১৭ বছরের দুঃখ ঘোচানোয় ধন্যবাদ ফেসবুক!
১৯ জানুয়ারি ২০২১পারিবারিক মিলনের অনুভূতি যে কতটা আনন্দদায়ক তা পরিবার থেকে দূরে থাকা সবাই জানে৷ আর আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি, তারা এই মিলনের গভীরতা যেন একটু বেশিই অনুভব করি৷ আর করোনাকালে পরিবারের সদস্যদের কাছাকাছি হওয়ার মতো আনন্দের খবর যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো অনেকটা৷ রেডিও, পত্রিকা, টিভি, ইন্টারনেট সর্বত্রই কেবল সংক্রমণ, মৃত্যু, হত্যা, দুর্ঘটনার মতো মন খারাপ করা নানা খবর! যে কারণে খুব প্রয়োজন ছাড়া টিভি দেখতে ইচ্ছে করে না৷ প্রায় এক বছর হতে চললো করোনা যেন জোঁকের মতো জাপটে ধরে আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে প্রায় পঙ্গু করে দিয়েছে৷
করোনার কারণে পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য হয়েছে বহু পরিবার, দেখা না হওয়ার যন্ত্রণায় ভুগছেন অনেকেই৷ ঠিক এ সময়ে একটি পরিবার দীর্ঘ ১৭ বছর পরে ফেসবুকের কল্যাণে আবার মিলিত হতে পেরেছে তা কতটা আনন্দের তা আমরা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছি৷ এত বছর আগে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটি ফিরে এসেছে মায়ের কোলে, একজন মায়ের কাছে এর চেয়ে বড় সুখানুভূতি আর কী হতে পারে!
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার বাগান উত্তরপাড় গ্রামের মেয়ে ২৫ বছর বয়সি তানিয়া আক্তার আট বছর বয়সে ঢাকায় বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে যায়৷ তবে সহৃদয় এক পরিবার মেয়েটিকে আপন করে নিয়ে বড় করেছে৷ এখন সে বিবাহিত ও সন্তানের মা৷ তানিয়ার বাবা-মা শত চেষ্টা করেও তাদের হারানো সন্তানকে তখন খুঁজে না পেলেও দেড়যুগ পরে এসে ফেসবুক সে অসাধ্য সাধন করেছে৷
বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তানিয়ার বাবা বলেন, ‘‘২০০৪ সালে তানিয়ার বয়স ছিল ৮ বছর; তখন তাকে ঢাকা বেড়াতে নিয়ে যাই৷ আমার ফুফুর আগারগাঁওয়ের বাসায় তাকে রেখে আমি গ্রামে চলে আসি৷ সেখান থেকে তানিয়া নিখোঁজ হয়৷ এ ঘটনায় আমি তেজগাঁও ও কোটালীপাড়া থানায় জিডি করি এবং পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিই৷ পরে বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করেও ওই সময় তানিয়াকে খুঁজে পাইনি৷ গত ৮ জানুয়ারি ফেসবুকে তানিয়ার ছোট বেলার ছবি ও সঙ্গে আমার, স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েদের নাম দেখে কোটালীপাড়ার ইমরান ঘরামীর স্ত্রী লাবণ্য ওরফে পলি আমাকে বিষয়টি জানায়৷ তিনি ফেসবুক থেকে আমার জামাতার মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করেন এবং ওইদিন রাতে মেয়ে জামাইয়ের সঙ্গে কথা বলে আমার মেয়ের সন্ধান পাই৷ পরের দিন আমরা ঢাকা যাই৷’’
তানিয়ার স্বামী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘‘বিয়ের পর থেকে তানিয়ার মা-বাবাকে খুঁজে পেতে অনেক চেষ্টা করছি৷ পরে ফেসবুকে তানিয়ার ছোট বেলার ছবি পোস্ট করি৷ এ সূত্রধরে তানিয়ার বাবা-মা তার সন্ধান পায়৷’’
হ্যাঁ, একসময় আমি ফেসবুকের ভীষণ ভক্ত ছিলাম কিন্তু আজকাল ফেসবুকের চেহারা অনেকটাই পাল্টে গেছে৷ যেমন খুশি তেমন সাজে নানা খবরাখবর প্রকাশ পায়, যার ফলে ফেসবুকের প্রতি আকর্ষণ অনেকটাই হারাতে বসেছিলাম৷ এই ক্রান্তিকালে তানিয়াকে পরিবারের কাছে ফিরে যেতে সহায়তা করে ফেসবুক তার গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দিলো৷
হারিয়ে যাওয়া মেয়ে ফিরে পাওয়ার আনন্দে তানিয়ার মা-বাবা এখন বাড়িতে আসা লোকজনকে প্রতিদিনই মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করছেন৷ পারিবারিক মিলনের আনন্দ আসলেই অন্যরকম!
আমার মনে আছে, ৮০র দশকে দেশে বেড়াতে যাওয়ার সময় আম্মা-আব্বার জন্য ছোট ছোট চকোলেট বা বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে যেতাম৷ সেগুলো থেকেই আমাকে দেখতে আসা অতিথিদের তারা একটু একটু করে খেতে দিতেন৷ আমার তখন মনে হতো ওগুলো চকলেট, বিস্কুট নয়, যেন টুকরো টুকরো ভালোবাসা৷ এসব ভালোলাগার পুরনো মিষ্টি স্মৃতি৷ পারিবারিক বন্ধন অনেক মধুর, আজকের এই আধুনিক যুগে তার অনেকটাই যেন মলিন !
হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজে পাওয়ার ঘটনাকে অনেক সময় গল্পের মতোই মনে হয়৷ হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার মানুষ বা পরিবারের সদস্যকে খুঁজে পাওয়ার গল্প নিয়ে জার্মান টিভিতে ১৯৯৩ থেকে ২০১১ পর্যন্ত nur die liebe Zählt বা ‘ভালোবাসাই সব' এই শিরোনামে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হতো, যা আমি তখন নিয়মিত দেখতাম৷ দীর্ঘ ১০,২০ বা ৩০ বছর পরে টিভি অনুষ্ঠানেই প্রিয়জনদের সাথে প্রথমে দেখা হতো টিভি চ্যানেলের উদ্যোগে৷ এত বছর আগে টিভিতে দেখা সেসব মিলনমেলার মুহূর্গুলোর কথা আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে৷