গুমের শিকারদের পরিবারকে হয়রানির অভিযোগ, পুলিশের অস্বীকার
১৫ মার্চ ২০২২জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের অফিসিয়াল ওয়েব সাইটে প্রকাশ করা এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা এ দাবি জানান৷ বিবৃতিতে বলা হয়, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের কর্মীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ হুমকি, চাপ প্রয়োগ ও হয়রানি শুরু করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে৷
বিবৃতিতে দাবি করা হয়, গুমের শিকার ১০ জনের পরিবারের সদস্য ও স্বজনের বাড়িতে গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে গভীর রাতে অভিযান চালানো হয়৷ অভিযানের সময় তাদের পরিবারের সদস্যদের হুমকি ও ভয় দেখানো হয়৷ সাদা কাগজে বা আগে থেকেই লিখে রাখা বক্তব্যে তাদের সই করতে বাধ্য করা হয়৷ সেই বক্তব্যে উল্লেখ করা ছিল যে, পরিবারের সদস্য গুমের শিকার হননি, বরং তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পুলিশকে বিভ্রান্ত করেছেন৷
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অরো বলা হয়, বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে বেশির ভাগ গুমের ঘটনার সঙ্গে র্যাবের জড়িত থাকার বিষয়ে খবর প্রকাশ হয়েছে, যা জাতিসংঘের গুম বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিবেদনে এসেছে৷ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বাংলাদেশ এসব গুরুতর অভিযোগের ব্যাপারে সঠিক অনুসন্ধান এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য দায়বদ্ধ৷ র্যাবসহ অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থাকে তদন্ত ও ফৌজদারি দায় থেকে রেহাই দেয়া উচিত নয় বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়৷
আসকের বিবৃতি
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-ও গত জানুয়ারি মাসে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিল৷ সেখানে তারাও একই ধরনের অভিযোগ করেছিল৷ তারা বিবৃতিতে বলেছিল, ‘‘বিভিন্ন সূত্র থেকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানতে পেরেছে যে, বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গত কিছুদিন ধরে নানাভাবে যোগাযোগ করছেন এবং নানা ধরনের প্রশ্ন বা তথ্য জানতে চাওয়ার মাধ্যমে তাদের হয়রানি করছেন৷ একই সঙ্গে পরিবারগুলোর কাছ থেকে জোর করে লিখিত কাগজে সই নেয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে, যেখানে লেখা রয়েছে যে, ওই ব্যক্তি গুমের শিকার হননি, তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন৷’’
আসকের সাধারণ সম্পাদক ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, পুলিশের এই ধরনের তৎপরতা এখনো অব্যাহত আছে৷ তিনি বলেন, ‘‘হয়ত পুলিশ চাইছে তাদের মতো করে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দিতে ৷ এতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছে৷’’
তিনি দাবি করেন, ২০১৩ সাল থেকে কমপক্ষে ৬০০ জন গুমের শিকার হয়েছেন৷ এর মধ্যে ২০০ জনের এখনো কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি৷ বাকিরা কেউ ফিরে এসেছেন, কাউকে আটক দেখানো হয়েছে৷ আবার কারো লাশ পাওয়া গেছে৷
দুই পরিবারের কথা
গুমের শিকার এরকম দুইজনের পরিবারের সঙ্গে মঙ্গলবার কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ ২০১৩ সালের ৭ ডিসেম্বর ঢাকার অদূরে সোনারগাঁ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন ঢাকার সবুজবাগ থানা ছাত্রদলের সে সময়ের সভাপতি মাহবুব হাসান সুজন৷ তার কোনো খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি৷ তার বাবা আবদুল জলিল মঙ্গলবার বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর একদিন রাতে পুলিশ আমাদের বাসায় আসে৷ তারা তাদের লেখা একটি কাগজে আমাকে সই করতে বলেছিল, কিন্তু আমি করিনি৷’’
সেই কাগজে কী লেখা ছিল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের কাগজে লেখা ছিল আমরা পুলিশকে বিভ্রান্ত করছি৷ আমরা কোনো মামলা বা জিডি করিনি৷ আসলে আমরা জিডি করেছি সোনারগাঁ থানায়৷ সবুজবাগ থানা তখন আমাদের জিডি নেয়নি৷’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘এরপর অবশ্য পুলিশ আমাদের সাথে আর যোগাযোগ করেনি৷ তবে আমরা এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছি৷’’
২০১৩ সালের ১১ ডিসেম্বর মধ্যরাতে নিখোঁজ আরেকজন হলেন ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার তখনকার ছাত্রদল নেতা মো. সেলিম রেজা পিন্টু৷ তার বোন রেহানা বানু মুন্নি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর পুলিশ আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছে৷ আমরা আদালতে মামলা করেছিলাম৷ আদালত পুলিশকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে৷ পুলিশ জানতে চেয়েছে পিন্টুর কোনো খোঁজ আছে কিনা৷ আমরা জানিয়েছি, না, এখনো কোনো খোঁজ নেই৷ থানা থেকে পাঠানো একটি কাগজে আমরা তার খোঁজ না পাওয়ার কথা লিখে দিয়েছি৷’’
পুলিশ কোনো ভয় দেখিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘না, পুলিশ কোনো ভয়-ভীতি আমাদের দেখায়নি৷ তবে একটি প্রশ্ন করেছে যে, পিন্টু বাসায় আসে কিনা৷ গত পরশু দিনও পুলিশ খোঁজ নিয়েছে৷’’
পুলিশ সদর দপ্তর যা বলছে
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরেরর এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান বলেন,‘‘গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের কখনোই বাংলাদেশ পুলিশ কোনো ধরনের হয়রানি করেনি৷ পুলিশ যদি তাদের পরিবারে গিয়ে থাকে, সেটা তদন্তের স্বার্থে, যৌক্তিক কারণে, সময়ের প্রয়োজনেই গিয়েছে৷ ভয়-ভীতি দেখানোর কোনো কারণ নেই, এ ধরনের কোনো ঘটনাও আমার জানা মতে ঘটেনি৷’’
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা কোনো তদন্তের কাজে গেলে সেখানে সই নেয়ার প্রয়োজন পড়তে পারে৷ সেটা কেউ ইচ্ছুক না হলে জোর করে বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে নয়৷ এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটার কারণ নেই এবং আমার জানা মতে ঘটেনি৷’’