‘বাংলাদেশে ধর্মীয় আইন মেনে শুধু বিয়েটাই হয়’
১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মের স্বাধীনতা কতটুকু দেওয়া হয়েছে?
ড. শাহদীন মালিক: সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা পুরোপুরি আছে৷ সব সংবিধানে যেটা থাকে – সেটা হলো একটা শর্ত থাকে আইনসাপেক্ষে৷ এই আইনসাপেক্ষে ধর্মীয় স্বাধীনতা পুরোটাই দেয়া থাকে৷ ধর্মের নামে কেউ যদি হানাহানি করে বা রায়ট করে, সেক্ষেত্রে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রয়োগের ফলে এটা যাতে না হয়, সরকার আইন করে সেটা নিষিদ্ধ করতে পারবে৷
সংবিধানের সঙ্গে ধর্মীয় আইন কি সাংঘর্ষিক?
ধর্মীয় আইন আমাদের নেই৷ আমাদের সামাজিক জীবনে বা রাজনৈতিক জীবনে শুধু মাত্র বিয়ে, বিবাহবিচ্ছেদ, বাচ্চার ভরণপোষণ – এই ক'টা জিনিস শুধুমাত্র ধর্মীয় আইন দিয়ে চলে৷ আর পুরো ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা, কোনটা অপরাধ, সম্পত্তি কেনার আইন, চুক্তি আইন এমন হাজারো আইন আছে, যার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই৷ শুধুমাত্র বিয়ে এবং বিয়ে সংক্রান্ত বিধানগুলো ধর্মীয় আইন দ্বারা পরিচালিত হয়৷ এখন অবশ্য ওখানেও অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে৷
বাংলাদেশে কি নির্দিষ্ট কোনো ধর্মীয় আইন আছে?
বাংলাদেশে মুসলিমদের বিয়ে ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী হয়৷ হিন্দুদের বিয়ে হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী হয়৷ বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব ধর্ম অনুযায়ী মানা হয়৷ শুধুমাত্র এই বিয়ের জায়গায় ধর্ম মানা হয়৷ এটা যার যে ধর্ম তা অনুযায়ী হয়৷ এটা ইউরোপেও হয়৷ যেমন ধরুন ক্যাথলিসিজমে বলে বিবাহবিচ্ছেদ হবে না৷ তার মানে কি সেখানে বিবাহবিচ্ছেদ হচ্ছে না, হচ্ছে৷ এক অর্থে এই ছোট্ট জায়গাটা ধর্মীয় আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত৷ অ্যামেরিকায় গর্ভপাতে নিষেধাজ্ঞা আছে৷ এটা তো ধর্ম থেকে এসেছে৷
আমাদের দেশের ধর্মীয় দলগুলো শরিয়া আইনের কথা বলে৷ সংবিধান মেনে এর কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব?
এগুলো আমাদের দেশ থেকে একশ' বছর আগে উঠে গেছে৷ আমাদের যে ফৌজদারি আইন, তাতে খুন, ডাকাতি, চুরি এ সব থেকে দেড়শ' বছর আগেই ধর্ম চলে গেছে৷ আমাদের জমি কেনার যে আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর করা, চুক্তি করার যে আইন সেটা শরিয়াতে যা বলা ছিল, তার সঙ্গে এখন এই আইনের কোনো সম্পর্ক নেই৷
ধর্মীয় আইন বলতে কী বোঝায়? এটা কি নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের নাকি সব ধর্মের আইন?
মুসলমান যাঁরা তাঁরা শুধু বিয়েটা করে ইসলাম ধর্মের রীতি অনুযায়ী বা ধর্মীয় আইন মেনে৷ হিন্দুরা বিয়ে করে তাঁদের ধর্মীয় আইন মেনে৷ বাংলাদেশে যাঁরা বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান, তাঁরাও বিয়ে করে তাঁদের ধর্মীয় আইন মেনে৷ অর্থাৎ, শুধু বিয়েটা হচ্ছে ধর্মীয় আইন মেনে৷ এর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের পর বাচ্চা কার কাছে থাকবে সেটা শুধু ধর্মীয় আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত৷ আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে বিয়েটা তো হলো একটা ছোট্ট জায়গা৷ যে কারণেই হোক কোনো ব্যক্তি যদি বিয়ে না করেন, তাহলে তিনি সারা জীবনেও ধর্মীয় আইনের মধ্যে আসবেন না৷ সারা বিশ্বেই বিয়েতে যিনি যে ধর্মের তার একটা প্রভাব থাকে৷
সংবিধানে বাকস্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে৷ তাহলে ধর্মীয় নেতারা যেসব বক্তব্য রাখেন, সেটা তো অন্যায় কিছু নয়?
বাকস্বাধীনতা মানে তো ওটাই৷ বক্তব্য তো আপনি দিতে পারবেন৷ বক্তব্য দেয়ার ক্ষেত্রে দুনিয়ার সব দেশেই একটা সীমাবদ্ধতা থাকে? যেটা হলো আপনার বক্তব্যের কারণে যেন কোনো সহিংসতা, অপরাধ, আগুন জ্বালানো বা রায়ট না হয়৷ এটা সব দেশেই আছে, আমাদের দেশেও আছে৷ এছাড়া বাকস্বাধীনতার ওপর অস্বাভাবিক কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই৷
ধর্মীয় উসকানির বিষয়ে কি সংবিধানে কিছু বলা আছে?
এই ধরনের ছোট-খাট বিষয়ে কোনো দেশের সংবিধানেই কিছু বলা থাকে না৷ অ্যামেরিকার সংবিধানে সাতটি মাত্র অনুচ্ছেদ আর ১০ পাতা৷ সংবিধানে বড় দাগে কিছু নীতির কথা বলা থাকে৷ এ সব ছোট-খাট বিষয়ে থাকে না৷ বড় দাগে বলা থাকে যে রাষ্ট্রপতি থাকবে, পার্লামেন্ট থাকবে, বিচার বিভাগ থাকবে৷ আপনি বিয়ে কীভাবে করবেন সংবিধানে সেটা বলা থাকে না৷ উসকানিটা অপরাধ৷ কিন্তু সেটা থাকে অপরাধ আইনে৷ আপনি উসকানি দিলেন – অমুক লোককে মেরে ফেল, তার বাড়ি জ্বালিয়ে দাও বা তার গাড়ি ভেঙে ফেলো – এটা যে কারণেই আপনি বলেন, সেটা অপরাধ৷ আমাদের অপরাধ আইনেও এমনটা বলা আছে৷ সেটা ধর্মীয় কারণে হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, সেটা অপরাধ৷
সংবিধান অনুযায়ী ধর্ম চলবে নাকি ধর্মীয় আইন অনুযায়ী সংবিধান তৈরি হওয়া উচিত?
আমাদের কোনো আইনের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক নেই৷ শুধুমাত্র বিয়ে বা বিবাহবিচ্ছেদ ছাড়া৷ আমাদের কোনো আইনই দেড়শ' বছর ধরে নেই৷ আমাদের ধর্মের সঙ্গে সংবিধানের সম্পর্ক থাকবে – দেড়শ' বছর পর এ ধরনের প্রশ্ন অবাস্তব৷
আমাদের সংবিধানে তো ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' বলে একটা বিষয় আছে, তাই না?
এটা খুব ‘সিম্বলিক'৷ এটা দুনিয়ার অনেক দেশে আছে৷ অ্যামেরিকায় সবকিছু শুরু হয় ‘ইন গড উই ট্রাস্ট' বলে৷ আমরা যেমন বিসমিল্লাহ বলে সবকিছু শুরু করি, তেমনি ওরা ‘ইন গড উই ট্রাস্ট' বলে শুরু করে৷ এটা সবদেশেই আছে, এটা সিম্বলিক অর্থে ব্যবহার করা হয়৷ অন্য অনেক দেশের মতো আমাদের সংবিধানেও এটা আছে৷
ফতোয়ার বিষয়ে কি সংবিধানে কিছু আছে?
ফতোয়া মানে কী? মানে হলো – একটা বিষয়ে মতামত৷ আপনার যদি কোনো সমস্যা হয়, তাহলে আপনি কোনো আত্মীয় বা বড় ভাইয়ের কাছ থেকে মতামত নেন না? এটা তেমনই মতামত নেয়া৷ এছাড়া ধর্মীয় ব্যাপারে যেটা বলা হয় – যেমন ধরুন আমার নামাজ পড়তে দেরি হয়ে গেছে বা কোনো সমস্যা হয়েছে, তার জন্য আমাকে রোজা রাখতে হবে কিনা – এ সব বিষয়ে লোকে মৌলভী সাহেবদের কাছে যায়৷ মৌলভী সাহেবরা তখন এ সম্পর্কে তাঁর মতামত কী হবে সেটা বলে দেন৷ এটাকেই বলা হয় ফতোয়া৷ ফতোয়া হলো ধর্মীয় ব্যাপারে একজনের কী করা উচিত, তা সম্পর্কে পরামর্শ নেয়া৷ এর সঙ্গে আইনের কোনো সম্পর্ক নেই৷
ধর্মীয় রীতি মেনে এখনো গ্রামে কিছু বিচার হয়৷ এর সাংবিধানিক কোনো ব্যাখা আছে?
দেশের আইন অনুযায়ী যে বিচার হয়, সেটা কোর্টে হয়৷ এ ব্যাপারে দেশের আইনে কিছু বলা নেই৷ এটাকে আমরা বলি সালিশ৷ যেমন মহল্লায় কোনো বিরোধ তৈরি হয়েছে৷ তখন সরাসরি কোর্টে না গিয়ে মহল্লার মুরুব্বিদের নিয়ে সালিশের মাধ্যমে সমস্যার নিষ্পত্তি করা হয়৷ এটা শুধু আমাদের দেশে না, সারা বিশ্বেই হয়৷ কিন্তু আমাদের দেশে যেটা হয়, সেটা পশ্চিমা গণমাধ্যমে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করা হয়৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷