তাঁরা যখন ঘরের মানুষ
৯ জুলাই ২০১৮একজন আয়ার দায়িত্ব ছিল আমাকে আর আমার পিঠাপিঠি বড় ভাইয়ের দেখাশোনা করা৷ তাঁকে আমরা ‘আইয়া' বলে ডাকতাম৷ যতটুকু মনে পড়ে, তিনি যখন চলে যান তখন আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল৷ আমি বলতাম, ‘‘আইয়ার জন্য পরান পুড়ে৷''
এরপর অনেক কাজের লোক এসেছেন আমাদের বাসায়৷ তাঁদের সবার মধ্যে একটা বিষয় খুব কমন ছিল৷ তা হলো, তাঁরা সবাই আমার মা'কে খুব ভালোবাসতেন৷ তাঁরা কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেলেও বারবার এসেছেন মায়ের কাছে৷ এমনকি আমার মা মারা যাবার পরও অনেকে এখনো আমাদের বাড়িতে আসেন৷ আমার মায়ের জন্য তাঁরা মন খারাপ করেন৷
শ্রেণিবৈষম্য থাকলেও এভাবেই মানুষে মানুষে সম্পর্ক হয়৷ সেই সম্পর্ক দেনা-পাওনার বাইরেও অন্য এক সম্পর্ক৷ সেখানে নানান আবেগ কাজ করে৷
আসলে বাড়িতে যখন কোনো কাজের লোক অনেকদিন থাকেন, তখন অজান্তেই তাঁরাও পরিবারের সদস্য হয়ে যান৷ অনেকের ভিন্নরকমের অভিজ্ঞতা আছে৷ কিন্তু আমাদের বাড়িতে অভিজ্ঞতা কম-বেশি অনেকটা এমনই ছিল৷ এমনকি যেসব নারীর শিশু সন্তান ছিল, তাঁরা সেই সন্তানকেও নিয়ে আসতেন৷ সেই শিশুরাও আমাদের বাড়ির সদস্য হয়ে যেতো৷
অনেক মজার স্মৃতিও থাকে এদেরকে নিয়ে৷ একটা ঘটনা বলি৷ স্কুলের পর ঢাকায় পড়াশুনা করতে আসি৷ থাকি বোনের বাসায়৷ সেখানেও এক বুয়া বহু বছর ধরে কাজ করতেন৷ তাঁকেও দেখেছি ঠিক বাড়ির লোকদের মতোই আচরণ করতে৷ বয়স্ক হলেও সেই বুয়া ছিলেন নায়ক মান্নার বিরাট ভক্ত৷
একবার হলো কি, চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে দেখি মান্না অভিনীত কোনো এক চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছে কোনো এক চ্যানেলে৷ আমি চ্যানেলের সাউন্ড বাড়িয়ে দিলাম৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বুয়া হাজির দরজার সামনে৷ স্ক্রিনে তখন মান্নার ফাইটিং দৃশ্য৷ মান্না তাঁর দিগ্বিজয়ী অ্যাকশনে ঘায়েল করছেন সব শত্রুকে৷ কিছুক্ষণ পর দেখি বুয়া নিচু কণ্ঠে বলছেন, ‘‘মার, মার অরে৷'' তাকিয়ে দেখি, তিনি খুব সিরিয়াস৷ হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি৷
বহুবার এমন হয়েছে, বুয়া তাঁর বাড়িতে রান্না করা খাবার নিয়ে এসেছেন আমাদের জন্য৷ তাঁর এই যে বাড়তি ভালোবাসা, তা কোনোভাবেই মাস গেলে বেতন দিয়ে মাপা সম্ভব নয়৷
আমি বলছি না, সবার অভিজ্ঞতা এক হবে৷ কিন্তু এই কাজের লোকগুলোই অনেক সময় পরিবারের গুরুদায়িত্ব পালন করেন৷ এমন অনেক সময় হয়েছে যে, বাড়ি তাঁদের ওপর পুরোপুরি ছেড়ে যেতে হয়েছে৷ আমার পরিবারের অভিজ্ঞতা হলো, তাঁরা খুব ভালোভাবেই তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন৷
বলছি না যে, সবার অভিজ্ঞতা এক হয়৷ অনেকেরই কাজের লোক নিয়ে বিব্রতকর অভিজ্ঞতাও হয়েছে৷ এছাড়া এখন সময় বদলেছে৷ কাজের লোকদের চাহিদা বেড়েছে৷ বেড়েছে তাঁদের ব্যস্ততা৷ এখন সবাই খুব পেশাদার৷ তাই কাজের লোকদের সঙ্গে সেই যে পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সুযোগ, তা-ও সংকুচিত হয়ে গেছে৷ তবে পুরোপুরি পেশাদার হওয়াও ভালো৷
আমাদের সমাজে বাড়ির লোকদের কাজকে ‘কাজ' হিসেবে মূল্যায়ণ করা হয় না৷ তাই কাজের বুয়াদের কাজকেও শ্রমের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হয় না৷ যে যার যার মতো করে বেতন দেন৷ শুধু মাস শেষে বেতন আর উৎসবে কিছু উপরি৷ এর বাইরে বুয়াদের শ্রমের কোনো কাঠামো না থাকার ফলে কাজের প্রশিক্ষণেরও সুযোগ নেই৷
তবে ইদানিং কিছু এজেন্সির মতো প্রতিষ্ঠান কাজের লোক সরবরাহ করে থাকেন৷ এটি ভালো উদ্যোগ৷ এই উদ্যোগকে আরো পেশাদার পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে৷ তবে সবার মঙ্গল হবে৷
এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য লিখুন নীচের ঘরে৷