1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

এখনো তাদের অপেক্ষায় দিন গুনছেন স্বজনরা

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৯ আগস্ট ২০২২

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই- এই সাত মাসে দুটি গুম বা নিখোঁজের ঘটনা নজরে এসেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর৷

https://p.dw.com/p/4FmWe
ছবি: Md. Rakibul Hasan/ZUMA Press Wire/picture alliance

তবে গত ১৫ বছরে তাদের কাছে এমন ৬১৪ জনের নিখোঁজের তথ্য আছে, যাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়৷

গত বছরের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত তাদের মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে৷ গ্রেপ্তার দেখানো হয়ে ৯৪ জনকে৷ ফেরত এসেছেন ৫৭ জন৷ বাকিদের এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি৷ আসকের সাধারণ সম্পাদক, মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘যারা ফেরত এসেছেন, তারা ট্রমায় ভুগছেন৷ তারা কোনো কথা বলতে চান না, অনেকটা ভীতসন্তস্ত্র অবস্থায় আছেন৷’’

তিনি বলেন, ‘‘নিখোঁজদের পরিবারের সঙ্গে আমরা কথা বলে জেনেছি, তাদের অনেককেই আইন-শঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়৷ আর তাদের চেহারার যে বর্ননা দেয়া হয়েছে তাতে তাদের প্রশিক্ষিত বলেই মনে হয়েছে৷’’

২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বিএনপি নেতা সাজিদুল ইসলাম শিমুলকে বসুন্ধরা এলাকায় তার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে নিয়ে যায় অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তিরা৷ তার বোন সানজিদা ইসলাম আঁখি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার ভাইকে তো র‌্যাব নিয়ে গেছে৷ তার সঙ্গে আরো পাঁচ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়৷’’

যারা ফেরত এসেছেন, তারা ট্রমায় ভুগছেন: নূর খান

তিনি বলেন, ‘‘কোনো মামলা নেয়নি থানা৷ তারা র‌্যাবের নাম বাদ দিয়ে নিখোঁজের মামলা করতে বলে৷ আমরা আদালতেও গিয়েছিলাম, কিন্তু কোনো ফল পাইনি৷ আমরা যত জায়গার যাওয়ার গিয়েছি, কিন্তু আমার ভাইকে পাইনি৷’’

‘‘তবে গত জানুয়ারি মাসের দিকে পুলিশ আমার শাহীনবাগের বাসায় এসেছিল৷ আমার কাছ থেকে পুলিশ তাদের লেখা কাগজে স্বাক্ষর নিতে চেয়েছিল৷ আমি দেইনি৷ তবে অনেকের পরিবারের কাছ থেকে নিয়েছে৷ আমরা পরে সংবাদ সম্মেলন করে এটা জনিয়েছি,’’ দাবি করেন তিনি৷

ঢাকা সফররত জাতি সংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল বাচেলেটের কাছেও তার পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে৷ সেখানে নূর খানও ছিলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘গুম হওয়াদের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের মামলা করতেও দেয়া হয়নি৷ তারা এরজন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেই দায়ী করেছেন৷’’

২০১৩ সালে গুম হন সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সভাপতি মাহবুব হাসান সুজন৷ তাকে এবং আরেকজন ছাত্রদল নেতা কাজী ফরহাদকে তুলে নেয়া হয় সোনারগাঁ এলাকার একটি বাড়ি থেকে৷ ওখানে তারা বেড়াতে গিয়েছিলেন৷ তার ভাই, সবুজ বাগের বসিন্দা জাহিদ হাসান খান বলেন, ‘‘গত জানুয়ারি মাসে আমাকে এবং ফরহাদের বোন ও ভগ্নিপতিকে সবুজবাগ থানায় ডেকে নেয়া হয়৷ সেখানে ফরহাদের বোনকে পুলিশের একটি কাগজে লেখা হুবহু আরেকটি কাগজে লিখেতে বাধ্য করে স্বাক্ষর নেয়া হয়৷ তাতে মূল কথা ছিল ফরহাদ নিজেই আত্মগোপন করেছে৷’’

আমার ভাইকে ব়্যাব নিয়ে গেছে: সানজিদা ইসলাম আঁখি

তিনি বলেন, ‘‘আমাকেও প্রথমে সই করতে বলা হয়েছিল৷ তবে আমার বাবা যেহেতু নিখোঁজ মামলার বাদি, তাই আমাদের বাসায় গিয়ে বাবাকে জোর করা হয়৷ কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষর করেননি৷’’
জাহিদ বলেন, ‘‘আমার ভাইকে যারা নিয়ে গেছে, তাদের হাতে লং আর্মস ছিল৷ কিন্তু আমাদের অনেক দিন ঘুরিয়ে একটি সাধারণ নিখোঁজের মামলা নেয়া হয়৷’’

তার কথা, ‘‘এখন শুনতে পাচ্ছি, অনেক বাড়িতে তাদের আটকে রাখা হয়েছে৷ আমার ভাই বেঁচে থাকলে তাকে ফেরত চাই৷ আর না হলে অন্তত লাশটি দেখতে চাই৷’’

ধামনন্ডির তরুণ ইশরাক আহমেদ ফাহিম ক্যানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র৷ ঢাকায় এসে ২০১৬ সালের ২৬ আগষ্ট রাতে ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে অপহৃত হন৷ তার বাবা জামালউদ্দিন আহমে বলেন, ‘‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজে সব কিছুই পাওয়া গেছে৷ তারপরও আমার ছেলেকে পাওয়া যায়নি৷ আমি আর মামলা করিনি৷ এই দেশে মামলা করে কী হবে!’’

তিনি বলেন, ‘‘আমার ছেলে কেন, আমার পরিকারের কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন৷’’

মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘যদি কেউ নিজেও আত্মগোপন করে থাকেন, তাকেও খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের৷ এই নিখোঁজ ও গুম হওয়া মানুষগুলো কোথায়, তা সরকারকেই জানাতে হবে৷ নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের৷’’

নূর খান বলেন, ‘‘এখন আমরা নানা ধরনের গুম ঘরের কথা শুনতে পাচ্ছি৷ শুনতে পাচ্ছি, আয়না ঘরের কথা৷ কোনো এলাকার মানুষ বলছে, এটা গুম ঘর ছিল তাহলে এই বিষয়গুলো তো সরকারকে দেখতে হবে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘সরকার যা করছে তা হলো, যাদের কাছ থেকে জোর করে সই নিয়েছে সেগুলো ব্যবহারের চেষ্টা করছে৷ যারা ফিরে এসেছে, তারা গুম হয়নি বলে তথ্য উপস্থাপন করছে৷ যেমন, গুম হওয়া হাসিনুর ফিরে এসেছে৷ সরকার বলেছে সে গুম হয়নি৷ কিন্তু সে তো বলছে তাকে গুম করা হয়েছিল৷ পরিবারের সদস্যরাও জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানকে এসব তথ্য দিয়েছেন৷’’

তার কথা, ‘‘এসব করতে গিয়ে এখন সরকার তালগোল পাকিয়ে ফেলছে৷ শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছে৷ কিন্তু আমার কথা হলো, এতে পরিস্থিতি আরো জটিল হবে৷ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর গুমের ঘটনা অনেক কমে গেছে৷ কিন্তু তাতে কি আগের ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেয়া যাবে?’’

আইসিটি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ২০১৬ সালের মার্চ মাসে৷ তাকে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়৷ সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার মুখে দুই সপ্তাহ পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন আর আমি এই বিষয়গুল নিয়ে কথা বলতে চাই না৷ যা হয়েছে, হয়েছে৷ এখন আমি ভালো আছি৷ তবে আমি স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হইনি৷ আমাকে অস্ত্রের মুখে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷’’

ঢাকা সফররত জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল বাচেলেট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ কথা বলেছেন সুশীল সমাজ ও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে৷ তিনি নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর ছেলের সঙ্গেও কথা বলেছেন৷

বুধবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘‘গুম, বিচারবহির্র্ভূত হত্যাকাণ্ড ও পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত চায় জাতিসংঘ৷’’ একই সঙ্গে তিনি পুলিশকে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দেয়ার কথাও বলেন৷

নূর খান এবং অধ্যাপক মিজানুর রহমান মনে করেন, ‘‘সরকারের উচিত হবে একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে এসব গুমের তদন্ত করা৷ তা না হলে জাতিসংঘের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না৷’’