‘‘নো মোর ব্লা ব্লা ব্লা, নো মোর এক্সপ্লয়টেশন অফ পিপল’’- বার্লিনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে গ্রেটা থুনবার্গের এই উক্তি গত বছর গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনের আগে বেশ আলোড়ন তুলেছিল৷ বিশ্বের শীর্ষ নেতাদের উদ্দেশ্যে করা এই উক্তির সাধারণ অর্থ করলে দাঁড়ায়, ‘আর কত বোকা বানাবেন?’৷ এই বোকা বানানোর রাজনীতির শুরু কি আজ থেকে? সেই সত্তরের দশকে শুরু৷ তখন প্রথম ‘জলবায়ু পরিবর্তন’ বিষয়টি বিজ্ঞানীদের কোল থেকে রাজনীতিকদের ঘাড়ে এসে পড়ে৷
কতিপয় রাজনীতিক একে খুব জরুরি বলে ভাবলেও অনেকের অবস্থা ‘হেসে বাঁচি নে’-র মতো৷ বিজ্ঞানীরা যতই বলেন, আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াচ্ছি, ক্ষতিকর গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হচ্ছে, ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, এর ফলে বাড়ছে দুর্যোগ, সামনে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে- অনেক রাজনীতিক এসব মানা তো দূরের কথা, এ নিয়ে কথাই বলতে রাজি ছিলেন না৷ এ অবস্থায় প্রথম জলবায়ু সম্মেলন হয় ১৯৭৯ সালে৷ রাজনৈতিক এজেন্ডায় জলবায়ুর বিষয়টি থাকবে, এসব সিদ্ধান্ত একপ্রকার অনেক ‘অনিচ্ছুক’ সরকারের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়৷ অবশ্য এই অনিচ্ছুকতার পেছনে বড় বড় শিল্পগুলোর প্রভাবই বেশি৷ জলবায়ু পরিবর্তন বলতে কিছু নেই, এখানে মানুষের কোনো অবদান নেই, প্রকৃতিতে যা হচ্ছে তা প্রাকৃতিক নিয়মেই হচ্ছে কিংবা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি কেবলই গল্প- এসব প্রচারণায় মুখর মহল আজও সক্রিয়৷ এদের পেছনে জ্বালানি কোম্পানির অর্থ যেমন ছিল, তেমনি ছিল পরিবহণখাতের মতো বড় শিল্পগুলোর লবিং, এবং তা আজও আছে৷
সে যা-ই হোক, ১৯৯২ সালে এসে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি বা ইউএনএফসিসিসি তৈরি করা হয়৷ এতে সই করে ১৫৪টি দেশ৷ জার্মানির বন শহরে এই চুক্তি বাস্তবায়ন সংক্রান্ত দপ্তর বসানো হয়৷
তখন পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা বলতে বাতাসে কার্বন নির্গমন কমানোই ছিল মুখ্য৷ আর তা ধনী-গরিব সবার ওপর সমানভাবে বর্তানো হয়৷ তখন জলবায়ু রাজনীতিতে ন্যায্যতা বলতে ছিল, উন্নত দেশগুলো (ওইসিডিভুক্ত ৩৮টি দেশ) তাদের নিজস্ব কার্বন নিঃসরণ ১৯৯০ সালের সমপর্যায়ে বেধে রাখবে, এবং তাদের মধ্যে যাদের গণতন্ত্র সুসংহত ও বাজার অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত, তারা গরিব দেশগুলোকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে আর্থিক সহযোগিতা করবে৷ এখানে লক্ষ্যনীয় যে, বৈশ্বিক পরিসরে বাতাসে কার্বন নিঃসরণে যেসব দেশের অবদান এসব দেশের তুলনায় কিছুই নয়, তাদেরকেই অর্থ সহায়তা দিয়ে কার্বন নিঃসরণ কমাতে বলে উন্নত দেশগুলো এক ধরনের অপরাধবোধ থেকে দায়মুক্তির সন্ধান করে৷ আজ পর্যন্ত জলবায়ু সম্মেলনে যত দর কষাকষি, তা ঠিক এই জায়গাতেই আটকে আছে৷
অবশ্য জলবায়ুকর্মীদের চাপে বিংশ শতাব্দীতে এসে পরোক্ষভাবে কিছুটা দায় নিজেদের ঘাড়ে নিয়েছে৷ তারা মেনে নিয়েছে, নিজেদের দেশে কার্বন পোড়ানো কমালেই শুধু হবে না, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গরিব দেশগুলোকে যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে, তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে সেখানকার মানুষগুলো যেন টিকে থাকতে পারেন, তেমন ব্যবস্থা নিতে হবে এবং এর খরচ বহন করতে হবে৷ সেটি কেমন? যেমন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার কারণে কোন কোন উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়েছে৷ ফলে সেখানে যে ফসল হত, তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷ তাই লবণসহিষ্ণু ধান বা অন্য শস্য উদ্ভাবনে দরকার অর্থ৷ এটিকে অভিযোজন বা অ্যাডাপটেশনও বলা হয়৷ আরেকটি উদাহরণ হতে পারে, ঝড়ের হাত থেকে বাঁচতে বেশি বেশি সাইক্লোন সেন্টার গড়ে তোলা, বা ঘরহীন মানুষের পুনর্বাসন৷ আবার যেমন, হাওড় অঞ্চলে এবার বন্যার পর সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে ভাসমান ঘর বানিয়ে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন৷ বন্যা এলে এসব ঘর ভেসে উঠবে৷
তো ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোকে অর্থ দিতে হবে, এবং ২০২০ সাল নাগাদ এই অর্থ বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার ছুঁতে হবে৷ তো এই অর্থ নিয়ে যতটা বাগাড়ম্বর তার বাস্তব ফল খুবই নগণ্য৷ প্রথমত, এখন পর্যন্ত এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি তারা৷ গত বছর ৮০ বিলিয়নের কিছু বেশির হিসেব দিয়েছে তারা৷ কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফামের হিসেবে তা হয়ত চার ভাগের একভাগ৷
দ্বিতীয়ত, এই অর্থের ৮০ ভাগই তারা দিয়েছে প্রশমন বা কার্বন নির্গমন কমানোর খাতে৷ এর একাধিক কারণ রয়েছে৷ একটি হলো ব্যবসায়িক৷ কার্বন নির্গমন কমানোর খাতে ঋণ দেবার সুযোগ আছে৷ যেমন, জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন৷ এতে কার্বন নির্গমন কমে ঠিকই, এতে লাভও হয়৷ মানুষ বিদ্যুৎ কেনে এবং ফলে এ প্রকল্পে টাকা ঢাললে তা ফেরত আসে৷ তাই সবাই এ ধরনের প্রকল্পে আগ্রহী বেশি৷ উলটো দিকে অভিযোজনের প্রকল্পে অনুদান দিতে হয়৷ গরিব যে মানুষটিকে নতুন পরিবেশে টিকে থাকার জন্য ঘর তৈরি দেয়া হয়, তার থেকে তো সেই অর্থ ফেরত চাওয়া যাবে না৷ তাই এখানে টাকাও আসে না৷
এতে আরেকটি লাভ হয়৷ উন্নত দেশগুলোর ওপর কার্বন নিঃসরণ কমানোর চাপও কমে৷ আর অপরাধবোধের দায়মুক্তির সেই পুরোনো রাজনীতি তো আছেই৷
এদিকে, গত কয়েক বছর ধরে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ফোরাম বা ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামে, দুই বছরের জন্য যেটির সভাপতির দায়িত্ব বাংলাদেশও পালন করেছে, সেই দেশগুলোসহ, একদল বিশেষজ্ঞ, জলবায়ুকর্মীরা আরেকটি তহবিলের কথা বলছে৷ এর নাম ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ তহবিল৷ এই তহবিলের যৌক্তিকতা হলো, যখন প্রশমন বা কার্বন নিঃসরণ কমিয়েও এরইমধ্যে ঘটে যাওয়া জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানো যাচ্ছে না, কিংবা অভিযোজন বা অ্যাডাপটেশন করে এই পরিস্থিতির সঙ্গে টিকে থাকা যাচ্ছে না, এতে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের জন্য অর্থ যোগান দেয়া৷ যেমন, পাকিস্তানে বা বাংলাদেশে বন্যায় যে ক্ষতি হয়েছে, যারা পুরোপুরি নিঃস্ব হয়েছেন, তাদের পুনর্বাসন করা৷ এছাড়াও এর একটি ‘অ-অর্থনৈতিক’ ক্ষতির দিক আছে৷ যেমন যারা স্বজন হারিয়েছেন, কিংবা যে বাড়িটিকে কেউ নিজের ঘর ভাবতেন, যে গ্রামটিকে নিজের দেশ ভাবতেন, তারা বাস্তুচ্যুত হয়ে যে মানসিক ও সামাজিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন, সেগুলো এর মধ্যে পড়ে৷ এর দায় বড় বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোর৷ সমস্যা হলো, ধনী দেশগুলো এতদিন এই বিষয়টিকে পাত্তাই দিচ্ছিল না, বা দিতে চাইছিল না৷ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বলছিল যে, তারা কিছু শব্দ যেমন ‘লায়েবিলিটি’ বা দায় ও ‘কমপেনসেশন’ বা ক্ষতিপূরণ- এগুলো শুনতে চায় না৷
এমন জটিল পরিস্থিতিতে বিশ্ব যখন ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্য ও জ্বালানি সংকট নিয়ে নতুন বাস্তবতায় পড়েছে তখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলনের ২৭তম আসর বা কপ২৭৷ এবারই প্রথম ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ যুক্ত হয়েছে আনুষ্ঠানিক এজেন্ডায়৷ তাই সবার দৃষ্টি সেখানে৷ আর অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ মহাদেশ আফ্রিকার মিশরের শারম আল শাইখে৷ আফ্রিকার দেশগুলোও এখন জাপটে ধরে ফল আনতে চাইছে৷ বিশেষ করে মিশর এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চাইছে৷ এখন দেখার বিষয়, লোহিত সাগরের তীরে শুধু রাজনৈতিক ‘ব্লা ব্লা ব্লা’ নয়, সত্যি জলবায়ুর সুবায়ু বয় কিনা৷