করোনা হেরে গেল অপরাধের কাছে
১১ সেপ্টেম্বর ২০২০সাধারণ মানুষ করোনার ভয়ে যতই মাস্ক পরে, সামাজিক দূরত্ব তৈরি করে ভয়ে ভয়ে বাস করুন না কেন, অপরাধীরা করোনার ভয় থেকে মুক্ত৷ না হলে করোনা আক্রান্ত নারীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তাঁকে ধর্ষণ করে অ্যাম্বুলেন্সের চালক? ঘটনাটি ঘটেছে কেরালায়৷ কয়েকদিন আগে৷
একটি অ্যাম্বুলেন্সে দুইজন করোনায় আক্রান্ত নারীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল৷ দুইজনকে আলাদা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল৷ প্রথমে বছর চল্লিশের করোনা আক্রান্ত নারীকে অ্যাম্বুলেন্স চালক হাসপাতালে নামিয়ে দেয়৷ তারপর ১৯ বছরের তরুণীকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় অ্যাম্বুলেন্স নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করে৷ তারপর তাঁকে হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়৷ সেই চালককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ৷
এটা তো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়৷ দিল্লিতে করোনা-কেন্দ্রের ভিতরে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করেছিল দুই যুবক৷ কিছুদিন আগে৷ সেই করোনা-কেন্দ্রে আরো রোগী ছিলেন৷ বাইরে নিরাপত্তারক্ষী ছিল৷ করোনা-কেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো৷ তা সত্ত্বেও বাথরুমের কাছে নিরালা জায়গা বেছে ধর্ষণ করে ওই দুই যুবক তাই করোনা নামক ভয়ংকর অতিমারীও হেরে যাচ্ছে এই অপরাধীদের কাছে৷ তারা ধরা পড়বে জানে, ধর্ষণের আইন এখন খুব কড়া, সে সবও তাদের অজানা নয়, তা সত্ত্বেও এই ধরনের অপরাধ করে যাচ্ছে৷ বস্তুত, করোনাকালে কোন অপরাধটাই বা কমেছে ভারতে?
খুনের কথাই ধরা যাক৷ উত্তর প্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে খুন লেগেই আছে৷ খুব কম সময়ের ব্যবধানে তিনজন সাংবাদিক খুন হয়েছেন৷ দিন দুয়েক আগেই বুলন্দশহর থেকে দিল্লি ফেরার পথে এক ট্যাক্সিচালক খুন হয়েছেন৷ পরিবারের অভিযোগ, ‘জয় শ্রীরাম’ না বলায় তাঁকে খুন করে দুই সওয়ারি৷ পুলিশ অবশ্য তা মানতে চায়নি৷ নিজের মেয়েকে বেচে দিয়েছেন এই গুজবের ভিত্তিতে মৈনপুরিতে একজন দলিতকে তাঁরই বাড়ির ছাদে পিটিয়ে মেরেছে পাঁচজন লোক৷ কুশীনগরে তো পুলিশের সামনেই খুনের দায়ে এক অভিযুক্তকে পিটিয়ে মারা হয়েছে৷ লকডাউন হওয়ার আগে গত জানুয়ারিতে উত্তর প্রদেশে একদিনে ১৩টা খুন হয়েছিল৷ দেখা যাচ্ছে, করোনার সময়েও যোগী আদিত্যনাথের রাজ্যে সেই চরিত্রের বদল হয়নি৷
রাজধানী দিল্লিই বা কম যায় কীসে? পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ১ জুন থেকে দিল্লিতে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫টি করে ছিনতাই হচ্ছে৷ দিন কয়েক আগের ঘটনা৷ মূলচন্দ থেকে নেহরু প্লেস আসার পথে অটোতে বসা এক বাঙালি মেয়ের হাত থেকে ব্যাগ টান মারে এক বাইক আরোহী৷ মেয়েটিও পাল্টা টান দেয়, তখন তাঁর হাত চেপে ধরে দুষ্কৃতী৷ ভয়ে মেয়েটি ব্যাগ ছেড়ে দেয়৷ এটিএমে গিয়ে পিন বদলে ১৫ হাজার টাকা তুলে নেয় দুষ্কৃতীরা৷ রাস্তায় চলার সময় মোবাইল, গলার হার ছিনতাই তো নিত্যদিনের ঘটনা৷ সেই সঙ্গে গাড়ি চুরি, ডাকাতি, হত্যা, মহিলা নির্যাতন সহ সব ধরনের অপরাধেরই বাড়বাড়ন্ত৷
কেন এই অবস্থা? দিল্লি পুলিশের একটা ব্যাখ্যা হলো, করোনার পর জেলগুলিকে খালি করার দরকার হয়৷ কারণ, রাজধানীর জেলে উপচে পড়া ভিড় ছিল৷ সেখানে সামাজিক দূরত্ব মানার জন্য যে সব অপরাধীর সাত বছরের কম হাজতবাসের সাজা ছিল, তাদের অনেককেই প্যারোলে ছেড়ে দেয়া হয়েছে৷ ছাড়া পেয়ে তারা আবার অপরাধ করতে শুরু করেছে৷ আইজি জেল রাজ কুমার সম্প্রতি ইন্ডিয়া টুডে-কে জানিয়েছেন, ‘‘দিল্লির জেল থেকে চার হাজার ৩০০ জনকে ছাড়া হয়েছিল৷ তারপর আবার ৫০ জনকে বিভিন্ন অপরাধের কারণে ধরা হয়েছে৷’’
লকডাউনের ফলে প্রচুর লোকের চাকরি গেছে৷ ব্যবসা মার খেয়েছে৷ আনলকের পর সব খুলেছে ঠিকই, কিন্তু চাকরি, ব্যবসা কিছুই আর আগের মতো নেই। তাই চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি এ সব বাড়বে তা জানা কথা৷ তা সত্ত্বেও করোনার বাজারে অপরাধের সংখ্যা মাত্রাছাড়া ভাবে বেড়েছে৷ ১ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত দিল্লিতে ৪৭১টা ছিনতাই হয়েছে৷ জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২২৬টা খুন, ২৩৬টা খুনের চেষ্টা, প্রায় ৫৭ হাজার চুরি, ৭০০ ডাকাতি এবং ১৩ হাজারেরও বেশি গাড়ি চুরি হয়েছে৷
পিছিয়ে নেই পশ্চিমবঙ্গও৷ সেখানে আবার রাজনৈতিক খুন লেগেই আছে৷ বিজেপি-র অভিযোগ, তাদের হেমতাবাদের বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ রায়কে খুন করে গাছে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে৷ অবশ্য এটাকে আত্মহত্যা বলেছে৷ আরও কিছু বিজেপি নেতা ও কর্মীকে খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ৷ করোনাকালেও নিয়মিত তৃণমূল বনাম বিজেপি কর্মীদের লড়াই হয়েছে৷ সব মিলিয়ে অপরাধের হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থাও খারাপ৷
জাতীয় মহিলা কমিশনের তথ্য বলছে, ২৩ মার্চ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ লকডাউনের প্রথম পর্যায়ে তারা নারী নির্যাতনের ৫৮৭টি অভিযোগ পেয়েছে৷ তার মধ্যে ২৩৯টি গার্হস্থ হিংসার৷ করোনা কেটে গেলে যখন পুরো হিসাব আসবে, তখন বোঝা যাবে, গার্হস্থ হিংসার প্রকৃত ছবি৷
ফলে করোনাকালে অপরাধের বাড়বাড়ন্ত ভারতে৷ কোনো অপরাধই কমেনি৷ বরং তা বাড়ছে৷