ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাড়ছে পশ্চিমবঙ্গে
১৪ নভেম্বর ২০১৭প্রতি বছরই রাজ্যে হানা দেয় ডেঙ্গু বা ডেঙ্গি৷ উত্তর থেকে দক্ষিণ, পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় এবার তা স্মরণাতীত কালের মধ্যে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে৷ দেগঙ্গা, হাড়োয়া, দমদম, বিধাননগর থেকে ভাঙড়, কৃষ্ণনগর, জলপাইগুড়ি সদর, মালদাসহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ডেঙ্গু প্রবল দাপট দেখাচ্ছে৷ বেসরকারি হিসেব বলছে, আক্রান্তের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে৷ ইতিমধ্যেই মৃতের সংখ্যা ৫০-এর আশেপাশে৷ রাজ্যে ডেঙ্গুর দাপট থেকে মৃতের সংখ্যা – এসব নিয়ে শুরু হয়েছে চাপানউতোর৷ এই বিতর্কের রসদ জোগাচ্ছে রাজনীতি৷
এই চাপানউতোরের সূত্রপাত কার্যত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে৷ রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা জানিয়েছিলেন, ডেঙ্গুতে এ যাবৎ মৃতের সংখ্যা ৩৮৷ কিন্তু সাংবাদিক বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী সরকারি এই তথ্যকে নাকচ করে দেন৷ জানান, ডেঙ্গুতে রাজ্যে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ অথচ বেশ কিছুদিন ধরে প্রায় রোজই রাজ্যের কোনো-না-কোনো জেলা থেকে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর খবর আসছে৷ তাতে এই সংখ্যাটা ১৩-য় থমকে থাকার কথা নয়৷ তাহলে কীভাবে এই তথ্য পরিবেশন করলেন মুখ্যমন্ত্রী? তার ব্যাখ্যা মমতা নিজেই দিয়েছেন৷ বলেছেন, ‘‘রাজ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা৷ তাঁদের ভুলভাল রিপোর্টের জেরেই যত সমস্যা৷ ভুল তথ্য সরবরাহ করার জন্য বেসরকারি ল্যাবের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে৷''
এ ব্যাপারে কলকাতার অন্যতম খ্যাতনামা প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ‘ডক্টরস ত্রিবেদী অ্যান্ড রয়'-এর প্রধান, চিকিৎসক শুভেন্দু রায় ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘র্যাপিড টেস্টে ভুল হওয়ার প্রবণতা বেশি৷ ছোট বেসরকারি ল্যাবে র্যাপিড টেস্টের মাধ্যমে ডেঙ্গুর রিপোর্ট সরবরাহ করা হয়ে থাকলে, তাতে ভুলের আশংকা বেশি হয়৷ তবে সব বেসরকারি ল্যাবের ক্ষেত্রেই এমন সরলীকরণ করা যাবে না৷ উন্নত প্রযুক্তি বা পরিকাঠামো সম্পন্ন ল্যাবে সঠিক রিপোর্ট আশা করতে পারা যায়৷''
দীর্ঘমেয়াদি বর্ষার জন্য রোগ বৃদ্ধি, মশাদের চরিত্র পরিবর্তন — এ সবের কথা বললেও মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, এ রাজ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক নয়৷ বরং তুলনামূলকভাবে অন্য রাজ্যের থেকে এ রাজ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা কম৷ ভিনরাজ্য থেকে আসা জীবাণুকেও এ রাজ্যে প্রকোপ ছড়ানোর জন্য দুষেছেন মমতা৷ ডেঙ্গুর প্রতাপের কথা স্বীকার না করলেও তিনি পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুযায়ী পুরসভা-পঞ্চায়েতকে প্রতিরোধ গড়তে পূর্ণ বিক্রমে মাঠে নামতে বলেছেন৷ এই সুযোগে বেসরকারি হাসপাতাল ও সংবাদমাধ্যমকে নিশানা করেছেন মমতা৷ তাঁর মন্তব্য, ‘‘ডেঙ্গুর ভয় দেখাচ্ছে সাধারণ মানুষকে৷ স্যালাইন, অক্সিজেন দিয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলিও ৫-৭ লক্ষ টাকার বিল তৈরি করছে৷ আর এ সবে সায় দিচ্ছে সংবাদমাধ্যমও৷''
তবে মুখ্যমন্ত্রীর যে বক্তব্য নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছে, তা হলো অজানা জ্বরের তত্ত্ব৷ মমতার দাবি, অনেকক্ষেত্রেই অজানা জ্বরে মৃত্যু হচ্ছে রোগীর৷ সেটাকে ডেঙ্গু বলে হইচই করছে বিরোধীরা৷ এই মন্তব্যের বিরোধিতায় রাস্তায় নেমেছে বাম-কংগ্রেস-বিজেপি৷ ঘেরাও করা হয়েছে কলকাতা পুরসভা৷ মিছিল হয়েছে জেলায় জেলায়৷ বিধানসভায় বামেদের নেতা সুজন চক্রবর্তী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যে সময় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো, তখন রাজ্য সরকার হাত গুটিয়ে বসেছিল৷ এখন বিপদ যখন ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে, তাই মুখ্যমন্ত্রী তাকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন৷ এমনকি মৃতের সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছেন৷ এক মাস আগেও সতর্ক করেছি, চিঠি দিয়েছি, কিন্তু টনক নড়েনি৷'' সিপিএম নেতার বক্তব্য, রাজ্য সরকার কেন্দ্রের সাহায্য নিতে পারত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে কথা বলতে পারত — কিন্তু এ সব কিছুই করেনি৷
বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান রাজ্যেডেঙ্গুর মহামারীপরিস্থিতির কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে৷ এই জমানায় বিরোধী দলনেতা হিসেবে প্রথমবার উত্তর পেয়েও সন্তুষ্ট হতে পারেননি মান্নান৷ জবাবি চিঠিতে মান্নানের অভিযোগ খারিজ করে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে ডেঙ্গু অনেকাংশে নিরাময় করে ফেলেছে৷ ফেব্রুয়ারি থেকেই বাড়ি বাড়ি সমীক্ষা চালিয়ে বা সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়ে রাজ্য ডেঙ্গুর মোকাবিলা করছে৷ মান্নানের অভিযোগ, রোগের ভয়াবহতা স্বীকার না করে মুখ্যমন্ত্রী চিঠিতে শীতের শুরুতে ভাইরাল জ্বরের প্রসঙ্গও টেনেছেন৷ ক্ষুব্ধ মান্নান একে ডেঙ্গু ধামাচাপা দেওয়ার কৌশল বলে আখ্যা দিয়ে বিধানসভায় অনাস্থা প্রস্তাবে আনার কথা ভাবছেন৷
ডেঙ্গু কিংবা অজানা জ্বর বিতর্ক চিকিৎসকদেরও টেনে এনেছে সম্মেলনের মঞ্চে৷ সেই সম্মেলনে আটটি চিকিৎসক সংগঠনের দাবি, অজানা জ্বরের তত্ত্ব হাজির করা আদতে সত্যি লুকোনোরই চেষ্টা৷ সরকার নিজের ব্যর্থতা চিকিৎসকদের ঘাড়ে চাপাচ্ছে৷ ডেঙ্গু প্রতিরোধে বছরভর যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ছিল, তা নেওয়া হয়নি৷ এই চিকিৎসকদের অভিযোগ, প্রশাসনের কর্তারা চিকিৎসকদের ডেঙ্গু রোগির প্রেসক্রিপশনে কোথায় কী লিখতে হবে, সেটাও বলে দিচ্ছেন৷ চিকিৎসক সংগঠন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম' একটি সচেতনতামূলক ভিডিও প্রকাশ করেছে, যাতে ডেঙ্গু সম্পর্কে নানা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে৷ এই ভিডিওতে কথোপকথনের মাধ্যমে চিকিৎসকেরা ডেঙ্গু সম্পর্কে আমজনতার যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন৷
বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়র, সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী মুখ্যমন্ত্রীর অজানা জ্বরের তত্ত্ব খারিজ করে দিয়েছেন৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘রাজ্যে মানুষ মারা পড়ছে আর মুখ্যমন্ত্রী অজানা জ্বরের তত্ত্ব আওড়াচ্ছেন৷ গত বছরও অজানা জ্বর বলেছিলেন, বিজ্ঞানের এত দুরবস্থা হয়নি যে এক বছরেও সেই জ্বরের হদিশ পাবে না৷ আসলে এ সব ডেঙ্গু থেকে মানুষের নজর ঘোরানোর কৌশল৷'' অন্যান্য বিরোধী নেতাদের বক্তব্য একই৷ তবে ডাক্তার শুভেন্দু রায় ‘অজানা জ্বর' শব্দটিকে একেবারে খারিজ করে দেননি৷ তিনি বলেন, ‘‘অনেক সময় ডেঙ্গু হোক বা টাইফয়েড কিংবা ম্যালেরিয়া, সব পরীক্ষাতেই একজন রোগীর জ্বরকে নেগেটিভ দেখাতে পারে৷ অর্থাৎ তাঁর ওই রোগগুলির কোনোটিই হয়নি৷ সেক্ষেত্রে ওই জ্বরের কোনো নামকরণ করা হয় না৷ তাই অজানা জ্বর শব্দটি চিকিৎসক সমাজে চালু রয়েছে৷''
এই পরিস্থিতিতে মুখ খুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী৷ তিনি রাজ্য সরকারের কাছে চিঠি লিখে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন৷ যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলেছেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে আবার শাসক দলের কটাক্ষ, রাজ্যপাল বিরোধীদের চোখ দিয়ে সমস্যাটিকে দেখছেন৷ ডেঙ্গু নিয়ে শুরু হয়েছে আইনি লড়াইও৷ কলকাতা হাইকোর্টে ডেঙ্গু নিয়ে চারটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়েছে৷ আদালত রাজ্য সরকারকে ১০ নভেম্বর রিপোর্ট পেশের নির্দেশ দিয়েছে৷ সে দিনই হবে এই মামলাগুলির শুনানি৷
মৃত্যুর থেকে বড় সত্যি হয়ত আর কিছু নেই৷ তাই এই রাজনৈতিক চাপানউতোর, পরস্পরের বিরুদ্ধে দাবি, সভা-মিছিল কিংবা আইনি লড়াই — যাই হোক না কেন, দিনের শেষে জ্বর কিন্তু তার শিকারের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে৷ কে তার মারণযাত্রা থামাবে, প্রশ্ন করছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ৷
ডেঙ্গু নিয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচের ঘরে৷ প্রতিবেদনটির দ্বিতীয় পর্ব প্রকাশিত হবে ১৫ই নভেম্বর ২০১৭৷