তাহলে হয়তো আজ ইটালিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পাওয়া মানুষটা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে রওনা হতেন স্বপ্নের পথে। কিংবা দুই জেদি মেয়েকে রেস্টুরেন্টে খেতে নিয়ে যাওয়া মা রান্নার সামান্য অবসরে মেয়েদের নিয়ে বড় বড় স্বপ্নের জাল বুনতেন। ছোট্ট শিশুটি হয়তো মায়ের কোলে বসে ভিডিও গেমসের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতো।
আহ! সত্যিই যদি এমন হতো!
কিন্তু এটা সত্য, সত্যটা এমন নয়। বরং নির্মম। বেইলি রোডের মতো এমন নির্মম সত্য ঢাকাই মানুষের জীবনে অনেকবার এসেছে। আমরা সেগুলো দেখেছি এবং বারবার আহা-উহু করেছি। তারপর ‘আমার সাথে তো ঘটেনি' ভেবে বেমালুম ভুলে গেছি। তাতেপ্রতিবার পুড়েছে মানুষ, পরিবার আর একেকটা স্বপ্ন।
আগুনে পুড়ে কিংবা বৃষ্টির পানিতে খোলা বৈদ্যুতিক তারে স্পৃষ্ট হয়ে বা ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনাগুলো আমাদের কাছে কেবলই একেকটা ইভেন্ট। যে ইভেন্টগুলোর পর ক'দিন বেশ তোড়জোড় হবে, মিডিয়াতে হৈ চৈ পরে যাবে, গরম-গরম টকশো হবে, খুব সক্রিয় হয়ে উঠবেন সরকারী কর্তারা, এটাই নিয়মিত প্র্যাকটিস। এতটাই নিয়মিত যে, চোখকান খোলা এমন যে কারও কাছে এই কার্যক্রমগুলো খুব পরিচিত।
এই যেমন আমরা চোখ বুঁজে বলে দিতে পারি, এমন একেকটা দুর্ঘটনার পর এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি হবে। সেই কমিটি দুর্ঘনাস্থল পরিদর্শন করে টিএ-ডিএ বিল তুলবেন এবং প্রতিবার মিটিং শেষে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ‘চা-নাস্তা'র খরচা বাড়বে। তারপর মাঠ আর মাঠের বাইরের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে চলবে দীর্ঘ টেবিল-টক। মহা এই কর্মযজ্ঞের পর যে প্রতিবেদন আসবে তাতে থাকবে নীতি আর নৈতিকতায় ভরপুর এক গুচ্ছ পরামর্শ। সরকারের জন্য, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য এমনকি সাধারণ মানুষের কর্তব্য নিয়েও পরামর্শ দেবে তদন্ত কমিটি। কর্তরা তাদের নিজেদের জন্যেও কিছু গালভরা পরামর্শ লিখে রেখে যাবেন। কিন্তু আদতে সেই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জঞ্জাল হয়ে পরে থাকবে ফাইল কেবিনেটে। ধুলো জমবে। আরেকটা ফাইল জ'মা হওয়ার আগ পর্যন্ত থেমে যাবে সব দৌঁড়ঝাপ। আমরা আবার ভুলে যাবো চুড়িহাট্টা কিংবা বেইলি রোডের ওইসব করুণ গল্প।
২. এই এবারই যেমন; দ্রুততর সময়ের মধ্যে তদন্ত কমিটি হয়েছে। আবার অন্যদিকে শুরু হয়েছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর তৎপরতা। চলছে অভিযান। যদিও সমন্বয়হীনভাবে চলছে একধিক সংস্থার সেই হন্তদন্ত অভিযান। তাতে কিন্তু দৃশ্যমান সাফল্য আছে! কী দারুণ একটা ব্যাপার, কত রকমের তৎপরতা চলছে গোটা ঢাকা শহরজুড়ে। আগুনের ঘটনার তিন দিনের মধ্যেই সরকারের চৌকষ কর্মকর্তারা অভিযান চালিয়েছেন ১ হাজার ৩শ ৪৭ প্রতিষ্ঠানে। তাতে গ্রেফতার ৮শ ৭২ জন! যদিও তার মধ্যে মালিক ধরা পরেনি, বরং রেস্টুরেন্ট কর্মচারীদের আটক করার সাফল্য এসেছে। সেগুলো ঘটা করে প্রচারও হচ্ছে। সিলগালা ৪৫ আর আপাতত বন্ধ আছে ৫শ'র বেশি রেস্টুরেন্ট। এতে কার কতটা অর্জন হচ্ছে সেটা বলা মুশকিল।
যদিও দুষ্টু লোকেরা বলেন, লাভ হয় সরকারী সংস্থাগুলোর নির্দিষ্ট কিছু মানুষের। আপনি চাইলে সেই দুষ্টুদের কথা কানে নিতে নাও পারেন। তবে দুষ্টুরা বিরামহীন বলেই চলেছেন, সরকারী সংস্থাগুলো দু'ধারী তলোয়ার। রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়া কিংবা পুনরায় খুলে দেওয়ার নামে তাদের প্রাপ্তিযোগ হয়।
দুষ্টু লোকের ওসব তথ্য-উপাত্তহীন কথাবার্তায় কান না দিয়ে বরং ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকা ক'টা প্রশ্নের উত্তর খুঁজি।
এই যে তড়িঘড়ি করে রেস্টুরেন্টে অভিযান, জরিমানা, গ্রেফতার এমনকি বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে তাতে করে কী পরের দুর্ঘটনা ঠেকানো যাবে? আমরা কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছি যে পরের আগুনটা রেস্টুরেন্টেই ঘটবে? কিংবা পরের আগুনটা ঘুষ দিয়ে প্ল্যান পাস করানো একটা বহুতল ভবনে ঘটবে না, যেখানে অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা নেই? আরেকটু দূরে ভাবলে আমরা কি'করে নিশ্চিত হচ্ছি যে, পরের দুর্ঘটনাটা আগুন থেকেই ঘটবে, বিদ্যুতের ঝুলে থাকা তার বা অবৈধ গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে ঘটবে না?
এই প্রশ্নগুলো খুব কঠিন নয় বরং জটিল। আমাদের সবার জানা, এগুলো কেবল প্রশ্ন হিসেবেই থেকে যাবে, উত্তর মিলবে না। উত্তর এলেও তা হবে রহস্যময়।
লক্ষ করলে দেখা যাবে বাংলাদেশের সিস্টেম ধরেই নিয়েছে ভবিষ্যত দুর্ঘটনাগুলো কেবল রাজধানী ঢাকাতেই ঘটবে। নইলে আগুন নির্বাপন ব্যবস্থা দেখার নামে অভিযানের তোড়জোড় কেবল ঢাকা শহরেই কেন চলবে? এমন তো নয় যে অন্য শহরগুলোতে এমন যত্রতত্র রেস্টুরেন্ট গড়ে ওঠেনি! এমন তো নয় অন্য শহরের সকল ভবনগুলো খুব নিয়ম মেনে তৈরি হয়েছে!
৩. একটি ভয়ঙ্কর তথ্য পাওয়া গেলো গণমাধ্যমে। ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শন দল ৩শ ৪৫টি হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে জানিয়েছে তালিকার ৩শ ৩৮টি হাসপাতাল অগ্নি ঝুঁকিতে আছে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটা বহুতল ভবনে কেবল একটি নামার সিঁড়ি। নেই প্রাথমিক অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা। যাদের অগ্নি নির্বাপনের প্রাথমিক যন্ত্র নামের ওই লালরঙা সিলিন্ডার আছে, সেগুলোরও বেশিরভাগ মরচে পরা, কাজ করে না!
এই তালিকায় আবার উচ্চ ঝুঁকিতে অন্তত ১শ ২০টি বড়সড় হাসপাতাল। হাসপাতালের নামের বিস্তারিত তালিকা পাওয়া যায়নি, তবে ধরে নেওয়া যায় খুব ভীর জমে এমন হাসপাতালগুলোর কথাই বলা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।
ব্যাপারটা এমন; জীবন ফিরে পেতে কিংবা জীবনের গতি ফিরে পেতে হাসপাতালে গিয়ে আপনার জীবনিপাতই ঘটতে পারে। তখন অবশ্য সব সহ্য করে নেওয়া বাঙালির মতো আপনার পরিজনদেরও ‘এটা একটা নিছক দুর্ঘটনা' কিংবা নিয়তি হিসেবে মেনে নিতে হবে।
আদতে সংকট কোথায়? কেন এমন দুর্ঘটনা এদেশে নিয়মিত ঘটনা?
দু'দিন আগে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডক্টর কামাল উদ্দিন আহমেদ সাক্ষাতকারে বলছিলেন, ‘কোন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানই ঠিক পথে নেই। যার যা করার কথা, তারা সেই কাজটা ঠিকমতো করছে না। কেবল ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরই তাদের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।'
৪. চুড়িহাট্টা কিংবা বেইলি রোডের মতো আগুনে দগ্ধ হয়ে মানুষ মারা যাওয়ার পর সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। বারবারের দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ আর তাদের পরিবারই কেবল ভুক্তভোগী হয়েছে। বাকিরা কেবল অসহায় দর্শক হিসেবে পরের ইভেন্টের অপেক্ষায় থেকেছে। অন্তত ততদিন পর্যন্ত তারা দর্শক যতদিন নিজের সঙ্গে অমন ঘটনা না ঘটছে।
তবে কী আমরা একেকজন অপেক্ষা করবো, চার দেয়ালের মাঝে আপাতদৃষ্টে নিরাপদ ঘরে আকষ্মিক মৃত্যুর! হোক সে বিদ্যুত কিংবা গ্যাসের চোরাই লাইন থেকে কিংবা ঘুষ দিয়ে ছয় তলার অনুমতি নিয়ে গড়ে তোলা দশ তলা ভবন ধ্বসে। তখন গণমাধ্যম আবার ক'টা দিনের জন্য খোরাক পাবে। সরকারী কর্মকর্তারা পাবেন আরেকটি কর্মযজ্ঞ দেখানোর উপলক্ষ। বুদ্ধিজীবি আর রাজনীতিকদের কাছে আসবে জমজমাট ‘পক্ষে-বিপক্ষে' টকশো করার সুযোগ।
আবার নতুন ইভেন্টের ক্ষতিগ্রস্তরা পাবেন আরেকটি তদন্ত কমিটি।
কিন্তু মানুষ তো এমন অনিশ্চয়তার জীবন চায় না। নিজের সাজানো চার দেয়ালের ভেতরে, যেখানে তার সবচে নিরাপদ থাকার কথা, সেখানেই আকষ্মিক অপমৃত্যু কার কাম্য হতে পারে?
নিরাপদ জীবন আর স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা কী নাগরিক হিসেবে খুব বেশি চাওয়া?