1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

১২ বছরেও ‘বড়' হতে পারেনি বিপিএল

সামীউর রহমান
১৮ জানুয়ারি ২০২৪

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ পার করেছে ১২টি বছর, শুক্রবার শুরু হতে যাচ্ছে এই টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতার দশম আসর। লম্বা সময়ে বিতর্কই বেশি এই আয়োজন ঘিরে, এক যুগেও প্রতিযোগিতাটি পায়নি স্থিতিশীলতা এবং প্রত্যাশিত গ্রহণযোগ্যতা।

https://p.dw.com/p/4bQDM
২০২৪ সালের বিপিএল ট্রফির সঙ্গে অধিনায়কেরা
আর্থিক কোনো নীতিমালা না থাকায় অনেকসময় বিপিএল এর দলগুলো ভারসাম্যপূর্ণ হয় নাছবি: Bangladesh Cricket Board

১৮ জানুয়ারি ২০১২ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টি-টোয়েন্টি লিগ পরিচালনার জন্য ৬ বছর মেয়াদে ৩৫০ কোটি টাকার চুক্তি করেছিল গেম অন স্পোর্টস গ্রুপের সঙ্গে। ১৯ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে তাই বলা যায় ১২ বছর পূর্ণ করছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, যে তারিখে শুরু হচ্ছে প্রতিযোগিতাটির দশম সংস্করণ। ১৯ জানুয়ারি ঢাকার শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস বনাম দুর্দান্ত ঢাকার ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে বিপিএলের নতুন আসর। ১২ বছরে বিশ্ব দেখেছে অনেক পরিবর্তন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উত্থান, জীবনযাত্রায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব বৃদ্ধি, লিওনেল মেসির হাতে অবশেষে বিশ্বকাপ...অনেক কিছুই সময়ের পরিক্রমায় যোগ হয়েছে মহাকালের খেরোখাতায়। এই কালপ্রবাহের মাঝেও বিপিএল এখনো যেন ‘প্রাগৈতিহাসিক'। সেই একই বৈশিষ্ট্য টুর্নামেন্টটি ধরে রেখেছে বছরের পর বছর। এখনো বিপিএল মানেই বিতর্ক, বিপিএলের নতুন আসর মানেই উটকো ভুইফোঁড় কিছু মানুষের মৌসুমী ক্রিকেটপ্রেমী বনে যাওয়া। ক্রিকেটাররাও ভাড়াটে সৈনিকের মতো একেক বছর গায়ে তোলেন একেক দলের উর্দি। ধ্রুবক হয়ে থেকে যায় শুধু দল মালিকের আরামকেদারা। বিপিএল খুব সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ, যেখানে দল মালিকরা ডাগআউটে খেলোয়াড়দের বসার জায়গার পাশে সোফায় বসতে পারেন। সেখানে বসে তারা খেলা উপভোগ করেন আর ক্যামেরার লেন্স তাদের বার বার খুঁজে ফেরে।

চরিত্রে ‘প্রাগৈতিহাসিক' হলেও কাঠামোতে বিপিএল গিরগিটির মতোই, বদলেছে বছর বছর। প্রথম দুই বছর গেম অন নামের এক ভুইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের হাতে ছিল বিপিএল পরিচালনা, ফ্র্যাঞ্চাইজি বিক্রিসহ সবকিছুর দায়িত্ব। এরপর খেলোয়াড়দের পাওনা বকেয়া, ম্যাচ পাতানোর কেলেংকারি, নানান অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনায় বিসিবি সমস্ত চুক্তি ছিন্ন করে গেম অনের সঙ্গে। দেয়া হয় নতুন করে ফ্র্যাঞ্চাইজি সত্ত্ব। এসবের মাঝে কেটে যায় একটা বছর, তাই ২০১৪ সালে হয়নি কোনো বিপিএল। নতুন করে ফ্র্যাঞ্চাইজি দেয়া হলেও টুর্নামেন্টটি স্থিতিশীলতা পেলো না। ২০১৫ সালের বিপিএলে ছিল ৬ দল, পরের বছর রাজশাহী ও খুলনা যুক্ত হওয়াতে এবং সিলেট বাদ পড়াতে দল সংখ্যা বেড়ে হলো ৭। পরের আসরে আবার সিলেট যোগ হলো, কিন্তু বরিশাল বাদ গেল। এভাবে ভাঙা-গড়ার খেলা চলেছে, খেলোয়াড়দেরও ঠিকানা বদলেছে বছর বছর। নড়াইলের ছেলে মাশরাফী বিন মোর্তজা প্রথম দুটো আসরে খেলেছেন ঢাকার হয়ে, এরপর দুই আসর কুমিল্লার হয়ে, এরপর রংপুর। এখন খেলছেন সিলেটে। মাঝে বঙ্গবন্ধু বিপিএলে খেলেছেন ঢাকার হয়েও। ময়মনসিংহের মাহমুদউল্লাহও শুরুতে ছিলেন চট্টগ্রামে, এরপর বরিশাল হয়ে গেলেন খুলনায়। এখন আবারও তরী ভিড়িয়েছেন বরিশালেই। বগুড়ার মুশফিকুর রহিম শুরুটা রাজশাহীতে করলেও এরপর সিলেট, বরিশাল, সিলেট ঘুরে এবারে ফের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছেন বরিশালেই। মাগুরার সাকিবের শুরুটা খুলনায় হলেও এরপর ঢাকা, রংপুর, ঢাকা, বরিশাল হয়ে এবার ফের রংপুরের তাঁবুতে।

দেশের প্রেক্ষাপটে আমরা একটি টেকসই বিপিএল করতে চাচ্ছি: নিজামউদ্দিন চৌধুরি সুজন

ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক আয়োজনে সমর্থকেরা খোঁজে নিজেদের অঞ্চলের দল অথবা প্রিয় খেলোয়াড়। ঝাড়খন্ডের মহেন্দ্র সিং ধোনি আইপিএল-এ চেন্নাই সুপার কিংসের সঙ্গে এতটাই জুড়ে গেছেন যে, তাদের আর আলাদা করার উপায় নেই। চেন্নাই সমর্থকদের কাছে ধোনি 'থালা' বা নেতা। তেমনি দিল্লির ছেলে বিরাট কোহলি সেই যুব বিশ্বকাপ জিতে আসার পর থেকেই যে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর সঙ্গী, এখনো শিরোপা জিততে না পারলেও কোহলি আরসিবি ছেড়ে অন্য কোথায় যেতে চান না। দিল্লির ছেলে শাহরুখ খান মুম্বাইতে ছবি করে 'বাদশাহ' হয়েছেন, আইপিএলে কিনেছেন কলকাতার ফ্র্যাঞ্চাইজি, যে শহরের সঙ্গে তার আদতে কোনো সম্পর্ক নেই। এখনকার কলকাতা নাইট রাইডার্স দলে বাংলাভাষী কাউকে খুঁজে পেতেও কষ্ট হবে। কিন্তু 'কলকাতা' নামটার জন্যই শহরের মানুষেরা সোনালি-বেগুনি জার্সিটা গায়ে দিয়ে ইডেনে যান, রিংকু সিং আর ভেংকাটেশ আইয়ারদের জন্যই গলা ফাটান। বিপিএলে এই দুই সমীকরণের কোনোটাই মেলেনি। না দলগুলোর মালিকানা দীর্ঘমেয়াদে ছিল যে তারা একটা পরিচিতি তৈরি করবে, না ছিল লম্বা সময়ের জন্য কোনো আইকন খেলোয়াড় যার টানে দর্শকেরা মাঠে আসবেন।

ফ্র্যাঞ্চাইজি'র যে ব্যবসায়িক তত্ত্ব, বিপিএলে সেটা চূড়ান্তভাবেই অনুপস্থিত। দিনশেষে যে এটি একটি ব্যবসা এবং এখানে লাভ-ক্ষতির অংকটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা না বুঝে অনেকেই বিপিএলে দল চালাতে এসেছেন। কেউ অনুরোধে ঢেঁকি গিলেছেন। কখনো রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাও ছিল কোনো দলের নেপথ্যে। কিন্তু পাশা পাল্টাতেই সুর বদলেছে। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ছিলেন সিলেট সিক্সার্স দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তার জীবদ্দশায় সিলেট ফ্র্যাঞ্চাইজিটি বিপিএলে অংশ নিলেও তিনি মন্ত্রীত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পর সিলেট সিক্সার্সও হারিয়ে যায়। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামালের মেয়ে নাফিসা কামাল আছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স ফ্র্যাঞ্চাইজির চেয়ারপার্সন হিসেবে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মোস্তফা কামাল সাংসদ হলেও মন্ত্রীত্ব পাননি। বিপিএলের নতুন আসর শুরুর আগে নাফিসাও বলেছেন, বিপিএলের রাজস্বের ভাগ না পেলে সামনের মৌসুম থেকে আর দল পরিচালনা করবেন না, ‘‘আসলে ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টের যে কনসেপ্ট, আমাদের বিপিএলে তা একদমই প্রযোজ্য নয়। একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি সাধারণত যে রাইটসগুলো পায়, আমরা সেগুলোর কিছুই পাই না। শুধু ভালোবাসা থেকে এটা সম্ভবই নয়। কিন্তু স্পন্সর তো আমাদেরকে পেতে হয়, আর্থিক দিকগুলি ঠিক রাখতে হয়। আমাদের টাকাটা তো আনতে হবে। নিজেদের পকেট থেকে তো পুরো বিপিএল চালাতে পারবো না। এটা খুব মিথ্যা হবে যদি আমি বলি যে, আমাদের পকেট থেকে পুরো বিপিএল চালাচ্ছি। এটা সম্ভবই নয়। শতভাগ, থাকবো না। টিকেট রাইটস, গ্রাউন্ডস রাইটস, মিডিয়া রাইটস– এই তিনটারই ভাগ চাই'', এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন নাফিসা।

বিপিএল এর প্রস্তুতি নিচ্ছেন ক্রিকেটারেরা
ফ্র্যাঞ্চাইজি'র যে ব্যবসায়িক তত্ত্ব, বিপিএলে সেটা চূড়ান্তভাবেই অনুপস্থিত।ছবি: Mosaraf Hossain

১৭ জানুয়ারি বুধবার, ২০২৪ সালের বিপিএলের টাইটেল স্পনসর ঘোষণার অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান তানভীর আহমেদ টিটো। তার কাছে নাফিসা কামালের এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি মাইক্রোফোন এগিয়ে দেন বিসিবি'র প্রধান নির্বাহী নিজামউদ্দিন চৌধুরি সুজনের দিকে। বিসিবির সিইও বলেছেন, ‘‘আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আমরা একটি টেকসই বিপিএল করতে চাচ্ছি। সেটা শুধু ক্রিকেট বোর্ডের জন্য নয়, এটা সব ফ্র্যাঞ্চাইজির জন্যও। যে সমস্ত লভ্যাংশ ভাগের মডেলকে উদাহরণ হিসেবে আনা হচ্ছে, সেই লীগগুলোতে কিন্তু ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি বলেন বা অন্যান্য আর্থিক কাঠামো অনেক উপরে। তারা যে মডেলে করছে আমরা সেই মডেলে যাচ্ছি না আর সেটা আমাদের জন্য টেকসই হবে না ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি সহ আর্থিক দিক বিবেচনায়। সেক্ষেত্রে এটা তুলনা-যোগ্য নয়। আমরা আমাদের বাজার ও সীমাবদ্ধতা অনুযায়ী এটা করি। এ বিষয়ে লভ্যাংশ ভাগে বোর্ডের আগে যে অবস্থান ছিল, এখনও সেটাই। এখন পর্যন্ত লভ্যাংশ ভাগের যে মডেল সেটা আমরা ওভাবে যাচ্ছি না, চিন্তাও করতে পারছি না বর্তমান প্রেক্ষাপটে। এর বাইরে গেলে আমাদের জন্য বিষয়টা সামলানো কঠিন হবে। আমার মনে হয়, আমরা ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর সঙ্গে আলাদা করে বসলে তাদের বোঝাতে সক্ষম হবো যে, আমরা কী মডেল করছি আর অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগগুলো কী মডেলে হচ্ছে। এটা হলে আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, তারা তাদের অবস্থান থেকে সরে আসতে পারবে।''

বিপিএলের প্রথম দুই আসর নানান কারণে ‘কলঙ্কিত' হবার পর নতুন করে যখন ২০১৫ সালে ফ্র্যাঞ্চাইজি স্বত্ব দেয়া হয়, তখন দেশের বেশ কয়েকটি বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানই এগিয়ে এসেছিল দলের মালিকানা নিতে। বেক্সিমকো গ্রুপ, ডিবিএল গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ এর মতো শীর্ষ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ করে। কিন্তু বিনিয়োগের বিনিময়ে প্রাপ্তি যথার্থ না হওয়াতে সরে গেছে বেক্সিমকো এবং ডিবিএল, বসুন্ধরা সরে দাঁড়ালেও সম্প্রতি ফিরে এসেছে। ব্যবসায়িকভাবে আকর্ষণীয় না হওয়াতে বিপিএলের দলগুলোর মালিকানা বেশিরভাগ সময় গেছে ভুইফোঁড় প্রতারকদের হাতে, যারা নানান রকম আর্থিক অনিয়মের সঙ্গেও জড়িত।

ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের মালিক সেলিম চৌধুরি, রংপুর রাইডার্সের সাবিক মালিক মিজানুর রহমান এবং কাজী এরতেজা হাসান, চিটাগং কিংসের সামির কাদের চৌধুরিসহ অনেকেই নানান আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত। অনেকেই বিপিএলের সুবাদে পাওয়া খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে বিস্তৃত করেছেন প্রতারণার জাল। এই ব্যপারে বিপিএলের প্রথম দুই আসরের গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব সিরাজউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর জানান, ‘‘প্রথমে যখন আমরা ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলটা চালু করতে চেয়েছি, তখন যে প্রতিবন্ধকতাটার আমরা মুখোমুখি হয়েছি তা হচ্ছে মানুষ তখন ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলটাই বোঝেনি বা বুঝতে চেষ্টা করেনি। তখন আইপিএল ছাড়া ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেলের অন্য কোনো বড় ইভেন্ট ছিল না। এ কারণে আমাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে বিনিয়োগকারীদের এটা বোঝাতে হয়েছে যে, এটার মডিউলটা কী বেনিফিটটা কী। কেউ পার্সোনালি কিভাবে বেনফিটেড হবে, বাংলাদেশের ক্রিকেট কিভাবে বেনিফিটেড হবে। তখন অনেক বড় ব্যবসায়ীদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছি। কিন্তু তারা আগ্রহ দেখাননি। ফলে বাধ্য হয়েই প্রথম বছর আমাদেরকে এমন সব ফ্র্যাঞ্চাইজি, এমন সব ভুইফোঁড় প্রতারকদের কাছে ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানা বিক্রি করতে হয়, তাদের সক্ষমতার অভাব ছিল। তা না হলে টুর্নামেন্টটা মাঠে গড়ানোই সম্ভব হতো না।''

দশম আসরে এসেও কোনো আর্থিক মডেল যেমন দাঁড়ায়নি, তেমনি দাঁড়ায়নি খেলোয়াড় তৈরির সংস্কৃতিও। বেশিরভাগ বিপিএল দলেরই নিজস্ব কোনো অবকাঠামো নেই। টুর্নামেন্টের মাস দেড়েক সময়ের বাইরে তাদের কোনো অস্ত্বিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। থাকে না কোনো প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রম। সম্প্রতি সিলেট স্ট্রাইকার্স বোলার হান্ট করছে। পাকিস্তানের হারিস রউফ পিএসএলের দল লাহোর কালান্দার্সের ট্রায়ালস থেকেই উঠে এসেছেন, এখন তিনি টি-টোয়েন্টির অন্যতম সেরা বোলার। হার্দিক পান্ডিয়া, জসপ্রিত বুমরাহদের মতো প্রতিভাদের তুলে এনেছে আইপিএল দল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। বিপিএলের দলগুলোর বেশিরভাগেরই এ ধরনের কোনো কার্যক্রম কিংবা অবকাঠামোই নেই। খেলোয়াড় তালিকাও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। বিদেশি খেলোয়াড় নিবন্ধন উন্মুক্ত রাখা এবং ড্রাফটের বাইরে থেকেও খেলোয়াড় যোগ করার সুবিধা রাখায় যখন তখন দলে যে কেউ ঢুকে যাচ্ছে। গত আসরে নাসিম শাহ বিমানে ওঠার আগে ছিলেন খুলনা টাইগার্সের খেলোয়াড়, বাংলাদেশে আসতে আসতে তিনি হয়ে যান কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের খেলোয়াড়! খুলনা জানায়, টেকনিক্যাল কারণে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে! আসলে ড্রাফটের বাইরে সরাসরি চুক্তির সুযোগটা অনেকটা মাছের বাজারে দামাদামির মতোই। চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্সের এক কর্মকর্তার দাবি, ইংল্যান্ডের তারকা ব্যাটসম্যান ফিল সল্ট চট্টগ্রামের হয়ে খেলতে ম্যাচপ্রতি দাবি করেছেন ১৮ হাজার ডলার! আগের আসরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সও মোহাম্মদ রিজওয়ানকে দিয়েছে ম্যাচপ্রতি বড় অংক। বিদেশিদের পেছনে বড় অর্থ খরচ করলেও অবকাঠামো নির্মাণ কিংবা প্রতিভা অন্বেষণে অর্থ খরচ করতে দেখা যায় না ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোকে।

অনিয়মের অচলাবস্থা ভেঙে নতুন করে ফ্র্যাঞ্চাইজি দিতে গিয়ে মাঝে এক মৌসুম হয়নি বিপিএল, আর একটি মৌসুমে করোনা পরিস্থিতির কারণে বিদেশি ক্রিকেটারদের অনুপস্থিতিতে বিপিএলের বদলে আয়োজন করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপ। দেশের শীর্ষ এবং মাঝারি স্তরের ক্রিকেটাররা নিয়মিত খেলে আসছেন এই আসরগুলোতে। তবুও ঠিক টি-টোয়েন্টি মেজাজের কয়েকজন ক্রিকেটারকে খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ জাতীয় দল। এর অন্যতম প্রধান কারণ মিরপুর স্টেডিয়ামের উইকেট। ধীর গতির, নীচু বাউন্সের এই উইকেট একদমই টি-টোয়েন্টি মেজাজের সঙ্গে বেমানান। এই উইকেটে আগে ব্যাট করে ১২০ রান করলে সেটাই অনেক সময় জেতার মতো স্কোর হয়ে দাঁড়ায়। টি-টোয়েন্টি মানেই চার ছক্কা, অনেক বেশি রান আর সেই রান তাড়ায় শেষ বলের রোমাঞ্চ। কিন্তু বিপিএলের বেশিরভাগ ম্যাচেই থাকে না সেই উত্তেজনার ছোঁয়া। আর্থিক কোনো নীতিমালা না থাকায় দেখা যায় দলগুলোও হয় না ভারসাম্যপূর্ণ। তাই আসর হয় না জমজমাট।

বাধ্য হয়ে প্রথম বছর ভুইফোঁড় প্রতারকদের কাছে ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানা বিক্রি করতে হয়েছিল: সিরাজউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর

আইপিএলের সাফল্যে অনুগামী হয়ে বিশ্বের অনেক দেশেই এখন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ শুরু হয়েছে। বিপিএলের পরে চালু হলেও পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) এখন অনেক জমজমাট, পাকিস্তানের নিরাপত্তা ঝুঁকি কমে আসা ও বিশ্বের অন্যান্য জাতীয় দলগুলোও পাকিস্তান সফরে যেতে শুরু করায় কেটে গেছে ক্রিকেটার সংকটও। পিএসএলের সম্প্রচার মান, খেলার মান এবং রাজস্ব আয় সবই আইপিএলের পরেই। এছাড়াই আরব আমিরাতে আইএল টি-টোয়েন্টি, দক্ষিণ আফ্রিকার এসএ টোয়েন্টি, এই লিগগুলোতেও ডাক পাচ্ছেন ক্রিকেটাররা। তাই শীর্ষ কিংবা মাঝারি মানের ক্রিকেটারদেরও প্রথম পছন্দ বিপিএল নয়। একই সময়ে একাধিক লিগ চলার কারণে বাংলাদেশে আসতে অনাগ্রহ থাকে অনেকেরই। শেষ পর্যন্ত কিছু অখ্যাত শ্রীলঙ্কান ও আফগান ক্রিকেটারদের সঙ্গে জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ড এসব দেশের ক্রিকেটারদেরই বেশি দেখা যায় বিপিএলে। অন্যান্য লিগের সময় সূচীর সঙ্গে মিলিয়ে আগে কিংবা পরে পাওয়া যাবে পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকা বা ইংল্যান্ডের তারকাদের। শ্রীহীন দশার কারণে বৈশ্বিক দর্শককূলেও খুব একটা আগ্রহ নেই বিপিএলকে নিয়ে।

সম্প্রচারে অবশ্য আধুনিকতার ছাপ এসেছে এবারে। ধারাভাষ্য কক্ষে কার্টলি অ্যামব্রোস, রমিজ রাজা, আমির সোহেলদের দেখা মিলবে বলে জানানো হয়েছে। শুরু থেকেই থাকবে ডিআরএস। ক্যামেরার সংখ্যাও বেড়েছে। বিসিবির গ্রাউন্ডস কমিটির প্রধান মাহবুব আনাম আশ্বাস দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান কিউরেটর টনি হেমিংয়ের তত্বাবধানে এবারে উন্নত মানের উইকেট হবে বিপিএলে। এসব একেবারে মৌলিক স্তরের চাহিদা যেটা ১২তম বছরে এসে পূরণ করা হচ্ছে।

অথচ সম্ভাবনা ছিল অনেক। বাংলাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তায় ভেসে সাংসদ হয়েছেন জাতীয় দলের বর্তমান ও সাবেক একাধিক ক্রিকেটার। বিজ্ঞাপণের বাজারে মডেল হিসেবে ক্রিকেটাররাই চাহিদাসম্পন্ন। দোকানের উদ্বোধনেও ক্রিকেটারকেই চাই। কিন্তু বিপিএলের বেলায় অদ্ভুত বৈপরীত্য। দই ভেবে চুন খেয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেলার অভিজ্ঞতাই হোক কিংবা অধিকার হাতছাড়া হয়ে যাবার ভয়, যে কোনো কারণেই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বিপিএলের ব্যপারে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল। বিপিএলের গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিক তো বলেছেনই যে বিপিএলে বিদেশি দল মালিক দেবেন না। অথচ সিপিএল, আইএল টি-টোয়েন্টি, এসএ টোয়েন্টি,মেজর লিগ ক্রিকেট এসব আসরে আইপিএলের দলমালিকরাই বিনোয়োগ করছেন। মুম্বাই ইনডিয়ানস, নাইট রাইডার্স ভারতের বাউন্ডারি ছাড়িয়ে চলে গেছে ক্যারিবিয়ানে, আফ্রিকায়, মার্কিন মুল্লুকে। পুরোনো দিনের ধ্যানধারণা, অতিমাত্রায় হস্তক্ষেপের প্রবণতা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে সম্ভাবনা থাকা স্বত্বেও ১২ বছরে বিপিএল কোন ব্র্যান্ড হয়ে উঠতে পারেনি। বিদেশি ক্রিকেটারদের কাছেও হয়ে উঠতে পারেনি আকর্ষণীয় একটি গন্তব্য। দলগুলোর গড়ে ওঠেনি কোনো পরিচিতি, হয়নি কোনো সমর্থক গোষ্ঠী। লিটন দাস এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এভাবে চললে বিপিএল একসময় ঢাকা (প্রিমিয়ার) লিগ হয়ে যাবে। একটা সময় আবাহনী-মোহামেডানের দ্বৈরথ এবং ব্রাদার্স,কলাবাগান, বিমান, ভিক্টোরিয়া এসব দলগুলোর প্রতিদ্বন্দিতায় ঢাকা লিগ ছিল জমজমাট। খেলতে এসেছেন ওয়াসিম আকরাম, অর্জুনা রানাতুঙ্গা, রমন লাম্বা সহ অনেক তারকা ক্রিকেটার। কিন্তু রাজনীতির প্যাঁচে ঢাকা লিগও এখন প্রাণহীন। বিপিএল একই পথে হাঁটছে সেই আশঙ্কা লিটন সহ অনেকেরই। যার প্রমাণ বিগত ৯ আসরে ২৭টা ফ্র্যাঞ্চাইজির অংশগ্রহণের পর এবার ১০ আসরে ২৮তম ফ্র্যাঞ্চাইজি হিসেব মাঠে দেখা যাবে দূর্দান্ত ঢাকাকে। এই ৯ বছরে একেক জন ক্রিকেটার দল বদলেছেন অন্তত ৫-৬ বার।

একটা সময় বোর্ড কর্তারা বলতেন, আইপিএলের পরেই বিপিএল। বক্তব্যটা কতটা সত্যি সেটা জানা হয়ে গিয়েছে সবারই। বিপিএল হতে পারে অব্যবস্থাপনার চরম নিদর্শন অথবা ব্যর্থতার উদাহরণ। অনুপযোগী উইকেট, একই মাঠে দিনে দুটো করে (একবার তিনটাও) ম্যাচ আয়োজন, খেলোয়াড়দের পাওনা বকেয়া, ডিআরএস বিতর্ক, মাঠে অখেলোয়াড়চিত আচরণ, পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিং...কোন কোন ব্যপারগুলো এড়িয়ে গেলে একটা আয়োজন সফল করা সম্ভব; বিপিএল হতে পারে তার কেস স্টাডি।

প্রায় ১ যুগ ধরে চলে আসা একটি আয়োজনে এত বিতর্কের উল্টোপিঠে প্রাপ্তি সামান্যই। দর্শকরা ক্রিস গেইল, এবি ডি ভিলিয়ার্স, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, লাসিথ মালিঙ্গা, আন্দ্রে রাসেলদের মত বৈশ্বিক তারকাদের দেশের মাটিতে খেলতে দেখেছেন। বাংলাদেশের কিছু ক্রিকেটার তাদের সঙ্গে এবং বিপক্ষে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়ের প্রাপ্তিযোগ হয়েছে। মালিকপক্ষ টিভিতে চেহারা দেখিয়ে আর পত্রিকায় নিজেদের ছবি দেখে বাহবা কুড়িয়েছেন। এসবের বাইরে বিপিএল থেকে বড় কোন প্রাপ্তি নেই। না পাওয়া গেছে নতুন কোন ক্রিকেটার, না হয়েছে কোন অবকাঠামো। সব মিলিয়ে বিপিএল যেন সেই ভগ্নদশার চুন পলেস্তারা খসে যাওয়া বাড়িটা, অনেক স্বপ্ন নিয়ে যার নির্মাণ শুরু হলেও নানান কারণে কাজের গতি কমতে কমতে প্রায় থেমেই গেছে। দেয়ালে জমেছে শ্যাওলা। অথচ একটু যত্ন, একটু পরিকল্পনা আর রক্ষণাবেক্ষণ করলেই এই বাড়িটাই হতে পারত স্বপ্নের সৌধ।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য