অযোধ্যা মামলার শুনানি শেষ
১৭ অক্টোবর ২০১৯৬ আগস্ট থেকে একটানা ৩৯ দিন ধরে প্রতিদিন চলছিল অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জমির অধিকারের মামলার শুনানি৷ এই বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়ার কাজ ১৮৮৫ সালে শুরু হলেও এখনও কোনো সুরাহা মেলেনি৷ এর মধ্যে আদালতে উঠেছে নানা পক্ষের নানা পিটিশন৷ ২০১১ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টে এই মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দিলে আবার ২০১৭ সালে নতুন করে মামলার শুনানি শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট, যা তখন সম্পূর্ণ হয়নি৷
নানা টালবাহানার পর চলতি বছরের ১৬ অক্টোবর শুনানি পর্যায়ের শেষ দিনে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত মধ্যস্থতাকারী কমিটি জানায়, যে আগামী ১৭ নভেম্বর মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হবে৷ এই মামলায় মসজিদের পক্ষে সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড ও মন্দিরের পক্ষে হিন্দু মহাসভা, নির্বাণী আখড়া ও রাম জন্মস্থান পুনরুদ্ধার সমিতি লড়ছে৷
মসজিদ ও মন্দিরপক্ষের মধ্যে বিতর্কিত দুই দশমিক ৭৭ একর জমির অধিকার বিষয়ে কোনো সমাধান না পাওয়া গেলে আগস্ট মাসে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত নতুন করে মধ্যস্থতাকারী কমিটি গঠন করে৷ এই প্যানেলে রয়েছেন জজ কলিফুল্লা, সিনিয়র অ্যাডভোকেট শ্রীরাম পাঞ্চু ও গুরু শ্রী শ্রী রবিশঙ্কর৷
১৯৯৩ সালে উত্তরপ্রদেশে জারি হয় রাষ্ট্রপতি শাসন৷ সেই সময় তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার বিতর্কিত দুই দশমিক ৭৭ একর জমিকে ঘিরে মোট ৬৭ দশমিক ৭০৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে, যার মধ্যে ছিল রাম জন্মভূমি ন্যাস সংগঠনের ৪২ একর জমি৷ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে আন্দাজ করা যাচ্ছে, হয়তো গোটা জমিটিই সরকারের হাতে তুলে দেবে আদালত৷ কিন্তু বিতর্কিত জমির দখল কার হাতে যাবে, সেটাই হবে নভেম্বরের রায়ের মূল বক্তব্য৷
কী থাকবে নভেম্বরের চূড়ান্ত ঘোষণায়, এই নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে নানা মতামত৷
মন্দিরের জয় কি নিশ্চিত?
আনন্দবাজার পত্রিকা বলছে, ‘‘সুপ্রিম কোর্টে মামলাতেও মোদী সরকার রামমন্দির তৈরির রাস্তা সহজ করার চেষ্টা করেছে৷’’ প্রেমাংশু চৌধুরী সেই সম্পাদকীয় প্রবন্ধে নজরে আনছেন অযোধ্যায় রামমন্দিরকে ঘিরে প্রচলিত নানা ধারণাকে৷ শুধু তাই নয়, প্রবন্ধে জোর দেওয়া হয়েছে মন্দির/মসজিদের রাজনীতিকে ঘিরে স্থানীয় মানুষের রুটিরুজির প্রশ্ন৷ তিনি বলছেন, ‘‘অযোধ্যাবাসীর আশা— রাম মন্দিরের হাত ধরে রুটিরুজি আসবে৷ রাম মন্দির হলে অবশ্য গোটা দেশেই হিন্দু-আবেগ উস্কে দেওয়া হবে৷ চাকরির অভাব, গাড়ি কারখানায় ছাঁটাই থেকে নজর সরে যাবে৷ আর যদি রাম মন্দিরের বিরুদ্ধে রায় আসে, তা হলে গোটা সঙ্ঘ পরিবার ফের রাম মন্দির আন্দোলনে মাঠে নামবে৷ সে ক্ষেত্রেও রুটিরুজির সমস্যা থেকে নজর সরে গিয়ে ফের দেশের প্রধান চর্চার বিষয় হয়ে উঠবে আড়াই হাজার বছরের পুরনো এক মহাকাব্য৷’’
মন্দিরপক্ষের জয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে বর্তমান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ৷ সেখানে বলা হচ্ছে, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের শুনানির পাশাপাশি মধ্যস্থতাকারী কমিটির রিপোর্টে চূড়ান্ত কিছু জানানো হয়নি৷ কিন্তু ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, সরকার যদি বাবরি মসজিদের জমি অধিগ্রহণ করেও নেয়, তাহলে আপত্তি করবে না ওয়াকফ বোর্ড৷’’ অন্যদিকে, আনন্দবাজারে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে রয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা সাক্ষী মহারাজের একটি উদ্ধৃতি৷ সেখানে তিনি বলেন, ‘‘প্রভু রামের পক্ষেই রায় আসবে৷ ৬ ডিসেম্বর বা তার আগেই রামমন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হবে৷ এ বছর দু'বার দীপাবলি হবে৷’’ প্রসঙ্গত, বাবরি মসজিদের কাঠামো ভাঙা হয় ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর৷
ইংরেজি সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি জোর দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্যে, যার নির্বাচনি ইশতাহারে প্রতিবারই উঠে এসেছিল রাম মন্দির নির্মাণের কথা৷ মোদী বলেছেন, ‘‘সরকার হিসাবে আমাদের দায়িত্ব যাই হোক না কেন, আমাদের ইশতেহার অনুযায়ী এই বিষয়ে আমরা সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাব৷’’
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস একটি প্রতিবেদনে তুলে এনেছে ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্গত প্রাসঙ্গিক বিধান৷ সেখানে উঠে এসেছে ১৯৯১ সালের ধর্মীয় উপাসনার স্থান বিষয়ক আইনি ধারা৷ সেই প্রতিবেদনে রয়েছে জামায়াত উলেমা-ই-হিন্দের প্রধান মৌলানা আরশাদ মাদানীর বক্তব্য৷ তিনি বলেছেন, ‘‘শরিয়া আইন অনুযায়ী, মুসলমানদের মসজিদের মর্যাদা পরিবর্তন করার কোন অধিকার নেই৷ কারণ এটি বিচারের দিন পর্যন্ত সর্বদা ইবাদতের জায়গা হিসাবে রয়েছে৷ সুতরাং মুসলমানরা এই মসজিদের জমির অধিকার অন্যত্র সমর্পণ করে তাকে অন্য কোনও জায়গায় নিয়ে যেতে পারে না৷’’
হিন্দি-ইংরেজি-বাংলা সব মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে উত্তরপ্রদেশ তথা ভারতের একাধিক হিন্দু সংগঠনের অযোধ্যা মামলা বিষয়ে আগাম উচ্ছ্বাসের খবর৷ রয়েছে বিচ্ছিন্ন কিছু হিন্দু ও মুসলিম সংগঠনের আইনিপ্রক্রিয়ার প্রতি ক্ষোভের কথাও৷
রায় কোন পথে যাবে, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা এখনই না পাওয়া গেলেও, বিশেষজ্ঞরা আঁচ করছেন, মন্দির গড়ার জন্য হয়ত শেষ পর্যন্ত সরকার জমি দিতে বাধ্য হবেই৷ মধ্যস্থতাকারী কমিটি যে ‘সমঝোতা’র প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে পুরোপুরি খুশি নয় মন্দির বা মসজিদ কোনো পক্ষই৷ ফলে, রায় ঘোষণার পর উত্তপ্ত হতে পারে পরিস্থিতিত৷ তাই সবার নজর আপাতত ১৭ নভেম্বরের দিকে৷ উত্তেজনার আশঙ্কায় এর মধ্যে অযোধ্যায় ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা৷