জনশক্তি ব্যবহারের সেরা সময়ে বাংলাদেশ?
১ মার্চ ২০২৪তারা আরো মনে করেন, তখন চাইলও অর্থনেতিক উন্নয়নে তাদের কাজে পাওয়া যাবে না, বয়স্ক লোকের সংখ্যা বেড়ে যাবে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর-উন-নবী বলেন, "বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড-এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ সর্বশেষ জনগণনার হিসেবে ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সের জন্যসংখ্যা ৬৫ থেকে ৬৬ ভাগ৷ এরাই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী৷” তার কথা, "২০৪১ সালের মধ্যে যদি আমরা এদের কাজে লাগাতে না পারি, তাহলে আমরা কিন্তু আমাদের ট্রেন মিস করবো৷ কারণ, মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাচ্ছে, জন্ম হার কমছে৷ তখন প্রতি পাঁচজনে একজন বয়স্ক মানুষের বয়স হবে ৬০ বছরের বেশি৷ ফলে কর্মক্ষম লোকের সংখ্যা তখন কমে যাবে৷”
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন জব সাইট বিডিজবসডটকমে বেসরকারি খাতে চাকরির সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়৷ নিয়োগ দাতাদের সিভি বাছাইয়ের কারিগরি সহায়তাও দেয় তারা৷ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, "আইটিসহ সেবাখাতগুলোতে চাকরি গত দুই বছর ধরে স্থিতিশীল আছে৷ ম্যানুফ্যাকচারিং ও পোশাক খাতে চাকরি ২০ ভাগের মতো কমে গেছে৷” তবে তারা গ্র্যাজুয়েট লেভেল নিয়ে কাজ করে, যারা ওই পর্যায়ের জনশক্তি নিয়োগ করে তাদের ব্যাপারেই তাদের ভালো ধারণা রয়েছে৷ গ্র্যাজুয়েটদের জন্য প্রতিবছর আইটি ও সেবা খাতে তিন লাখের মতো চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে৷ আর শিল্প খাতে চার-পাঁচ লাখ লোকের চাকরির সুযোগ তৈরি হয়৷
বাংলাদেশে বেসরকারি খাতই কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় জায়গা৷ এরপর হলো যারা বিদেশে যান৷ আর সবার শেষে আছে সরকারি চাকরি৷
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর হিসাবে, দেশে কৃষি খাতে সবচেয়ে বেশি তিন কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার নারী-পুরুষ কাজ করেন৷ শিল্পে এ সংখ্যা এক কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার আর সেবা খাতে ২ কোটি ৬৮ লাখ ৪০ হাজার৷
২০২৩ সালে বিদেশে বাংলাদেশ থেকে কাজের জন্য গিয়েছেন ১৩ লাখ পাঁচ হাজার ৪৫৩ জন৷ ২০২২ সালে এই সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন৷
সর্বশেষ স্ট্যাটিসটিকস অব সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন৷ তাদের মধ্যে নারী চার লাখ চার হাজার ৫৯১ জন, যা মোট সরকারি চাকরিজীবীর প্রায় ২৬ শতাংশ৷ ২০১০ সালে নারী চাকরিজীবীর সংখ্যা ছিল ২১ শতাংশ৷
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারের অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও সরকারি কার্যালয়গুলোতে বেসামরিক শূন্যপদ এখন তিন লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি৷ এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির পদ ৪৩ হাজার ৩৩৬টি, দ্বিতীয় শ্রেণির ৪০ হাজার ৫৬১, তৃতীয় শ্রেণির এক লাখ ৫১ হাজার ৫৪৮ এবং চতুর্থ শ্রেণির শূন্যপদ এক লাখ ২২ হাজার ৬৮০টি৷
বিবিএস-এর হিসাব বলছে, দেশে এখন মোট বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩ লাখ ৫০ হাজার৷ এর মধ্যে পুরুষ ১৫ লাখ ৭০ হাজার এবং নারী সাত লাখ ৮০ হাজার৷ ২০২২ সালে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ১০ হাজার৷ বিবিএসের হিসাব সঠিক ধরে নিলেও এক বছরে দেশে ৪০ হাজার বেকার বেড়েছে৷
বিবিএস ২০২২ সালের জরিপে বলেছে, উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ১২ শতাংই বেকার৷ সংখ্যার হিসেবে এটা আট লাখ৷ এরা সবাই স্নাতকোত্তর, চিকিৎসক, প্রকৌশলী৷
ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘‘আমরা যেসব চাকরির সিভি পাই, তা বাছাই করে দেখা গেছে, তাদের ৮০ ভাগই তারা যে চাকরির জন্য আবেদন করেন তার জন্য আনফিট৷ তাদের আসলে অ্যাকাডেমিক ডিগ্রি থাকলেও ওই কাজ করার মতো প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও যোগ্যতা নাই৷”
তিনি বলেন, "এখন যেসব খাত, বিশেষ করে আইটি, সেবা ও ম্যানেজারিয়াল লেভেলে চাকরির সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যেখানে আইটি জ্ঞানসম্পন্ন লোক দরকার৷ আইটি মানে, শুধু কম্পিউটার জানলেই হবে না, কোনো একটি সেক্টরে তার বিশেষ জ্ঞান থাকতে হবে৷”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান বলেন, "আসলে আমাদের দেশে সঠিক পরিকল্পনা নেই৷ আগামী ২০ বছরে আমাদের কোন খাতে কত লোক লাগবে, কোন ধরনের যোগ্যতার লোক লাগবে, সেই পরিকল্পনা আমাদের নেই৷ ফলে সবাই চাচ্ছে উচ্চ ডিগ্রি নিতে, কিন্তু তা বাস্তবে কাজে আসছে না৷”
"এই যে আমরা বিদেশে জনশক্তি পাঠাচ্ছি, তাদের কোনো পেশাগত দক্ষতা নাই৷ ফলে তারা শ্রমিকের কাজ করছেন৷ তাদের আয়ও কম৷ তাদের প্রশিক্ষিত করে পাঠাতে পারলে তারা ভালো কাজ পেতেন, রেমিট্যান্সও বেশি আসতো৷”
ফাহিম মাশরুর বলেন, "বাংলাদেশের শিল্প খাতে একটি লেভেলে বিদেশি লোবজন কাজ করেন৷ এর কারণ আমাদের ওই কাজের দক্ষ লোক নেই৷ আমাদের দেশে যে কাজ আছে, তা করার জন্যই দক্ষ জনবল আমাদের নেই৷”
বিবিএস বলছে, দেশে বছরে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে৷ তার মধ্যে ১৩-১৪ লাখের দেশের অভ্যন্তরেই কর্মসংস্থান হয়৷ বাকিরা দেশের বাইরে চলে যান৷
২০২৩ সালে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল সাত কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার, ২০২২ সালে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠি ছিল সাত কোটি ৩০ লাখ ৫০ হাজার, ২০২৩ সালে কর্মে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা সাত কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার৷ বিবিএসের হিসাবে বেকারের বাইরে দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠী শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে৷ সেই সংখ্যাটি প্রায় চার কোটি ৭৪ লাখ৷ যাদের বড় অংশই শিক্ষার্থী, অসুস্থ, অবসরপ্রাপ্ত বা বয়স্ক লোক৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং ( সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, "বিবিএসের জরিপে দেশে এখন বকারত্বের হার চার থেকে সাড়ে চার ভাগ৷ কিন্তু এই জরিপ থেকে দেশের বেকারত্বের প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে না, কারণ, এখানে শ্রম শক্তির ৮০ ভাগ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন৷ সেখানে মজুরি কম, কাজের পরিবেশ ভালো নয় আবার চাকরি নিশ্চয়তা নেই৷ ফলে সেখানে ছদ্ম বেকারত্ব আছে৷ কৃষি খাতে ছদ্ম বেকারত্ব আছে৷”
"আরেকটি জনগোষ্ঠী আছে, যাদের কোনো শিক্ষাও নাই, কোনো ধরনের প্রশিক্ষণও তাদের নেই৷ এই সংখাটাও বেশ বড়৷ তারাও সংকটের কারণ,” বলেন এই অথনীতিবিদ৷
তার কথা, গত ১০ বছর ধরে বিনিয়োগ নিম্নমুখী, বৈদেশিক বিনিয়োগেও ভাটা৷ ফলে কর্মসংস্থানের জায়গা তৈরি হচ্ছে না৷ বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর-উন-নবী বলেন,"আমরা ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশ করবে৷ ২০৩০ সালে আমাদের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জন করতে হবে৷ ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হওয়ার স্বপ্ন আছে৷ সেটা হতে হলে আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে৷ তার মানে হলো, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগাতে হবে৷ অর্থাৎ, এটাকে ক্যাপিটালে রূপান্তরিত করতে হবে৷”
তার মতে, "নানা উদ্যোগ আছে কর্মসংস্থান তৈরির৷ দক্ষতা বাড়ানোরও নানা প্রকল্প আছে৷ কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম৷”
বৈদেশিক কর্মসংংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান সম্প্রতি সংসদে বলেছেন, ‘‘আগামী পাঁচ বছরে সরকার ৬০ লাখ লোককে বিদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে৷ বাংলাদেশ থেকে ১৭৬ দেশে এখন লোক পঠানো হচ্ছে৷” কিন্তু এখন যারা যাচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই অদক্ষ কর্মী৷ বিএমইটির জেলায় জেলায় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে৷ আছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষন কেন্দ্রও৷ তবে যে মানের দক্ষ কর্মী দরকার, সেই মানের দক্ষ তৈরি করার জন্য তা পর্যাপ্ত নয়৷ আর শিক্ষা ব্যবস্থাই সেইভাবে সাজানো দরকার৷
বাংলাদেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপের সুযোগ দেয়া হবে৷ আর এজন্য নীতিমালাও তৈরি করা হয়েছে৷ তাতে ওই সময়ে শিক্ষার্থীরা কী সুবিধা পাবেন, শর্ত কী হবে তার বিস্তারিত আছে৷ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্যও নীতিমালা হচ্ছে৷ অবশ্য বেসরকরি প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপের সুযোগ আগে থেকেই আছে৷ তবে সেটা আরো বিস্তৃত এবং নীতিমালার মধ্যে আনতে চায়৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান বলেন, "আসলে এই ইটার্নশিপ একটি ভালো দিক৷ এর মাধ্যমে তরুণরা দক্ষতা অর্জন করতে পারবে৷ তবে সবচেয়ে ভালো হয় শিল্প উদ্যোক্তারা যদি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চুক্তি করেন তাদের প্রয়োজনীয় জনশক্তির জন্য৷ তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেভাবে শিক্ষার কাজ করতো৷ বাইরের দেশে এমনকি আমাদের পাশের দেশেও এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের পাঠক্রম ঠিক করছে৷”
তার কথা, "শিক্ষার দর্শনগত দিক তো আছেই, কিন্তু শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার দিকেও খেযাল রাখতে হবে৷”
আর অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, "বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি এর বৈচিত্র্য এবং বহুমুখীতা দরকার৷ অর্থনেতিক সংস্কার করে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে৷ বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থানের আশা করা যায় না৷”
ফাহিম মাশরুর বলেন,"তরুণদের সরকারি চাকরি, বিশেষ করে বিসিএস-এর প্রতি ঝোঁক প্রমাণ করে, বেসরকারি খাত গুরুত্ব হারাচ্ছে৷ এখানে নিরাপত্তা নেই৷ এখানে বেতন কম৷ আর সরকারি চাকরিতে অবৈধ আয়ের সুযোগ আছে৷ এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়৷ বেসরকারি খাতের আকর্ষণ না থাকলে বুঝতে হবে বড় সংকট তৈরি হয়েছে৷”
সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও পরিকল্পনা মন্ত্রনালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এম এ মান্নান বলেন, "পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কর্মসংস্থান ও দক্ষ জনশক্তি গড়ার বিস্তারিত পরিকল্পনা আছে৷ তবে করোনা, ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্বমন্দা – এসব কারণে ছন্দপতন হয়েছে৷ তবে আশা করি, এটা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো৷”
তার কথা, "সরকার প্রযুক্তি শিক্ষায় জোর দিয়েছে৷ জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করছে৷ এর উদ্দেশ্যই হলো দক্ষ জনবল গড়ে তোলা৷”