অনুভূতিতে আঘাতের কথা বললেই নাটক প্রত্যাহার!
১৭ এপ্রিল ২০২৪রাফাত মজুমদার রিংকুর পরিচলানায় ‘রূপান্তর' নাটকটি গত ১৫ এপ্রিল ইউটিউবে প্রকাশ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটাকে কেন্দ্র করে‘ট্রান্সজেন্ডার' ইস্যু নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হলে মাত্র একদিন পর, অর্থাৎ ১৬ এপ্রিল সকালেই নাটকটি ‘প্রত্যাহার' করা হয়। নাকটিতে ইলেকট্রনিক পণ্য নির্মাতা ওয়ালটনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছিল। তারাই স্পন্সর। আর বিজ্ঞাপনি সংস্থা হলো ‘লোকাল বাস এন্টারটেইনমেন্ট' । নাটকটির নির্মাতা ‘একান্ন মিডিয়া'। ওয়ালটন লোকাল বাস এন্টারটেইনমেন্টকে ‘মৌখিক নোটিশ' দেয়ার পর তারা নাটকটি ইউটিউব থেকে সরিয়ে ফেলা হয়। তাদের আইনি নোটিশও দেয়া হয়েছে ১৬ এপ্রিল। নোটিশে বলা হয়েছে,"৬টি নাটকে ওয়ালটন ফ্রিজ ব্র্যান্ডিং করতে সম্মত হয়। নাটকগুলোতে দেশের আইন, নীতি, নৈতিকতা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হয় এমন কোনো বিষয় অন্তর্ভুক্ত হবে না মর্মে শর্ত উল্লেখ করা হয়। কিন্তু ‘রূপান্তর' নাটকটিতে এমন কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাতে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে ও মানুষের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে।”
নোটিশে চুক্তি বাতিল এবং ওয়ালটনের আদর্শ ও নীতিমালার পরিপন্থি নাটক প্রচারের জন্য আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথাও বলা হয়।
নাটকটিতে কী আছে?
পুরো বিষয়টি নিয়ে কথা হয় নাটকের পরিচালক রাফাত মজুমদার রিংকুর সঙ্গে। তিনি বলেন, "আমার নাটকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কিছু নেই। এটা আইন এবং সমাজের বিরুদ্ধেও নয়।” তিনি জানান, "এই নাটকের গল্পটি মূলত একজন তরুণ চিত্রশিল্পীকে কেন্দ্র করে, যিনি শৈশবে ট্রেন দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন পরিবারের সদস্যদের। এ কারণে তিনি জানতে পারেননি তার বাবা-মা কে কিংবা তারা কোন ধর্মের মানুষ। বড় হয়েছেন অনাথ আশ্রমে। চিত্রকর হিসেবে পেয়েছেন খ্যাতি। এর মধ্যে একজন ধনীর কন্যা তার শৈল্পিক প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়েন। কিন্তু চিত্রশিল্পী (নায়ক) তাকে নানা অজুহাতে এড়িয়ে চলেন। শেষ পর্যন্ত নায়িকা বিয়ের জন্য পারিবারিকভাবে প্রস্তাব পাঠান ওই শিল্পীকে। কিন্তু তিনি সাফ জানিয়ে দেন, তাকে দিয়ে সেটা সম্ভব নয়। এরপর তার চিকিৎসকের মাধ্যমে জানানো হয়, তিনি আসলে একটি হরমোনজনিত বিরল জটিলতায় ভুগছেন। দেখতে পুরুষের মতো হলেও ঘটনা ভিন্ন, তিনি পুরুষ নন।”
রাফাত মজুমদার রিংকু আরো বলেন, "আমি একজন প্রাকৃতিকভাবে রূপান্তরিত মানুষের কথা বলেছি। এটা ন্যাচারাল। এটার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে। এটা মেডিকেল সায়েন্স স্বীকার করে। আমার নাটকের শেষে একজন চিকিৎকও বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন।”
পরিচালককে হুমকি
নাটকের পরিচালক রাফাত মজুমদার রিংকু বলেন," আমি নতুন একটা গল্প বলার চেষ্টা করেছি। একটা ক্রাইসিস তুলে ধরেছি। আমরা কি তাহলে নতুন গল্প বলতে পারবো না? আমরা কি প্রচলিত ধারণার বাইরে যেতে পারবো না?”
"এখন আমাকে নানাভাবে চাপ দেয়া হচ্ছে। ফোন করে নানা ধরনের হুমকি দেয়া হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা অপপ্রচার করা হচ্ছে,” বলেন তিনি। নাটকটি ওয়ালটনের বিজ্ঞাপন বাদ দিয়ে আবার ইউটিউবে দেয়া হবে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন," এটা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বলতে পারবে।”
তবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান একান্ন মিডিয়ার পক্ষ থেকে সাইফুল আজম রাসেল বলেন," আমরা এখন নিজেদের মধ্যে নাটকটি নিয়ে কথা বলছি। আবার এটা ওয়ালটনের বিজ্ঞাপন ছাড়া প্রচার করবো কিনা এখনই বলতে পারছি না। আমরা যখন তৈরি করেছি, তখন সব দিক বিবেচনা করেই করেছি। এই পরিস্থিতি কেন হলো তা বোঝার চেষ্টা করছি।”
তবে বিজ্ঞাপনি সংস্থা লোকাল বাস এন্টারটেইনমেন্টের কোনো বক্তব্য জানা যায়নি।
নাটকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফারহান আহমেদ জোভান এবং সামিরা খান মাহি। ফারহান আহমেদ জোভান বলেন, "আমি জেনে-শুনেই নাটকটিতে অভিনয় করেছি। আমি এর মধ্যে ধর্মীয় অনভূতিতে আঘাতের কিছু পাইনি। আইন বা সামাজিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কোনো কিছু আছে বলে আমার কাছে মনে হয়নি। আমার কাছে গল্পটি গতানুগকিতার বাইরে মনে হয়েছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "প্রাণনাশের হুমকির মতো কোনো হুমকি আমি পাইনি। তবে ফোনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাকে অপদস্থ করা হচ্ছে।”
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
অল্প সময় ইউটিউবে থাকলেও নাটকটি দেখেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা। তার কথা, "যারা এই নাটক নিয়ে সমালোচনা করছেন, বয়কট করার জন্য ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন, তারা কয়জন নাটকটি দেখেছেন? তারা না দেখে, না বুঝে এই নাটকটির বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। নাটকে যা বলা হয়েছে তা প্রাকৃতিক। জন্মগত নারী ও পুরুষের বাইরেও জন্মের পরে পরিবর্তন হতে পারে। এটা বিজ্ঞান এবং মেডিকেল সায়েন্সে স্বীকৃত। সমাজের কিছু লোক ট্রান্সজেন্ডার শব্ধটি নিয়ে অপ্রচার চালাচ্ছে। আমাদের এখানেই তো অনেকে আছেন। তারা সরকারি চাকরিও করছেন। কেউ কেউ প্রচলিত চিন্তার বাইরে কিছু ভাবতে পারে না। এখানে দায় আছে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের। তাদের এটা পরিস্কার করা উচিত।”
তার কথা, "আমরা খবরে দেখি এক রাতে পুরুষ নারী হয়ে গেছে। আবার নারী পুরুষ হয়ে গেছে। তখন আমাদের প্রতিক্রিয়া হয় না। নাটক দেখলে প্রতিক্রিয়া হয়। এখানে একটা সোশাল মব তৈরি করা হয়েছে। এরা নাটকটি দেখেওনি।”
"এটা চলতে দিলে ভবিষ্যতে আমাদের এখানে খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক অপব্যখ্যা দিয়ে বই ছিঁড়ে ফেললেন৷ তার বিরুদ্ধে কোনা ব্যবস্থা দেখছি না। ঈদের সময় একটি পোশাকে রংধনু নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গরম করা হলো। রংধনু কি অন্যায়? এসব দেখার কেউ নেই?”
তিনি মনে করেন, "ওয়ালটন এখানে তার ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেহতু বিতর্ক হচ্ছে, তাই সে মনে করেছে ব্যবসার ক্ষতি হতে পারে। তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে হিজড়াদের নিয়োগ দিলেও এখানে কর্পোরেট সোশাল রেসপন্সিবিলিটি পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসানেরও বক্তব্য, "কয়জন এই নাটক দেখেছেন? যারা সমালোচনা করছেন, তাদের প্রায় সবাই না দেখে ইচ্ছে মতো কথা বলছেন।”
তার কথা, "এতে যদি কেউ মনে করেন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, তাহলে তিনি আদালতে যেতে পারেন। আদালত সিদ্ধান্ত দেবেন। তার আগেই কেন নাটক বন্ধ করতে হবে?”
তিনি বলেন," একটা নাটকেই যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া হয় তাহলে বুঝতে হবে আমাদের সমাজ কোথায় আছে, সমাজে কতটা অসিহষ্ণুতা এখনো আছে।”
"জন্মগত ছাড়াও জেন্ডার পরিবর্তন হতে পারে। এটা প্রাকৃতিকভাবে হতে পারে। আবার চিকিৎসা বিজ্ঞানের মাধ্যমে হতে পারে। এখন এখানে কখনো কখনো আদালতের ডিক্লারেশন দরকার হয় উত্তরাধিকার ও সম্পদের ভাগ বাটোয়াারার জন্য । এর বাইরে কিছু নয়।”
রূপান্তর সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞান যা বলে
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হরমোন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ বলেন , জন্মগত নারী-পুরুষ ছাড়াও পরবর্তী জীবনে হরেমানাল পরিবর্তন আসতে পারে। এটা নানা ধরনের রোগের কারণে হয়। নারীর বাহ্যিক অবস্থা পুরুষের মতো হয়ে যেতে পারে। আবার পুরুষের বাহ্যিক অবস্থা নারীর মতো হতে পারে।”
"অন্যদিকে একজন চেহারায় পুরুষ কিন্তু তার মনোজগত নারীর, উল্টো একজন চেহারায় নারী কিন্তু তার মনোজগতে সে পুরুষ- এটাও একটা রোগ,” বলেন এই চিকিৎসক।
"আর নারী বা পুরুষ কোনো জেন্ডারই না এমনও হতে পারেন একজন জন্ম থেকেই। তাই মেডিকেল সায়েন্সে প্রটোকল আছে যে, কাদের আমরা ট্রান্সজেন্ডার বলবো,” বলেন তিনি।
"তবে কারো পক্ষে নারী থেকে শতভাগ পুরুষ অথবা পুরুষ থেকে শতভাগ নারীতে রুপান্তর সম্ভব নয়,” বলেন এই চিকিৎসক।
আইন কী বলে
বাংলাদেশে হিজড়াদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়া হয় ২০১৩ সালে। আইনে তাদের সব ধরনের নাগরিক অধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। তারা জনপ্রতিনিধিও নির্বাচিত হয়েছেন। এর বাইরেও রূপন্তরিতরা আছেন। স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন,‘‘এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে রুপান্তরিতরাও আছেন৷ তারাও ট্রান্সজেন্ডার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণে সরকারিসহ বিভিন্ন কাগজপত্রে নারী ও পুরুষ ছাড়া অন্য বিকল্পরএখনো তেমন প্রচলন হয়নি। সমাজসেবা অধিদপ্তর এই কারণে ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার রক্ষায় একটি নতুন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে আইনটি এখন কোন পর্যায়ে আছে তা জানা যায়নি। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এ বিষয়ে খোঁজ-খবর না নিয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। তবে তাদের অধিকার রক্ষায় অবশ্যই আইন প্রয়োজন।”
আর অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, "কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরই মধ্যে নারী-পুরুষ ছাড়াও ‘অন্যান্য' বলে একটা অপশন রাখা হচ্ছে। কোথাও ‘কমন জেন্ডার' অপশনও আছে। ট্রান্সজেন্ডারারা সেই অপশনে থাকছেন। তবে এটা আরো স্পষ্ট করা দরকার। আর কেউ যদি রুপান্তরিত হয়ে নিজেকে নারী বা পুরুষ বলে ঘোষণা দিতে চান, তাহলে তাকে আদালতের মাধ্যমে অনুমোদন নিতে হবে।”
ওয়ালটনের বক্তব্য
ওয়ালটনের কর্মকর্তাদের কেউ এই বিষয় নিয়ে কথা বলেননি। কথা হয় সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট, ওয়ালটনের আইনজীবী ও লিগ্যাল নোটিশ প্রদানকারী মো. রাইসুল ইসলাম রিয়াদের সঙ্গে। তিনি বলেন, "এটাকে ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত, আইন ও সামাজিক মূল্যবোধ বিরোধী আমরা বলছি না। আমরা বলছি, এটা পাবলিক পারসেপশনের বিরুদ্ধে গেছে। আর বিজ্ঞাপনী সংস্থা আমাদের এই কনটেন্ট না দেখিয়ে, না জানিয়ে প্রকাশ করেছে। এতে চুক্তি ভঙ্গ হয়েছে। তাই চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আমাদের এটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আমাদের অনেক কিছু বিবেচনায় নিতে হয়। আমাদের পাবলিক সেন্টিমেন্টকে গুরুত্ব দিতে হয়।”
"আমরা সব জেন্ডারের সমতায় এবং সমঅধিকারে বিশ্বাসী। এই কারণে আমরা ওয়ালটনে হিজড়াদের বেশ কয়েকজনকে নিয়োগ দিয়েছি, ”বলেন তিনি।