এখনো তাদের অপেক্ষায় দিন গুনছেন স্বজনরা
১৯ আগস্ট ২০২২তবে গত ১৫ বছরে তাদের কাছে এমন ৬১৪ জনের নিখোঁজের তথ্য আছে, যাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়৷
গত বছরের ২৫ আগস্ট পর্যন্ত তাদের মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে৷ গ্রেপ্তার দেখানো হয়ে ৯৪ জনকে৷ ফেরত এসেছেন ৫৭ জন৷ বাকিদের এখনো কোনো খোঁজ মেলেনি৷ আসকের সাধারণ সম্পাদক, মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘যারা ফেরত এসেছেন, তারা ট্রমায় ভুগছেন৷ তারা কোনো কথা বলতে চান না, অনেকটা ভীতসন্তস্ত্র অবস্থায় আছেন৷’’
তিনি বলেন, ‘‘নিখোঁজদের পরিবারের সঙ্গে আমরা কথা বলে জেনেছি, তাদের অনেককেই আইন-শঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়৷ আর তাদের চেহারার যে বর্ননা দেয়া হয়েছে তাতে তাদের প্রশিক্ষিত বলেই মনে হয়েছে৷’’
২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বিএনপি নেতা সাজিদুল ইসলাম শিমুলকে বসুন্ধরা এলাকায় তার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে নিয়ে যায় অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তিরা৷ তার বোন সানজিদা ইসলাম আঁখি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার ভাইকে তো র্যাব নিয়ে গেছে৷ তার সঙ্গে আরো পাঁচ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়৷’’
তিনি বলেন, ‘‘কোনো মামলা নেয়নি থানা৷ তারা র্যাবের নাম বাদ দিয়ে নিখোঁজের মামলা করতে বলে৷ আমরা আদালতেও গিয়েছিলাম, কিন্তু কোনো ফল পাইনি৷ আমরা যত জায়গার যাওয়ার গিয়েছি, কিন্তু আমার ভাইকে পাইনি৷’’
‘‘তবে গত জানুয়ারি মাসের দিকে পুলিশ আমার শাহীনবাগের বাসায় এসেছিল৷ আমার কাছ থেকে পুলিশ তাদের লেখা কাগজে স্বাক্ষর নিতে চেয়েছিল৷ আমি দেইনি৷ তবে অনেকের পরিবারের কাছ থেকে নিয়েছে৷ আমরা পরে সংবাদ সম্মেলন করে এটা জনিয়েছি,’’ দাবি করেন তিনি৷
ঢাকা সফররত জাতি সংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল বাচেলেটের কাছেও তার পরিবারের পক্ষ থেকে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে৷ সেখানে নূর খানও ছিলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘গুম হওয়াদের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের মামলা করতেও দেয়া হয়নি৷ তারা এরজন্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেই দায়ী করেছেন৷’’
২০১৩ সালে গুম হন সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সভাপতি মাহবুব হাসান সুজন৷ তাকে এবং আরেকজন ছাত্রদল নেতা কাজী ফরহাদকে তুলে নেয়া হয় সোনারগাঁ এলাকার একটি বাড়ি থেকে৷ ওখানে তারা বেড়াতে গিয়েছিলেন৷ তার ভাই, সবুজ বাগের বসিন্দা জাহিদ হাসান খান বলেন, ‘‘গত জানুয়ারি মাসে আমাকে এবং ফরহাদের বোন ও ভগ্নিপতিকে সবুজবাগ থানায় ডেকে নেয়া হয়৷ সেখানে ফরহাদের বোনকে পুলিশের একটি কাগজে লেখা হুবহু আরেকটি কাগজে লিখেতে বাধ্য করে স্বাক্ষর নেয়া হয়৷ তাতে মূল কথা ছিল ফরহাদ নিজেই আত্মগোপন করেছে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমাকেও প্রথমে সই করতে বলা হয়েছিল৷ তবে আমার বাবা যেহেতু নিখোঁজ মামলার বাদি, তাই আমাদের বাসায় গিয়ে বাবাকে জোর করা হয়৷ কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষর করেননি৷’’
জাহিদ বলেন, ‘‘আমার ভাইকে যারা নিয়ে গেছে, তাদের হাতে লং আর্মস ছিল৷ কিন্তু আমাদের অনেক দিন ঘুরিয়ে একটি সাধারণ নিখোঁজের মামলা নেয়া হয়৷’’
তার কথা, ‘‘এখন শুনতে পাচ্ছি, অনেক বাড়িতে তাদের আটকে রাখা হয়েছে৷ আমার ভাই বেঁচে থাকলে তাকে ফেরত চাই৷ আর না হলে অন্তত লাশটি দেখতে চাই৷’’
ধামনন্ডির তরুণ ইশরাক আহমেদ ফাহিম ক্যানাডার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র৷ ঢাকায় এসে ২০১৬ সালের ২৬ আগষ্ট রাতে ধানমন্ডির স্টার কাবাবের সামনে থেকে অপহৃত হন৷ তার বাবা জামালউদ্দিন আহমে বলেন, ‘‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজে সব কিছুই পাওয়া গেছে৷ তারপরও আমার ছেলেকে পাওয়া যায়নি৷ আমি আর মামলা করিনি৷ এই দেশে মামলা করে কী হবে!’’
তিনি বলেন, ‘‘আমার ছেলে কেন, আমার পরিকারের কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন৷’’
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘‘যদি কেউ নিজেও আত্মগোপন করে থাকেন, তাকেও খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের৷ এই নিখোঁজ ও গুম হওয়া মানুষগুলো কোথায়, তা সরকারকেই জানাতে হবে৷ নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের৷’’
নূর খান বলেন, ‘‘এখন আমরা নানা ধরনের গুম ঘরের কথা শুনতে পাচ্ছি৷ শুনতে পাচ্ছি, আয়না ঘরের কথা৷ কোনো এলাকার মানুষ বলছে, এটা গুম ঘর ছিল তাহলে এই বিষয়গুলো তো সরকারকে দেখতে হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘সরকার যা করছে তা হলো, যাদের কাছ থেকে জোর করে সই নিয়েছে সেগুলো ব্যবহারের চেষ্টা করছে৷ যারা ফিরে এসেছে, তারা গুম হয়নি বলে তথ্য উপস্থাপন করছে৷ যেমন, গুম হওয়া হাসিনুর ফিরে এসেছে৷ সরকার বলেছে সে গুম হয়নি৷ কিন্তু সে তো বলছে তাকে গুম করা হয়েছিল৷ পরিবারের সদস্যরাও জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানকে এসব তথ্য দিয়েছেন৷’’
তার কথা, ‘‘এসব করতে গিয়ে এখন সরকার তালগোল পাকিয়ে ফেলছে৷ শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে চাইছে৷ কিন্তু আমার কথা হলো, এতে পরিস্থিতি আরো জটিল হবে৷ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর গুমের ঘটনা অনেক কমে গেছে৷ কিন্তু তাতে কি আগের ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেয়া যাবে?’’
আইসিটি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ২০১৬ সালের মার্চ মাসে৷ তাকে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়৷ সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার মুখে দুই সপ্তাহ পর তাকে ছেড়ে দেয়া হয়৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন আর আমি এই বিষয়গুল নিয়ে কথা বলতে চাই না৷ যা হয়েছে, হয়েছে৷ এখন আমি ভালো আছি৷ তবে আমি স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হইনি৷ আমাকে অস্ত্রের মুখে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷’’
ঢাকা সফররত জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল বাচেলেট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন৷ কথা বলেছেন সুশীল সমাজ ও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে৷ তিনি নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর ছেলের সঙ্গেও কথা বলেছেন৷
বুধবার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘‘গুম, বিচারবহির্র্ভূত হত্যাকাণ্ড ও পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত চায় জাতিসংঘ৷’’ একই সঙ্গে তিনি পুলিশকে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দেয়ার কথাও বলেন৷
নূর খান এবং অধ্যাপক মিজানুর রহমান মনে করেন, ‘‘সরকারের উচিত হবে একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে এসব গুমের তদন্ত করা৷ তা না হলে জাতিসংঘের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না৷’’