করোনার এক বছর
৮ মার্চ ২০২১গত বছরের এই দিনে (৮ মার্চ) বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয়৷ শুরুতে করোনা নিয়ে নানা ভয়, সিদ্ধান্তহীনতা এবং চিকিৎসার অবব্যবস্থাপনায় এক জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়৷ বিশ্লেষকেরা মনে করেন, করোনার অভিজ্ঞতা সারা পৃথিবীর মত বাংলাদেশেও প্রথম৷ যেহেতু ভাইরাসটি ছিলো নতুন, তাই তার অনেক কিছুই অজানা ছিল৷ ফলে শুরুতে অনেক কিছুই ঠিক ছিল না৷ কিন্তু এখন ঠিক হচ্ছে৷ আর ভ্যাকসিন এসে যাওয়ায় মানুষের আতঙ্ক কমেছে৷ অনেক কিছু সহজ হয়েছে৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে গত বছরের ৮ মার্চ থেকে চলতি বছরের ৭ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনায় মারা গেছেন আট হাজার ৪৬২ জন৷ এই সময়ে আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন পাঁচ লাখ ৫০ হাজার ৩৩০ জন৷ সুস্থ হয়েছেন পাঁচ লাখ তিন হাজার তিন জন৷ সংক্রমণের সর্বোচ্চ হার ছিলো গত জুলাই মাসে৷ এপর্যন্ত মাস হিসেবে মোট সংক্রমণের ২২.৪৬ ভাগ হয়েছে ওই মাসে৷ আর গত ফেব্রুয়ারি মাসে সর্বনিম্ন ২.৮২ ভাগ সংক্রমণ হলেও এখন তা আবার বাড়ছে৷ মার্চ মাসের প্রথম সাত দিনেই তা হয়েছে ৪.০৩ ভাগ৷
বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে করোনার ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়েছে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে৷ এপর্যন্ত প্রায় ৩৮ লাখ মানুষ ভ্যাকসিন নিয়েছেন৷ আর নিবন্ধন করেছেন প্রায় ৬০ লাখ৷
গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, ‘‘শুরুতে লকডাউন, বিশেষ এলাকায় লকডাউন, সাধারণ ছুটি আর বিশেষ করে পোশাক শ্রমিকদের ছুটি দেয়া আবার করোনার মধ্যেই ঢাকায় ফেরত আনা- এসব পরিকল্পনায় অনেক ত্রুটি ছিলো৷ কিন্তু এখন তা কাটিয়ে ওঠা গেছে৷ তবে স্বাস্থ্য খাতের অব্যবস্থাপনা এর দুর্নীতির যে চিত্র প্রকাশ পেয়েছে তা ভয়াবহ৷ সেটা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি৷’’ বিশেষ করে মাস্ক, পিপিপিই এবং করোনা পরীক্ষার নানা কেলেঙ্কারি হয়েছে বাংলাদেশে৷
সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি যে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে আমদানি ও রপ্তানি সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে গিয়েছিলো তা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ৷ তবে পোশাকখাতসহ বিভিন্ন খাতে যারা চাকরি হারিয়েছেন তাদের একটি অংশ আর কাজ ফিরে পাবেননা বলে মনে করেন তিনি৷ তার মতে, ‘‘অনেকে বয়স্ক হওয়ার কারণে কাজ ফিরে পাচ্ছেন না৷ আবার অনেকে নতুন দক্ষতা না থাকায় কাজ পাচ্ছেন না৷’’
সামাজিক সুরক্ষা এবং করোনাকালে খাদ্য সহায়তা সরকারের ভালো একটি উদ্যোগ৷ কিন্তু সেখানেও অনেক দুর্নীতি হয়েছে৷ ত্রাণ সামগ্রী চুরি হয়েছে৷ আর সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছে তা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের কাজে আসেনি৷ তারা ব্যাংকের কাছ থেকেই ঋণ পাননি৷
পোশাকখাত তাদের ক্ষতি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে৷ শেষ পর্যন্ত তাদের অর্ডার বাতিল হয়েছে ১০ ভাগের মত৷ তবে বৈশ্বিক কারণেই এখন পোশাকের চাহিদা কমেছে৷
তবে করোনার এক বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, মুক্ত চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা৷ কিন্তু এই দুর্যোগের সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অবাধ তথ্যপ্রবাহ৷ করোনাকালে সংবাদমাধ্যম ত্রাণ, চিকিৎসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার খবর প্রকাশ করতে গিয়ে চাপের মুখে ছিল৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপরও নজরদারি বাড়ানো হয়৷ সমালোচনা সহ্য করার ক্ষেত্রে সরকার ও ক্ষমতবানদের অসিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটেছে৷ আর তার করতে গিয়ে জিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বেড়েছে৷
আর্টিকেল ১৯ এর হিসাব অনুযায়ী ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে এই আইনে মামলার পরিমাণ বেড়েছে তিন গুণেরও বেশ৷ ২০২০ সালে ১৯৮টি মামলায় আসামি করা হয় ৪৫৭ জনকে৷ এরমধ্যে ৪১টি মামলায় ৭৫ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়৷ ৩২ জন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ মামলায় সাংবাদিক ছাড়াও চিকিৎসক, শিক্ষক, শিল্পী, সাংস্কৃতিক কর্মী, কাটুনিস্ট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অ্যাক্টিভিস্টদের আসামি করা হয়৷ ২০১৯ সালে মামলা হয় ৬৩টি৷
আর্টিকেল ১৯ এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, ‘‘করোনার সময় এই এক বছরে সংবাদমাধ্যম এবং বাক স্বাধীনতা অনেক বেশি সংকুচিত হয়েছে৷ করোনা নিয়ে সমালোচনা করে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশে এই প্রথম মুশতাক ‘শহীদ’ হয়েছেন৷ আর কার্টুন আঁকার জন্য এই করেনার সময়ই কিশোরকে নির্যাতন করা হয়েছে৷ করোনার সময়ে অনেক বেশি সাংবাদিককে ডিজিটাল আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ ছাত্র, চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷ সাংবাদিকদের হাসপাতালে যেতে নিষেধ করা হয়েছে৷ নার্সদের বলা হয়েছে সাংবাদিকদের তথ্য না দিতে৷ প্রকিউরমেন্ট-এর দুর্নীতি নিয়ে কথা বলা যায়নি৷’’
তিনি মনে করেন, করোনার সময়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, যেসব দেশে কর্তৃত্ববাদী মনোভাব আছে সেখানেই এরকম ঘটেছে৷ ব্রাজিল, ফিলিপাইন, ভারতেও এরকম ঘটেছে৷ কারণ যতই দুর্যোগ আসে ততই দুর্নীতির সুযোগ বাড়ে৷ এই দুর্নীতি করে কারা? যারা ক্ষমতায় থাকে৷ ক্ষমতা না থাকলে দুর্নীতি করা যায়না৷ বাংলাদেশে এবার আমরা করোনায় সাহেদ-সাবরিনাদের মত সুপারহিট দুর্নীতিবাজদের দেখেছি৷
তিনি বলেন, ‘‘করোনা শুরুতে অব্যবস্থাপনার কারণে এই দুর্নীতি বেড়েছে৷ তবে এখন অনেকটাই সামাল দিয়েছে সরকার৷ তবে বেসরকারি খাতে ভ্যাকসিন আসা শুরু করলে আবার দুর্নীতির আশঙ্কা করছি৷’’
ডা. লেনিন চৌধুরী মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশ করোনার প্রথম ধাক্কা সামলাতে পেরেছে৷ কিন্ত আরো সামনে ধাক্কা আসতে পারে৷ সে জন্য এখনই স্বাস্থ্য খাতে অবস্থাপনা, দুর্নীতি দূর করা প্রয়োজন৷’’
ফারুক ফয়সালের মতে, ‘‘করোনার মতো যেকেনো দুর্যোগে সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে তা মোকবেলা সহজ হয়৷’’