করোনা মানুষকে অপরাধপ্রবণ করে তুলছে
১১ সেপ্টেম্বর ২০২০কয়েক দিন আগে গল্প হচ্ছিল মন-সমাজবিদ মোহিত রণদীপের সঙ্গে৷ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এই মানুষটি বেশ কয়েক বছর ধরে মনের উপর সমাজের প্রভাব কীভাবে পড়ে, এবং তা থেকে কত রকম মানসিক সমস্যা তৈরি হতে পারে, এ বিষয়ে কাজ করছেন৷ করোনার শিকার মোহিত প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন একটি সরকারি হাসপাতালে৷ বলছিলেন, একজন করোনা রোগীকে কতরকম তাচ্ছিল্যের এবং আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে সেখানে৷
শুধু তাচ্ছিল্য নয়, শুধু আক্রমণ নয়, করোনাকালে গোটা বিশ্বেই আসলে সহিংসতা এক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে৷ অসভ্য বর্বর আচরণ করছে আপাত সুশীল সমাজ৷ এমন নয় যে, করোনার আগে পৃথিবী স্বর্গরাজ্য ছিল, কোথাও কোনো ক্রাইম, সংঘাত, আক্রমণ ছিল না৷ ছিল, সবই ছিল৷ কিন্তু করোনাকালে তা যেন এক ধাক্কায় অনেকটা বেড়ে গিয়েছে৷ কেন? মনস্তত্ত্বিদদের কাছে এই প্রশ্নটিরই উত্তর খুঁজছিলাম৷ একেকটি ঘটনা ধরে জানতে চাইছিলাম, করোনাকাল না হলে কী এমন ঘটনা ঘটতো? উত্তরে পরে যাবো৷ প্রথমে এক নজরে ঘটনাগুলি দেখে নেওয়া যাক৷ ইচ্ছে করেই নানা ধরনের ঘটনার উল্লেখ করছি যাতে গোটা সমাজের চিত্রটি পাওয়া যায়৷
অ্যামেরিকার পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়া যাক৷ রাজনৈতিক পক্ষপাতে না গিয়েই বলা যায়, করোনার এক মাস আগেও মার্কিন বিশ্বে ডনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা যথেষ্ট ছিল৷ তার মানে এই নয়, ট্রাম্পের আমল খুব নিষ্কন্টক৷ বহু অন্যায়, বহু অপরাধ হয়েছে৷ কিন্তু কোনো কিছুই এমন পর্যায়ে পৌঁছায়নি যে, ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার্সে’র মতো একটি লাগাতার আন্দোলন গড়ে উঠবে৷ হয়েছে তো! করোনার আগেও ‘বর্ণবাদী’ মার্কিন পুলিশ কৃষ্ণাঙ্গকে অপমান করেছে৷ মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট৷ শরণার্থীদের নিয়ে অন্যায় রাজনীতি হয়েছে৷ কিন্তু করোনাকালে জর্জ ফ্লয়েডের গলায় পা দিয়ে যেভাবে মেরে ফেলা হয়েছে, তা এক কথায় বর্বর৷ ফ্লয়েডের হত্যা ঘিরে আন্দোলন হয়েছে৷ সেই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আরো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে৷ পুলিশের নির্লজ্জ চেহারা আরো স্পষ্ট হয়েছে৷
অসভ্যতা কেবল অ্যামেরিকায় হয়নি৷ জার্মানির রাজধানী বার্লিনে মাস্কবিরোধী মিছিলও অসহিষ্ণুতার অন্যতম উদাহরণ৷ যে কোনো বিষয়েই এক শ্রেণির মানুষের বিরোধিতা থাকতে পারে৷ বিতর্ক থাকতে পারে৷ কিন্তু সময়ের কথা মাথায় রেখে সভ্য মানুষ কোনো কথা বলেন, কোনো কাজ করেন, কোনো কোনো বিষয় থেকে নিজেকে বিরত রাখেন বৃহত্তর সমাজের মঙ্গলের কথা ভেবে৷ বার্লিনে মাস্কবিরোধী মিছিল সেই সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যে কাণ্ড করেছে, ইতিহাস তা ক্ষমার চোখে দেখবে না৷ যেমন ইতিহাস মনে রাখবে জার্মানির ওই মা-কে৷ ডুসেলডর্ফের কাছের একটি শহরে ছয় সন্তানকে নিয়ে থাকতেন তিনি৷ পাঁচ সন্তানকেই হত্যা করেছেন তিনি৷ নিজেও আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তবে বেঁচে গিয়েছেন৷ জার্মানিতে এমন ঘটনা অভূতপূর্ব৷
জার্মানিতে যা অভূতপূর্ব, ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মতো দেশে তা ততটা অস্বাভাবিক নয়৷ খাদ্যের অভাবে গোটা পরিবার আত্মহত্যা করছে, কিংবা বাবা অথবা মা হত্যা করছেন ছেলেমেয়েদের-- এমন খবর হরদম না হলেও মাঝে মধ্যেই শোনা যায়৷ ধর্ষণ, খুন, রাহাজানি ভারতীয় উপমহাদেশের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা৷ কিন্তু করোনাকালে তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে৷ করোনা সেন্টারে ঢুকে রোগীকে ধর্ষণ করা হয়েছে ভারতে৷ অ্যাম্বুলেন্সের চালক গাড়িতেই রোগীকে ধর্ষণ করেছে৷ বিভিন্ন শহরে ক্রাইম রেট চোখে পড়ার মতো বেড়েছে৷ করোনাকালে পারিবারিক হিংসা শুধু ভারতেই বেড়েছে ৩৩ শতাংশ৷ বস্তুত গোটা পৃথিবীতেই করোনাকালে পারিবারিক হিংসা লাফিয়ে বেড়েছে৷ বেড়েছে বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণও৷
বাংলাদেশের পরিস্থিতিও একই রকম৷ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা খানমের উপর আক্রমণের ঘটনাই ধরা যাক৷ দিবাগত রাতে যেভাবে বাড়ির ভিতর ঢুকে হামলা হয়েছে৷ হাতুড়ি পেটা করা হয়েছে, তা এক কথায় ভয়াবহ৷ সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রশাসন যাদের আটক করেছে, তাদের জেরা করেও ওই হামলার স্পষ্ট কোনো কারণ এখনো বোঝা যায়নি৷ কেবলমাত্র চুরির উদ্দেশে এমন নৃশংসতা?
আর পারিবারিক সহিংসতা? পিরোজপুরের ঘটনা এখনও টাটকা৷ সৌদি আরব প্রবাসী ছেলের বউকে কীভাবে শাশুড়ি এবং তার সহযোগীরা হেনস্থা করেছিলেন তা আরো একবার বিশদে বলার অর্থ হয় না৷ এমন ঘটনা বহু ঘটে৷ কিন্তু করোনাকালে এ ধরনের ঘটনা, সহিংসতার চরিত্র যেন একটু বেশিই ভয়াবহ৷
উদাহরণ দেওয়া যায় আরো৷ শুধুমাত্র কলম্বিয়ায় করোনাকালে পারিবারিক হিংসা বেড়েছে ৫০ শতাংশ৷ নারীদের খুন করার পরিমাণ ভেনেজুয়েলার বেড়েছে ৬৫ শতাংশ৷ মেক্সিকোয় পুলিশের ইমার্জেন্সি কলের সংখ্যা বেড়েছে ৫০ শতাংশ৷ আফ্রিকায় বেড়েছে মেয়েদের উপর নির্যাতন৷
প্রশ্ন হলো, কেন বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা? কেন এই সহিংসতা? মোহিত রণদীপের বক্তব্য, মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা তৈরি হওয়ার অনেক কারণ আছে৷ কিন্তু তার মধ্যে অন্যতম নিরাপত্তাহীনতা৷ কাজের নিরাপত্তা, খাদ্যের নিরাপত্তা, সুস্থ সমাজের নিরাপত্তা-- এই বিষয়গুলি যে কোনো মানুষের মনকে প্রভাবিত করে৷ করোনার সময় গোটা বিশ্ব জুড়ে দুইটি বিষয় নিয়ে মানুষ অত্যধিক রকমের উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন৷ এক বেঁচে থাকার অধিকার এবং দুই কাজের অধিকার৷
মোহিতের সঙ্গে একমত আরও অনেক মনস্তত্ত্ববিদ৷ তাঁদের বক্তব্য, গত একশ বছরে মানুষ বিশ্ব জোড়া মহামারি বা প্যানডেমিক দেখেনি৷ রোগ হলে তার প্রতিকার আছে, এই ধারণা মানুষের মনের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে৷ রোগ আছে, কিন্তু ওষুধ নেই এই ভাবনাটিই এক চরম নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে মানুষের মধ্যে৷ তার উপর লকডাউনের কারণে মানুষ কাজ হারাতে শুরু করেছেন৷ প্রথম বিশ্বে তাও কাজের নিরাপত্তা আছে৷ কিন্তু তৃতীয় বিশ্বে সেটুকুও নেই৷ ফলে মানুষ দিশাহীন হয়ে পড়েছে৷ কাজ হারানো মানুষ বুঝতে পারছেন না কীভাবে সংসার চলবে৷ যাঁদের কাজ আছে, তাঁরা বুঝতে পারছেন না আগামীকাল তা থাকবে কিনা৷ এই পুরো বিষয়টি মানুষের মনের উপর প্রভাব ফেলছে৷ মানুষ মানসিক ভাবে হিংস্র হয়ে উঠছে৷ একই সঙ্গে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। গত প্রায় পাঁচ মাসের তথ্য সে কথাই খাতায় কলমে স্পষ্ট করছে৷
আবার বলছি, অপরাধ আগে ছিল না এমন নয়৷ কিন্তু অপরাধের চরিত্র বদলেছে গত তিন-চার মাসে৷ বেড়েছে সংখ্যায়৷ যত দিন যাবে, নিরাপত্তাহীনতা যত বাড়বে সংখ্যাও বাড়তে থাকবে৷ এটাই মনুষ্য সমাজের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি৷