অর্থযোগ না থাকলে নিয়ম ভেঙে ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে কীভাবে?
৮ মার্চ ২০২৪এত অগ্নিকাণ্ড, বিস্ফোরণের পরও নিয়মনীতি ভঙ্গ করা ভবনগুলো বহাল তবিয়তেই আছে৷ কেন এই ভবনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? বেইলি রোডে আগুনের পর বেশ কয়েকটি সংস্থা পৃথকভাবে অভিযান শুরু করেছে৷ ভবন বন্ধ করার পাশাপাশি কর্মচারীদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে৷ এতে কী পরিস্থিতির কোন উন্নতি হবে?
ডয়চে ভেলে : ঢাকা শহরে অপরিকল্পিতভাবে ভবনতো রয়েছেই, এগুলোর মধ্যে আবার স্কুল, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল হচ্ছে৷ এসব প্রতিষ্ঠান তৈরির ক্ষেত্রে আমাদের কী আলাদা কোনো আইন কানুন আছে?
অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান : যে কোন প্রতিষ্ঠান তৈরির ক্ষেত্রে পৃথক আইন ও গাইডলাইন আছে৷ স্কুল করতে হলে কিছু আইনকানুন আছে৷ পৃথক গাইডলাইনও আছে৷ সবক্ষেত্রেই তাই৷ সেট রুলস না থাকলেও পৃথক গাইডলাইন আছে৷ যেমন, স্কুল তৈরি করতে হলে সামনে একটা মাঠ থাকতে হবে, সেটা কমন গাইডলাইন৷ মাঠ না থাকলে স্কুল হবে না৷ কিন্তু দেখা যাচ্ছে একটি বহুতল ভবনে কয়েকটি ফ্লোর নিয়ে স্কুল বানানো হলো৷ এখানে কিন্তু স্কুলের নীতিমালা ভঙ্গ হলো৷ যা হচ্ছে সবকিছুই আইন বিধি ভঙ্গ করেই হচ্ছে৷ এর কারণ হচ্ছে আমাদের কর্তৃপক্ষ এত দুর্বল এবং আইন বাস্তবায়নে তাদের আগ্রহ খুবই কম৷ তারা ম্যানেজ হয়েই দিনের পর দিন এগুলোকে চলতে দিচ্ছেন৷
এই প্রতিষ্ঠানগুলো যে তৈরি হচ্ছে, এগুলো দেখভালের দায়িত্ব কার?
রাজধানীতে কোন ভবন কীভাবে নির্মিত হচ্ছে, সেটা দেখার দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)৷ মূলত নকশা অনুযায়ী ভবনটি নির্মিত হয়েছে কিনা? যে কাজে ভবনটি তৈরি হয়েছে সেই কাজে ভবনটি ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটা দেখবে রাজউক৷ এর বাইরে স্কুল, হাসপাতালসহ সবকিছু দেখার জন্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর আছে৷ তাদেরই এগুলো দেখভাল করার কথা৷ রাজউক তো করবেই, এর বাইরে যে ক্যাটাগরিতে প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে তাদের সেই মন্ত্রণালয় দেখবে৷ এর বাইরে যেমন, রেস্তোরাঁ করতে গেলে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে, এটা আইনে আছে৷ সবকিছু মিলিয়ে রাজউক এবং সিটি কর্পোরেশন দেখবে নগরের মধ্যে কী হচ্ছে৷
আমরা দেখেছি, কোনো একটি ঘটনার পর সরকারি সংস্থাগুলো একে অপরকে দোষারোপ করে থাকে৷ এই প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ করছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব কার?
এটা দেখার দায়িত্ব মোটা দাগে রাষ্ট্রের৷ রাষ্ট্র বলতে আসলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দেখার জন্য যে মন্ত্রণালয় আছে তাদেরই দেখার কথা৷ সর্বোপরি মন্ত্রী ও সচিবকেই সবাই রিপোর্ট করে৷ এখন দেখেন, কোন একটা ঘটনা যখন ঘটে তখন একে অপরের উপর দোষ চাপাতে থাকে৷ সভ্য দেশে কী দুর্ঘটনা ঘটে না? ঘটে৷ সেখানে আমরা কী দেখি? একজন আরেকজনের উপর দোষ চাপায় না৷ সবাই নিজের দোষটা স্বীকার করে৷ এখানেও যদি সবাই নিজের দায়টা স্বীকার করত তাহলে বাংলাদেশের এই চেহারা হতো না৷ সবাই যদি নিজের দায়িত্বটা ন্যূনতমভাবে পালন করত তাহলেও হতো না৷ অতীতে যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে, সেখানে যাদের এই দায়িত্ব তাদের যদি আইন অনুযায়ী শাস্তি দেওয়া যেত তাহলে এই পরিস্থিতি হতো না৷ এখানে কেউ দায় নেয় না৷ এখানে প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়৷ অতীতেও আমরা কখনই কাউকে দায় স্বীকার করতে দেখিনি৷ দায় নেওয়ার সংস্কৃতি আমাদের এখানে গড়ে ওঠেনি৷ অথচ বাইরের দেশে আমরা দেখি, মন্ত্রীর কোনো দায়িত্ব নেই তারপর তিনি পদত্যাগ করছেন৷ কেন? কারণ তিনি মনে করেন, তিনি যদি সঠিকভাবে মন্ত্রণালয় চালাতেন তাহলে নিম্ন পদের যে লোকটার অবহেলার কারণে এই ঘটনাটি ঘটেছে, সেটা হতো না৷ পরিদর্শক পর্যায়ে যারা আছেন তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে৷ আর আমাদের এখানে কাউকে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে না৷ সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে হয়তো বদলি করা হচ্ছে৷ যার ফলে পুরো নগরটা এইভাবে গড়ে উঠেছে৷
বলা হয়, প্রভাবশালীদের ভবনগুলোতে কর্মকর্তারা যেতে সাহস পান না৷ কেউ গেলে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়৷ এই কথা কী সত্যি?
একেবারেই সত্যি৷ আমরা কথা বলে দেখেছি, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যেতে ভয় পান৷ এখানে ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়েছে৷ এখানে আমজনতার যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে কিন্তু পরিদর্শকেরা প্রচণ্ড প্রতাপে যান৷ সেখানে তারা দেখভালের পরিবর্তে নিজেদের অর্থযোগ নিয়ে চেষ্টায় থাকেন৷ অর্থযোগ না থাকলে এত ঘটনার পরও কীভাবে নিয়ম নীতি ভঙ্গ করা ভবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে৷ রাজার মতো করে অনুমোদনহীন ভবন ব্যবহার করতে পারত না৷ একটা ১৪ তলা অফিস ভবনের পুরোটাই রেস্তোরাঁ৷ সেটা কী পরিদর্শক জানেন না? ঢাকা শহরের মূল জায়গাগুলোতে যে ভবনগুলো আছে, সেখানে কী হচ্ছে সেটা পরিদর্শকদের জানারই কথা৷
বেইলি রোডে আগুনের পর বেশ কয়েকটি সংস্থা পৃথকভাবে অভিযান শুরু করেছে৷ ভবন বন্ধ করার পাশাপাশি কর্মচারীদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে৷ এতে কী পরিস্থিতির কোন উন্নতি হবে?
এই ধরনের অভিযান তো সারা বছরই পরিচালনা করার কথা৷ কিন্তু কোনো বড় ঘটনার পর অভিযানের একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে৷ এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির একটা চিত্র আমরা পাই৷ এই ধরনের একটা বড় ঘটনা, যেটা জাতিকে নাড়া দিয়েছে সেখানে এই অভিযানটা আর ৮-১০টা অভিযানের মতো হওয়ার কথা ছিল না৷ বরং একটা সমন্বিত অভিযান, যেখানে সব সংস্থার একজন করে প্রতিনিধি থাকবেন, এমন হলে বার্তাটা পরিষ্কার হতো৷ এখন যেভাবে হচ্ছে তাতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে যায়৷ অতীত অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, ব্যবসায়ীদের হয়রানির বিষয়টিও উঠে এসেছে৷ এই অভিযানটা টাস্কফোর্সের মাধ্যমে হলে কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হতো৷
এখনও নতুন করে যেসব ভবন হচ্ছে, সেখানেও তো নির্মাণ বিধি মানা হচ্ছে না৷ তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে কীভাবে?
ঢাকা শহরের পরিস্থিতি তখনই বদলাবে, নতুন ভবনগুলোর তদারকি যদি ঠিকঠাক মতো হয় এবং পুরনো ভবনগুলো তদারকির উদ্যোগ নেওয়া হয়৷ এটা তো রুটিন কাজ৷ সেই রুটিন কাজটি রাজউক যে করতে পারছে না, সে ব্যাপারে তাদের কোন ব্যাখ্যা নেই৷ রাজউকের লোকবল অনেক বাড়ানো হয়েছে৷ লোকবল নেই তারা এখন আর সেই দোহাই দিতে পারবে না৷ কারণ এখন তাদের লোকবলের কোন ডিমান্ডও নেই৷ তারপরও যদি লোকবল দরকার হয়, সেই ডিমান্ড করুক৷ এখন তাদের যেসব কর্মকর্তা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি বা অনৈতিক অর্থযোগের মাধ্যমে নিজেদের সম্পদ বাড়িয়েছেন এ ব্যাপারে কী তারা কখনও শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছেন? ফলে এখানে যারা কাজ করেন তারা এক ধরনের ফ্রি লাইসেন্সের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন৷ এখন দেখেন একটি ভবনের ছাদে কিছু করা যাবে না৷ কিন্তু সেখানে রেস্টুরেন্ট হয়ে যাচ্ছে৷ এই ব্যত্যয়গুলো তো খালি চোখে দেখা যায়৷ এটা তো রাজউকের ক্ষমতার বাইরে নয়৷ এসব জায়গায় তারা কম্প্রোমাইজ অবস্থায় চলে গেছেন৷
ঢাকা শহরে যেভাবে ভবনগুলো গড়ে উঠেছে, এই পরিস্থিতিতে কীভাবে এগুলোকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা সম্ভব?
যে ভবনগুলো ইতিমধ্যে হয়ে গেছে, সেগুলো চাইলেই স্ট্রাকচার পরিবর্তন করা সম্ভব নয়৷ কিন্তু ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমরা আমূল পরিবর্তন আনতে পারি৷ স্ট্রাকচারে বড় কিছু না করা গেলেও তার ইউটিলিটি সার্ভিসের লাইনগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা? যে ভবন যে কারণে তৈরি হয়েছে, সেই কারণে ভবনগুলো ব্যবহার হচ্ছে কিনা? কারও ব্যবহারে যদি উদ্দেশ্য ঠিক না থাকে তাহলে আদি ব্যবস্থায় ফেরত নিতে হবে৷ অগ্নি নিরাপত্তায় যা করা দরকার সেটা করতে মালিকদের বাধ্য করতে হবে৷ এই কাজে এলাকাবাসীকে সম্পৃক্ত করতে হবে৷ কোন ভবনে ত্রুটি পাওয়া গেলে যাতে তারা সেখানে না যান৷ আর যে ভবনগুলো অতি ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক সাইনবোর্ড দিতে পারেন৷ সেগুলো বসবাসের অনুপযোগী ঘোষণা করতে পারেন৷ এরপর এই ভবনগুলোর ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে৷ দিনশেষে মানুষের নিরাপত্তার সঙ্গে কোন আপস চলবে না, এই বার্তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে৷ আমাদের এই উদাসীনতাগুলো মানুষের জীবন ও সম্পদের ঝুঁকির কারণ হয়ে গেছে৷