কপ২৯: পাঁচ প্রশ্ন, ১০ চার্টে জলবায়ু পরিবর্তন
১৪ নভেম্বর ২০২৪জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ ও প্রভাব মোকাবেলায় বিশ্ব নেতারা ২৯তম বারের মতো বৈঠকে বসেছেন৷ এই পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তরে বোঝা যাবে আমাদের গ্রহ এরইমধ্যে কতটা পরিবর্তিত হয়েছে৷
১. সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমন করে কারা?
আগামী ১০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে অর্থনীতিকে কার্বন নিরপেক্ষ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে বিভিন্ন দেশের সরকার৷ ইউরোপ এবং অ্যামেরিকার দেশগুলোতে কার্বন নির্গমন স্থিতিশীল হচ্ছে, তবে এশিয়া এবং আফ্রিকায় বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ওপর কতটা জোর দেয়া উচিত, সেটা বোঝা যাবে নীচের চার্টটি থেকে৷
শুধু কার্বন নির্গমনের কথা বললে অবশ্য পুরো চিত্র পাওয়া যাবে না৷ এশিয়ার দেশগুলোতে গত কয়েক দশকে বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে৷ আরও বেশি সংখ্যক মানুষ গ্রহের সম্পদ ব্যবহার করছেন৷
ফলে মাথাপিছু কার্বন ব্যবহারের বিবেচনায় চিত্রটি একেবারেই ভিন্ন৷ জনসংখ্যার আকার তুলনা করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি রাশিয়া, সৌদি আরব, ওমান, কাতার এবং মঙ্গোলিয়ার মতো দেশগুলোও আলোচনায় আসবে৷
কার্বন নির্গমন কমাতে সবচেয়ে বেশি অবদান কাদের রাখা উচিত? এই বিতর্কে বিশেষজ্ঞরা যুক্তি দেন যে, সব দেশকে এজন্য সমানভাবে দায়ী করা যায় না এবং এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক শক্তি এবং সম্পদকেও বিবেচনায় নেয়া উচিত৷
আয় বিবেচনায় নিলে দেখা যায় (নীচের চার্ট দেখুন) উচ্চ আয় এবং মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের মধ্যে একটি সম্পর্ক রয়েছে৷ এই চার্ট থেকে বোঝা যায়, একই মহাদেশের ভিন্ন ভিন্ন দেশের মধ্যেও কতটা পার্থক্য রয়েছে এবং দেশের আর্থিক পরিস্থিতির ওপর কার্বন নির্গমন কতটা নির্ভর করে৷ আবার একই আয়ের সীমায় থেকেও ভিন্ন ভিন্ন দেশের কার্বন নির্গমন কম বেশি হতে পারে৷
যেমন জনসংখ্যা অনেক কম হলেও মাথাপিছু হিসাবে সর্বোচ্চ কার্বন নির্গমনের দেশ কাতার একটি উচ্চ মাথাপিছু আয়েরও দেশ৷ কিন্তু একই আয়ের সীমায় থাকলেও ইউরোপেরজার্মানি এবং ফ্রান্সের মতো দেশগুলোর তুলনায় কাতারের মাথাপিছু কার্বন নির্গমন অনেক বেশি৷
অন্যদিকে, ভারত এবং চীনের মতো দেশগুলো মাথাপিছু নির্গমনের ক্ষেত্রে নীচের দিকে থাকলেও, বিশাল জনসংখ্যার বিবেচনায় তাদের মোট নির্গমন অনেক বেশি হয়৷ ফলে তাদের সিদ্ধান্তও গ্রহের ওপর বড় প্রভাব ফেলে৷
২. গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রধান উৎস কী?
প্রায় ২৮ শতাংশ কার্বন নির্গমন করায় বিদ্যুৎখাতই এখন গ্রিনহাউস গ্যাসের সবচেয়ে বড় উৎস৷
আগেই বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক শক্তি এবং কার্বন নির্গমনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে৷ সেই পরিপ্রেক্ষিতে বায়ুমণ্ডলে নির্গত মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড সহ সামগ্রিক গ্রিনহাউস গ্যাসের বড় আরেকটি উৎস (২২ শতাংশ) শিল্পখাত৷
১৬ শতাংশ কার্বন নির্গমনের কারণে তৃতীয় স্থানে রয়েছে পরিবহন, ১২ শতাংশের জন্য দায়ী কৃষি রয়েছে চতুর্থ স্থানে এবং মোট নির্গমনের ১১ শতাংশের জন্য দায়ী জ্বালানি রয়েছে পঞ্চম স্থানে৷
গত দুই দশক ধরে, গাছ হারানোর বার্ষিক হার ক্রমাগত বেড়ে চলেছে৷ ২০২৩ সালে রাশিয়া, ব্রাজিল এবং ক্যানাডা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বন উজাড়কারী দেশ৷ ২০২৩ সালে ব্যাপক দাবানলে ক্যানাডায় বনের বড় অংশ ধ্বংস হয়েছে৷
বন উজাড় হওয়ার ফলে মাটি এবং গাছে সঞ্চিত কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে৷ পাশাপাশি বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন শুষে নিয়ে উষ্ণতা কমাতে বন যে ভূমিকা রাখতো, সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বনের আকার কমে যাওয়ার ফলে৷
৩. গত শতাব্দীগুলোতে কীভাবে কার্বন নির্গমন বেড়েছে?
শিল্পায়নের শুরু থেকেই জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে কার্বন নির্গমন বেড়েছে৷ মানুষ উচ্চমাত্রার কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করায় পৃথিবী প্রাকৃতিক ‘কার্বন শোষক' যেমন বন এবং মহাসাগরে কার্বন জমা করেছে৷
কিন্তু একসময় এমন একটি পর্যায়ে আমরা পৌঁছেছি, যখন গ্রহের প্রাকৃতিকভাবে শোষণ করতে পারার ক্ষমতার চেয়ে বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস মানুষ তৈরি করতে শুরু করেছে৷ এই নির্গমনগুলির বেশিরভাগ আটকে পড়ছে বায়ুমণ্ডলেই (নীচের চার্ট দেখুন)৷
৪. পৃথিবী এখন পর্যন্ত কতটা উষ্ণ হয়েছে?
বায়ুমণ্ডলে বাড়তে থাকা কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর কণা আরো বেশি সূর্যালোকের উষ্ণতা আটকে রাখছে৷ এর ফলে বায়ুমণ্ডল একটি গ্রিনহাউসের মতো কাজ করছে, গ্রহের তাপমাত্রা ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে৷ ২০ শতকের তুলনায় - এবং বিশেষ করে গত পাঁচ বছরের মধ্যে - গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা এক দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে৷
নির্দিষ্ট সময় এবং স্থানে পর্যবেক্ষণ করা তাপমাত্রা এবং সেই একই স্থানের ঐতিহাসিক গড় তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য গণনা করে তাপমাত্রার পরিবর্তন পরিমাপ করা হয়৷ বিভিন্ন স্থান থেকে তাপমাত্রা পরিবর্তনের এমন হিসাবের গড় করে বৈশ্বিক তাপমাত্রার পরিবর্তন নির্ণয় করা হয়৷ স্থানীয় পর্যায়ে বা আলাদা আলাদা মাসে তাপমাত্রার পার্থক্যও অনেক বেশি হতে পারে৷ উদাহরণস্বরূপ, ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরের তুলনায় ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর প্রায় দুই ডিগ্রি উষ্ণ ছিল৷
এই ধরনের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রায় অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে এবং বিস্তৃত প্রভাব ফেলছে৷ তীব্র তাপদাহ, ফসলে বিপর্যয়, খরা, ঝড় এবং বন্যার মতো বিধ্বংসী চরম আবহাওয়ার ঘটনা বাড়ছে৷ তাপমাত্রা বৃদ্ধির সবচেয়ে লক্ষণীয় প্রভাবগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে হিমবাহ গলে যাওয়া এবং মহাসাগরে পানির মোট পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি৷
৫. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এখন কোন পর্যায়ে আছে?
অস্ট্রেলিয়ার সরকারি বৈজ্ঞানিক গবেষণা সংস্থা কমনওয়েলথ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ অর্গানাইজেশন- সিএসআইআরও এর সংগৃহীত তথ্য অনুসারে, গত ১৪০ বছরে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার বা নয় দশমিক আট ইঞ্চি বেড়েছে৷ এই বৃদ্ধির প্রায় এক তৃতীয়াংশ ঘটেছে কেবল গত ২৫ বছরেই৷
বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু আর্কটিক অঞ্চল পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দ্রুত উত্তপ্ত হচ্ছে৷
জলের তাপীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, গরম হলে তা প্রসারিত হয়৷ এর ফলেও সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে৷
বিশ্বের বেশিরভাগ মহাসাগর এবং সাগরের বর্তমান উচ্চতাই তাদের ঐতিহাসিক উচ্চতার চেয়ে বেশি৷ তবে কিছু অঞ্চল অন্য অঞ্চলগুলোর তুলনায় বেশি প্রভাবিত হচ্ছে৷
উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম ক্যানাডা এবং উত্তর চিলিতে সমুদ্রের উচ্চতা স্থিতিশীল রয়েছে, অনেকক্ষেত্রে আগের তুলনায় কমেছে৷ অন্যদিকে, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরের দ্বীপ দেশগুলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে৷ কোনো কোনো দ্বীপের অস্তিত্ব বিলীন হওয়ার হুমকিতে রয়েছে৷
জিয়ান্না-কারিনা গ্র্যুন, রদ্রিগো মেনেগাত শুইনস্কি/এডিকে