়ে সংঘাতের কাহিনি তো আরো আছে৷ যুবরাজ সিংয়ের সঙ্গেও বোর্ডের বিরোধ বেঁধেছিল৷ ২০১৬ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের আগে চোট পেয়েছিলেন যুবরাজ৷ ফলে আইপিএলের কিছু ম্যাচ খেলতে পারেননি তিনি৷ এই ধরনের ক্ষেত্রে ক্রিকেটারের ক্ষতি পূরণ করে দেয় বোর্ড৷ যুবরাজ ক্ষতিপূরণ চেয়ে বেশ কয়েকটা চিঠি লিখেছিলেন বোর্ডের কাছে৷
ফলে ক্রিকেটার বনাম বোর্ড সংঘাতের ঘটনা এমন কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা নয়৷ অতীতেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে৷ না হওয়াটাই বরং অস্বাভাবিক৷ ক্রিকেট তো ভারতের অঘোষিত জাতীয় খেলা৷ হাজার হাজার কোটি টাকা এর সঙ্গে জড়িয়ে৷ তুলনায় অনেক কম টাকা যেসব খেলায় আসে, জনপ্রিয়তার দিক থেকে যারা ক্রিকেটের অনেক পিছনে আছে, যেসব খেলায় নিয়ামক সংস্থার সঙ্গে ক্রীড়াবিদদের সংঘাত লেগেই আছে৷ ক্রিকেটে তো বরং সেই তুলনায় অনেক কম সংঘাত হয়৷ বোধহয় ভারতে প্রচারের আলো সবসময় ক্রিকেটের উপর থাকে বলেই বোর্ড বনাম ক্রিকেটারদের বিরোধ কম৷ আর এখন তো সৌরভ গঙ্গোপাধ্য়ায় বোর্ডের প্রধান৷ তিনি জানেন, ক্রিকেটারদের স্বার্থ রক্ষা করাটা বোর্ডের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব৷ আর কীভাবে ক্রিকেটারদের স্বার্থরক্ষা করতে হয়, সেটা সৌরভের থেকে ভালো কারো জানার কথা নয়৷