তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার নিয়ে বিতর্ক ও শিক্ষামন্ত্রীর ‘জবাব’
২৩ জানুয়ারি ২০২৪গত কয়েক বছরে সমাজের নানা ক্ষেত্রে ট্রান্সজেন্ডার নারী-পুরুষদের এগিয়ে যাওয়ার অনেক গল্পই বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনেও তাদের কেউ কেউ অংশ নিয়েছেন। এর বিপরীতে মাঝে মাঝেই উঠে আসে মানবাধিকার প্রশ্নে উদ্বেগের কারণ হওয়ার মতো ঘটনা৷
সর্বশেষ ঘটনাটি বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের আচরণ ও সেই আচরণের পরই তার চাকরিচ্যুতি নিয়ে। গত দু'দিন ধরে এটি বাংলাদেশের ভার্চুয়াল জগতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে, যা ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠী ও অধিকার কর্মীদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে।
ঘটনার সূত্রপাত শুক্রবার। রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে বর্তমান শিক্ষা করিকুলাম নিয়ে আয়োজিত একটি সেমিনারে আলোচনা করতে গিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব অভিযোগ করেন পাঠ্য বইয়ে ট্রান্সজেন্ডারের গল্প ঢুকিয়ে কোমলমতি শিশুদের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে। এমন অভিযোগ তুলে তিনি হাতে থাকা পাঠ্য বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলেন এবং সেখানে উপস্থিত সবার প্রতি একই কাজ করার আহ্বান জানান৷
রোববার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় আসিফ মাহতাবের সঙ্গে চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় তাকে। আসিফ জানান, তাকে যেদিন এই সিদ্ধান্ত জানানো হয় সেদিনও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চুক্তি নবায়ন না করার কোনো কারণ উল্লেখ করেনি বলেও জানান তিনি। তবে তিনি মনে করেন, ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে ব্যক্তিগত মতামত ব্যক্ত করাতেই তাকে কর্মচ্যুত করা হয়েছে।
এই বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, আসিফ মাহতাব তাদের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তবে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তার কোনো চুক্তি নেই। সেখানে আরো বলা হয়, ‘‘ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় তার কর্মীদের গোপনীয়তা এবং তাদের চুক্তির গোপনীয়তা বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয় তার অনুষদ এবং শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সমর্থন করে এবং সহযোগিতামূলক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং কলেজিয়াল আচরণকে উৎসাহ দেয়।"
সেমিনারে ছিঁড়ে ফেলা ‘শরীফ থেকে শরীফা’ গল্প প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে নিজের মতো একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন আসিফ মাহতাব, ‘‘বইয়ের মধ্যে বলা হয়েছে, এই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে যাবে এক জায়গায়। একজন বলেছে আমাদের গুরুমা আছে। একটা অপরিচিত লোক, বাবা-মায়ের সাথে কোনো যোগাযোগ নাই, গুরু মায়ের কাছে যাবে- এই ধরনের কথা ক্লাস সেভেনের বাচ্চাকে বলা কোনোভাবেই আমি সমর্থন করি না। প্যারেন্টসের সম্মতি ছাড়া এ ধরনের কথা হবে এটা গ্রহণযোগ্য নয়। ওখানে বলেছে,
আমি ছেলে কিন্তু মনে মনে মেয়ে, এটা বাচ্চাদের কনফিউজ করে দেওয়া হয়। মনে মনে কেউ যদি মেয়ে হয়, ফিজিক্যালি ছেলে হয় সে ট্রান্সজেন্ডার না। আমরা হিজড়াকে সমর্থন করি, ট্রান্সজেন্ডার না।"
ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে আয়োজিত সেমিনারে তিনি প্রস্তাবিত ট্রান্সজেন্ডার আইনেরও সমালোচনা করেছেন। যদিও আইনটির বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই আইনের এখন কোনো সমালোচনার সুযোগই নেই, কারণ, আইনটির খসড়া এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শাহজাহান বলেছেন,আইনটি নিয়ে তারা তাদের কার্যক্রম অনেক দূর এগিয়ে নিলেও কোনো কিছু এখনো চূড়ান্ত হয়নি। সরকার ২০১৩ সালে তৃতীয় লিঙ্গকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিলে আইনটির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সম্পত্তি ও স্বাস্থ্যগত অধিকারসহ কিছু বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে৷ এ কারণে আইনটি করতে হচ্ছে। তবে আমাদের কাজ এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই বিষয়ে কারো যদি মতামত থাকে, নিশ্চয় তারা সেই সুযোগ পাবেন।"
আইনের খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার আগেই এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি করার কারণ জানতে চাইলে, আসিফ মাহতাব বলেন, "একটা জিনিস যদি হয়ে যায়, হওয়ার পর এটা নিয়ে কী বলতে পারি। রাষ্ট্র যদি ভুল করে কোনো আইন পাশ করে ফেলে, রাষ্ট্রকে বলবো- দেখেন, যে আইনটা করেছেন, আপনি ভুল করে ফেলেছেন, আমি তো একজন চিন্তাবিদ, একজন অ্যাকাডেমিক। আইন করার আগেই তো কারেক্ট করা যায়, সেই চিন্তা থেকে এটা নিয়ে কথা বলেছি।"
তবে ব্র্যাক কর্তৃপক্ষ চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর কিছু মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে কাজে পুনর্বহালের দাবি জানায়, আরেকটা অংশ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের এমন আচরণের তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের ট্রান্সজেন্ডাররা৷ রাজবাড়িতে একটা বিউটি পার্লার পরিচালনা করেন ট্রান্সজেন্ডার অধিকার কর্মী তানিশা ইয়াসমিন চৈতি। ২০১১ সালে সার্জারির মাধ্যমে নিজেকে নারীতে রূপান্তরিত করেছেন তিনি।আসিফ মাহতাবের ঘটনায় চৈতি রীতিমতো ভীত। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "আমরা এদেশে থাকতে পারবো কি-না এটাই বড় সমস্যা...একটা বইতে আমাদের বিষয়ে একটা চ্যাপ্টার হয়েছে, আমাদের বিষয়ে মানুষ জানছে, আমাদের সম্মান করছে, আমাদের এখন কাজ দিচ্ছে- কিন্তু এরা এমনভাবে প্রচারে নামছে কী বলবো, আমরা যেন এদেশের মানুষ না, আমরা কিছুই না, আমরা অনেক পাপ করে ফেলেছি।"
চৈতি মনে করেন, ট্রান্সজেন্ডার ইস্যুতে সমালোচনা করার আগে সমালোচকদের উচিত তাদের সঙ্গে কথা বলা, ব্যক্তিগতভাবে তাদের সমস্যাগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করা। "আমি যখন ২০১১ সালে আমার সার্জারিগুলো করি, এটার যে কত যন্ত্রণা, কত খরচ কেউ তো আমাকে সাহায্য করেনি। আমি নিজে থেকে করেছি৷ কেন করেছি? কিসের জন্য করেছি? নাম, সুনাম কিছুর জন্য না। একমাত্র আমার বেঁচে থাকার জন্য। কারণ, আমি ভুল একটা শরীরে ভুল একটা মানুষ। সেটাকে ম্যাচ করার জন্য, না হলে তো আমি বাচতেই পারবো না। আমি তো রাষ্ট্রের কাছে কিছুই চাই না। শুধু বেঁচে থাকতে চাই। কিন্তু এই মানুষগুলো... কী বলবো... আমার এত খারাপ লাগছে... ইয়াং একটা ছেলে, পড়াশুনা করা। আমাদের মতো মানুষের সাথে কথা বল..আমাদের ভেতরের খবর একবার জান, তারপর তোরা যা খুশি বল!"
তৃতীয় লিঙ্গের আরেক অধিকার কর্মী হো চি মিন ইসলাম ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসিফ মাহতাবের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, "এ ধরনের মানসকিতার একজন মানুষের তো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগই পাওয়ার কথা নয়৷" আসিফ মাহতাবের আচরণকে ‘রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ' আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যে বইটি তিনি সেমিনারে ছিঁড়েছেন সেটা তো বাজারে কিনতে পাওয়ারই কথা নয়। ...এই বই রাষ্ট্রের সম্পদ। এটা এভাবে ছিঁড়ে ফেলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ," বলেছেন তিনি।
সম্প্রতি ঢাকার আরেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে (নর্থ সাউথ) ক্যারিয়ার অ্যান্ড প্লেসমেন্ট সেন্টার (সিপিসি)-এর উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে যোগ দিতে গিয়ে হো চি মিন ইসলাম নিজেও অনাকাঙ্খিত ঘটনার শিকার হন। একটা অংশের আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত ওই অনুষ্ঠানে হো চি মিন আর কথা বলতে পারেননি। এ ব্যাপারে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিবৃতি দিলেও হো চি মিন ইসলাম জানান, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কেউ তার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো দুঃখ প্রকাশ করেনি।
‘‘তারা একটি বিবৃতি দিয়ে নিজেদের গা বাঁচিয়ে নিয়েছে, আমাকে কেউ রিচ আউট করেনি।’’ ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকার ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক- এমন প্রচারণা অনেক দিন ধরে চলছে জানিয়ে হো চি মিন ইসলাম দাবি করেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক একটা গোষ্ঠী এই বিষয়ে বিদ্বেষ ছড়াতে বড় ভূমিকা পালন করছে। "এটা খুবই বিপজ্জনক। এরা ট্রান্সজেন্ডারদের অধিকারবঞ্চিত করায় সফল হলে এরপর নারী অধিকার নিয়ে কথা বলবে। এদের তাই থামাতে হবে।"
এদিকে পাঠ্যবইয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক অংশ বিশেষজ্ঞরা অন্যভাবে উপস্থাপনের পরামর্শ দিলে সেখানে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। তবে সঙ্গে তিনি এ কথাও বলেন যে, দেশে একটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে নানা বিষয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে বা ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে নানা সময়ে অরাজকতা করার বা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার প্রবণতা আছে।
আজ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল চৌধুরী বলেন, ‘‘আমাদের দেশে একটি গোষ্ঠী নানান বিষয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে হোক বা আমাদের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে হোক, নানা সময়ে অরাজকতা করার বা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার প্রবণতা তাদের মধ্যে আছে। গত বছরও ছিল। একটি সংগঠন থেকে কিছুদিন আগে সুপারিশ করেছিল...সেখানে তারা দাবি করেছে, এখানে (বইয়ে) ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। সেই বিষয়টি তারা নজরে এনেছিল। তবে যখন আমরা আবার আলোচনা করেছি, তখন দেখেছি, শব্দটি ট্রান্সজেন্ডার নয়, থার্ড জেন্ডার। সেটা তো আইনত স্বীকৃত, যারা বায়োলজিক্যাল কারণে তৃতীয় লিঙ্গ বা আমাদের সমাজে সামগ্রিকভাবে হিজড়া নামে পরিচিত, আইনত তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তারা এ দেশের নাগরিক। অবশ্যই তাদের নাগরিক সুবিধা আছে।"