ভেনিস কি শেষ পর্যন্ত তলিয়ে যাবে?
২৭ মার্চ ২০২৪১,৬০০ বছর আগে থেকেই ভেনিস গোটা বিশ্বের বিস্ময়ের কারণ৷ বন্যা ও কোনো এক সময়ে সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার ভয়ও ততই পুরানো৷
পানি থেকে সুরক্ষার সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসেবে ৭৮টি ইস্পাতের প্রাচীর সৃষ্টি করা হয়েছে, যা প্রয়োজনে উপহ্রদটিকে সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখবে৷ সেই ব্যবস্থার পোশাকি নাম এমওএসই বা মোজে৷ ভেনিসের বন্যা সুরক্ষা কমিশনর এলিজাবেতা স্পিৎস বলেন, ‘‘মোজে না থাকলে ২০২২ সালের ২২শে নভেম্বর ভেনিস অপূরণীয় ধ্বংসলীলার শিকার হতো৷ ইতিহাসে দ্বিতীয় উচ্চতম বন্যার স্তর সত্ত্বেও কিছুই ঘটে নি৷ আমরা উপহ্রদ ও ভেনিস বাঁচাতে পেরেছিলাম৷''
এলিজাবেতা ৫০ বারেরও বেশি ফ্লাড গেট খাড়া করার নির্দেশ দিয়েছেন৷ মোজে বার বার কাজে লাগানো হচ্ছে৷ এবার সেটি পুরোপুরি চালু হয়ে গেছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা এখন জানি, যে মোজে এমন এক নমনীয় হাতিয়ার, যা সব সময়ে এবং একই সঙ্গে বন্ধ করা হয় না৷ আজ আমরা বন্যা ও বাতাস সম্পর্কে আরো বেশি জানি৷ সে কারণে আমরা বন্যার মোকাবিলা করতে পারি৷ উপহ্রদ ও সমুদ্রের মধ্যে পানির আদানপ্রদান নিশ্চিত করতে মোজে প্রণালী আংশিকভাবেও খাড়া করা যায়৷''
ভেনিস কি তাহলে রক্ষা পেয়েছে? বিশ্ব জলবায়ু পরিষদের পূর্বাভাস অনুযায়ী শহরের পানির স্তর চলতি শতাব্দীর শেষে ৬০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে৷
গেয়র্গ উমগিসার নামের এক সমুদ্রবিজ্ঞানীর মতে, মোজে প্রণালীর মাধ্যমে ভেনিস শুধু কিছুটা বাড়তি সময় পেয়েছে৷ তিনি বলেনস ‘‘ভেনিস রক্ষা করতে মোজে কি যথেষ্ট? হ্যাঁ, এই মুহূর্তে বা আগামী দশ, বিশ বা তিরিশ বছর পর্যন্ত অবশ্যই সেটা কাজে লাগবে৷ পানির স্তর ৫০ সেন্টিমিটার বেড়ে গেলে সেই প্রণালীকে ৩০০ থেকে ৪০০ বার খাড়া করতে হবে৷ অর্থাৎ দিনে একবার তো বটেই৷ তখন সেই প্রণালীর সীমা স্পষ্ট হয়ে যাবে৷ কারণ মোজে সেটা পারবে না৷ কাঠামো হিসেবে তো নয়ই, উপহ্রদের পক্ষেও সেটা সম্ভব হবে না৷ উপহ্রদে পানির আদানপ্রদান জরুরি৷''
সমুদ্র গবেষণা কেন্দ্রে মার্কো সিগোভিনিও উপহ্রদের ইকোসিস্টেম নিয়ে গবেষণা করছেন৷ জীববিজ্ঞানী হিসেবে তিনি মনে করেন যে মোজে প্রণালী কত ঘনঘন খাড়া করা হচ্ছে, উপহ্রদের উপর সেই সংখ্যা কোনো বড় প্রভাব ফেলছে না৷ কিন্তু আগামী দশকগুলিতে উপহ্রদ আরো ঘনঘন এবংআরো বেশি সময়ের জন্য সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন রাখলে সেই পরিস্থিতি বদলে যাবে৷ মার্কো মনে করেন, ‘‘এমনও হতে পারে, যে এই উপহ্রদ লবণাক্ত রাখার অর্থ আছে কি না, কোনো এক সময়ে আমাদের সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ রাখার কারণে সমুদ্র ও উপহ্রদের মধ্যে আদানপ্রদানের ছন্দ ভেঙে যাবে, যে চক্র ভেনিসের জন্য অত্যন্ত জরুরি৷ কারণ এভাবে উপহ্রদের তলদেশ সৃষ্টি হয়৷ কোন প্রাণী ও উদ্ভিদ সেখানে থাকতে পারে, সেটাও এভাবে স্থির হয়৷ আমাদের কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷''
তাহলে উপহ্রদ না শহর, কোনটা রক্ষা করা উচিত? বলা বাহুল্য, ভেনিসের মানুষ দুটোই চাইবেন৷
সেন্ট মার্ক্স স্কোয়্যার ভেনিসের সর্বনিম্ন অংশ৷ সেখানেই সবার আগে বন্যার পানি আসে৷ বর্তমানে সেই অংশটিকে উঁচু করার উদ্যোগ চলছে৷ গেয়র্গ উমগিসার বলেন, ‘‘ধরা যাক, জায়গাটিকে ১১০ সেন্টিমিটার উঁচু করা হলো৷ তখন সেন্ট মার্ক্স চত্বর আর পানির নীচে চলে যাবে না৷ কারণ ১১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বন্যা এড়ানো যাবে৷ উচ্চতা আরো বাড়লে মোজে তা সামলে নেবে৷ মোটকথা সেন্ট মার্ক্স চত্বরে আর কখনো বন্যা দেখা যাবে না৷''
সেইসঙ্গে সাহসেরও প্রয়োজন৷ উমগিসার মনে করিয়ে দিলেন, যে গত দেড়শো বছরে ভেনিস ২০ সেন্টিমিটার নেমে গেছে৷ অতিরিক্ত পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণেই এমনটা ঘটেছে৷ তবে সেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তরই ভেনিসকে সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচাতে পারে৷ গেয়র্গ উমগিসার বলেন, ‘‘যে পানি পাম্প করে বার করা হয়েছে, সেটা আবার পাম্পের মাধ্যমে জমিতে ফিরিয়ে দিলে ভেনিস সত্যি আবার ৩০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে যেতে পারে৷ অর্থাৎ গত দেড়শো বছরে আমরা যে ৩০ সেন্টিমিটার হারিয়েছি, হবহু সেই আগের অবস্থা – মানে শূন্যে পৌঁছানো যাবে৷''
তবে এই সমুদ্র গবেষকের মতে, ভেনিস অনন্তকাল টিকে থাকতে পারবে না৷ কোনো এক সময়ে উপহ্রদটিকে সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করতেই হবে৷ তখন ভেনিসের মানুষকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ এর কারণ ব্যাখ্যা করে উমগিসার বলেন, ‘‘দুটিই রক্ষা করা সম্ভব নয়৷ কোনো একটির প্রতি মনোযোগ দিতে হবে৷ উপহ্রদ নাকি শহর হিসেবে ভেনিস রক্ষা করা উচিত? অবশ্যই ভেনিস৷ ভেনিস একটাই আছে৷''
কঠিন সিদ্ধান্ত বটে৷ ভেনিসের মানুষ যত দেরিতে সম্ভব সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশা করছেন৷
গুস্তাফ হোফার/এসবি