‘যদি সবাই মিলে চেষ্টা করি তাহলে কেউ কর্মহীন থাকবে না'
১ মার্চ ২০২৪ডয়চে ভেলে : বর্তমানে বাংলাদেশে কত মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে?
ড. গাজী মো. সাইফুজ্জামান : বাংলাদেশে নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অনেক মানুষেরই কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। আমরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে যে গ্রুপটাকে নিয়ে কাজ করি, সেটা হলো নিট পিপল। নিট পিপল হলো, না কর্মসংস্থানে আছে না পড়াশোনার মধ্যে আছে, না ট্রেনিংয়ের মধ্যে আছে। দেশের জনসংখ্যা যেহেতু ১৭ কোটি, ফলে এই নিট পিপলের সংখ্যা ১ কোটি ৮২ লাখ। ১৮ বছর থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে জনশক্তি হলো ৬ কোটির মতো। এর মধ্যে অনেকেই লেখাপড়ার মধ্যে আছে। কিন্তু যারা ট্রেনিংয়ে নেই, প্রশিক্ষনে নেই পাশাপাশি কর্মেও নেই, সেই জনগোষ্ঠার সংখ্যা হলো ১ কোটি ৮২ লাখ। আমরা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে যে কাজ করি, তার মধ্যে ১০টি প্রকল্প চালু রয়েছে। এই ১০টি প্রকল্পে আমরা ১২ লাখ ৩৫ হাজার জনকে প্রশিক্ষিত করছি। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হিসেবে আমরা এই প্রকল্পগুলোকে সম্প্রসারণ করছি। তাতে এই সংখ্যাটা ৩৩ লাখ ৫২ হাজার হবে। এই জনগোষ্ঠীকে আমরা, অর্থাৎ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্মসংস্থানে নিয়ে আসছি। পাশাপাশি আমাদের যে রাজস্ব বাজেট আছে, তার আওতায় আড়াই লাখ কর্মীকে প্রশিক্ষন দিয়ে দক্ষ করি। তাতে আগামী ৫ বছরে আরও ২২ লাখ মানুষ প্রশিক্ষিত হবেন। আগামী ৫ বছরে সবমিলিয়ে ৫৫ লাখ কর্মীকে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়ে মানব সম্পদে রুপান্তর করবো।
যাদের প্রশিক্ষন দেন, তাদের কি আপনারা চাকরি দেন?
জনগোষ্ঠীর যে অংশটা আমাদের কাছে প্রশিক্ষন গ্রহণ করে, তাদের চাকরি দেওয়ার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। আমরা যেটা করি, তিনি যেন আত্মকর্মী হয়ে উঠতে পারেন, সেজন্য আমরা তাকে ঋণ সহায়তার ব্যবস্থা করে থাকি। তিনটা উৎস থেকে, তাদের ঋণ দেওয়া হয়। আমাদের নিজস্ব তহবিল থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা ঋণ দিয়ে থাকি। এছাড়া কর্মসংস্থান ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের এমইউ করা আছে। সেখান থেকে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া যায়। এর বাইরে এনআরবিসি ব্যাংকের সঙ্গে আমাদের এমওইউ আছে। সেখান থেকেও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত কেউ ঋণ পেতে পারেন। আমরা আশা করি, আমাদের এই প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তিনি আত্মকর্মীতে পরিণত হবেন। নিজে উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে স্বাবলম্বী হবেন।
চাকরির বাইরের উদ্যোক্তা হওয়ার প্রশিক্ষনও কি আপনাদের এখান থেকে দেওয়া হয়?
অবশ্যই। তিনি যেন সফল উদ্যোক্তা হতে পারেন, সেই প্রশিক্ষনও আমরা দিয়ে থাকি। অনেকেই সফল উদ্যোক্তা হয়ে প্রমাণ করেছেন। তাদের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তাদের মাধ্যমে আবার আরো অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। পাশাপাশি আমাদের দেওয়া প্রশিক্ষন গ্রহণ করে যদি কেউ অন্য কোথাও চাকরি পান, সেক্ষেত্রে এটাকে আমরা সাফল্য হিসেবে দেখি। আমাদের প্রশিক্ষন নিয়ে অনেকে চাকরি পেয়েছেন, অনেকে উদ্যোক্তা হয়েছেন, এই দুই ধরনের সাফল্যই আমাদের আছে।
এত উদ্যোগের পরও দেশে কেন এত বেকার?
এর একটা কারণ হতে পারে, আমাদের জনসংখ্যার মাত্রাটা বর্ধিষ্ণু। প্রতি বছরই এটা বাড়ছে। বৈশ্বিক মন্দার প্রেক্ষিতে বিদেশে যারা কাজ করতেন, তাদের অনেকেই দেশে ফিরে এসেছেন, এটাও একটা কারণ হতে পারে। এছাড়া অনেকেই নিয়মিত পড়াশোনার মধ্যে ছিলেন, আমাদের ধারণা ছিল তিনি হয়ত ভালো চাকরিতে যাবেন৷ কিন্তু কিছুদিন পর আমরা দেখলাম তিনিও নিট পিপলের আওতায় চলে এসেছেন। এই নিট পিপলকে সিঙ্গেল ডিজিটে আনার চেষ্টা করতে হবে। এই কারণে আরো ৩২ লাখ মানুষকে প্রশিক্ষনের আওতায় আনতে আমরা প্ল্যানিং কমিশনে একটা প্রকল্প জমা দিয়েছি। এটা পাশ হলে আগামী ৫ বছর ৮০ লাখেরও বেশি মানুষ প্রশিক্ষিত হবেন। এর বাইরে যে নিট পিপল ১ কোটি বাদ থাকলো, সেটার জন্য আইসিটি ডিভিশনের প্রকল্প আছে, সমাজ সেবার প্রকল্প আছে, কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প আছে, মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প আছে। মোটামুটি সব মন্ত্রণালয়েরই কিছু না কিছু প্রকল্প আছে। সবাই মিলে আমরা যদি এই প্রায় ২ কোটি মানুষকে মূল কর্মধারায় আনতে পারি, তাহলে আমাদের মূল লক্ষ্য মাথাপিছু আয় ২০৪১ সালের মধ্যে সাড়ে ১২ হাজার ডলার, সেটি অর্জনে তারা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবেন।
কর্মসংস্থান বাড়াতে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন?
আমি মনে করি, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে এক ধরনের উৎকর্ষতা সাধনের সুযোগ রয়েছে। আমাদের জীবনমুখী লেখাপড়া দরকার। একজন অনার্স বা মাস্টার্স যা-ই হোক, তিনি পাশ করে বের হওয়ার পর যেন এক ধরনের দক্ষতা নিয়ে বের হন। উনি যদি চাকরি করেন, সেখানেও যেন ভালো করতে পারেন। আবার যদি উদ্যোক্তা হন, তাহলেও যেন ভালো করতে পারেন। জীবনমুখী শিক্ষাটা যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে আমাদের ভাবা দরকার। কারণ, আমরা কর্মমুখী জাতি হিসেবে, দক্ষ জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। যারা শিক্ষা গ্রহণ করেননি, তাদের সরকারকে পুঁজি দিয়ে সহযোগিতা করতে হবে। আমাদের যে ১০০টি ইকোনমিক জোন হচ্ছে, সেখানে যেন সঠিকভাবে শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে। এরা যেন সেখানে কাজ করতে পারে সেই ধরনের পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। আসলে সব ধরনের উদ্যোগেরই প্রয়োজন রয়েছে। একেক জনের মধ্যে একেক ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে। তাদের কাজে লাগানো হলেই বেকারত্ব হ্রাস পাবে এবং আনন্দময় অভিযাত্রা পরিলক্ষিত হবে।
সম্প্রতি সরকারি প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপের সুযোগ দিয়েছে সরকার। এই উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসু হবে?
এটা অবশ্যই ফলপ্রসু হবে। কারণ, অনেক সময় দেখা যায়, শিক্ষিত বেকার যুবক দক্ষতার অভাবে বা অভিজ্ঞতার অভাবে ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি পায় না। আমাদের প্রাইভেট সেক্টরে যারা কাজ করেন, তাদের একটা বড় অংশকে শ্রীলংকা এবং ভারত থেকে আনতে হয়। তাদের জন্য আমাদের দেশটা কর্মের স্বর্ণভূমিতে পরিণত হয়েছে। কারণটা কী? তারা ভালো ইংরেজিতে কথা বলতে পারে, লিখতে পারে। অফিস ব্যবস্থাপনাও তারা ভালো বোঝে। সরকারি অফিসে ইন্টার্নিশিট করার ব্যবস্থাটা যদি আমরা সঠিকভাবে করতে পারি তাহলে আমাদের কর্মীদের মধ্যেও এক ধরনের দক্ষতা তৈরি হবে। তারা কিভাবে প্রেজেনটেশন দিতে হয়, কীভাবে অফিস ব্যবস্থাপনা করতে হয় সেগুলো ভালোভাবে জানতে পারবে। ফলে এরা চাকরিতে গেলেও ভালো করবে। সে হিসেবে আমি মনে করি উদ্যোগটা ভালো।
প্রতি বছর যে পরিমাণ শিক্ষার্থী বের হচ্ছে, সেই পরিমান কি কর্মসংস্থান বাড়ছে? কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ কতটুকু?
কর্মসংস্থান বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের জননীতির দিকে আরেকটু মনোযোগ দিতে হবে। মোট জনগোষ্ঠী যদি ১৭ কোটি হয়, এর এক তৃতীয়াশ তরুণ। এদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর। এর পরিমান প্রায় ৬ কোটি। এর মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের ট্রেনিং দিয়ে আত্মকর্মী হওয়ার কথা বললে তারা বিরক্ত হবেন। কারণ, তিনি একটা ভালো শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে আছেন। তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ভালো একটা কর্মসংস্থানে যাবেন। এই ধরনের শিক্ষার্থীদের বাদ দিলে যেটা থাকে সেটা কমবেশি ২ কোটি। এই ২ কোটিকে কর্মসংস্থানে আনতে আমাদের সব মন্ত্রণালয় মিলে একটা সমন্বিত পরিকল্পনা দরকার। আমরা যুব থেকে ৮০ লাখকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, এভাবে অন্যরা যদি ভাগ করে কাজ করেন তাহলে কোনো মানুষই বেকার থাকবে না। আমি যেটা স্বপ্ন দেখি, প্রথমে একটা গ্রামের সবাইকে প্রশিক্ষন দিয়ে এবং ঋন সহায়তা দিয়ে গ্রামটাকে বেকারমুক্ত করা। এভাবে গ্রামের পর ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলাকে আমরা বেকারমুক্ত করতে পারি। যেভাবে প্রধানমন্ত্রী আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ২৭ জেলাকে গৃহহীন-ভুমিহীন মুক্ত করেছেন। আমরাও যদি সাবাই মিলে চেষ্টা করি তাহলে কেউ কর্মহীন থাকবে না সে কাজ করতে পারি। আমাদের সময় এসেছে ‘কর্মায়ন' নামে একটা ব্যাপকভিত্তিতে পরিকল্পনা নেওয়ার। যেটা আমাদের দেশের চালিকাশক্তিতে পরিনত হতে পারে।