হেফাজতে মৃত্যুর দায় এড়াতে তৎপর পুলিশ
২২ আগস্ট ২০২২কিন্তু দেশের প্রচলিত আইনে হেফাজতে যেকোনো ধরনের মৃত্যু এবং নির্যাতনই অপরাধ৷ এরজন্য প্রথমেই মামলা নিতে হবে৷ মামলা না নেয়াও একটি অপরাধ বলে জানান আইন বিশ্লেষকেরা৷
সুমনের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, সুমনকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ সুমন রামপুরার যে প্রতিষ্ঠানের শোরুমে ভ্যান চালকের কাজ করতেন সেই প্রতিষ্ঠানের চুরি যাওয়া ৫৩ লাখ টাকায় দায় এড়াতে ওই শোরুমের ম্যানেজার পুলিশকে দিয়ে সুমনকে হত্যা করিয়েছে বলে তার পরিবারের অভিযোগ৷
চুরির মামলাটি হয় ১৫ আগস্ট৷ মামলার এজাহারে সুমনের নাম নেই৷ মামলার পর শোরুমের ক্যাশিয়ারসহ তিনজনকে আটক করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ৷ থানার ওসি আবদুর রশিদ দাবি করেন, তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৯ আগস্ট সুমনকে আটক করা হয়৷ রাতে তাকে নিয়ে অভিযান চালিয়ে চালিয়ে তার বাসা থেকে তিন লাখ টাকাও উদ্ধার করা হয়৷ দিবাগত রাত তিনটার দিকে তিনি থানা হাজতে নিজের ট্রাউজার খুলে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন৷ পুলিশ রোববার এ সংক্রান্ত সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সাংবাদিকদের দিয়েছে আত্মহত্যা প্রমাণের জন্য৷ কিন্তু সুমনের শ্যালক মোশাররফ হোসেন জানান,"ওই ফুটেজ আমাদেরও ডেকে নিয়ে দেখানো হয়েছে৷ কিন্তু তাতে সুমন যে আত্মহত্যা করেছে তা প্রমাণিত হয় না৷ কারণ ফুটেজে দেখানো হয়েছে সুমন লকআপের গেট বেয়ে উপরে উঠছে৷ সে অত্মহত্যা করেছে তার কোনো ফুটেজ নেই৷ তার কথা,"সুমনকে আটকের পর আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করতে দেয়া হয়নি৷ আমাদের থানায়ই ঢুকতে দেয়া হয়নি৷ মৃত্যুর পর আমরা হাসপাতাল মর্গ থেকে লাশ নিতে গেলে আমাদের শর্ত দেয়া হয় লাশ ঢাকায় নয়, গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করতে হবে৷ এখন আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি মামলা ও বিচার ছাড়া আমরা লাশ নেবো না৷ তাকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ সে চুরি করেনি৷ এটা একটা ষড়যন্ত্র৷ তাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে হত্যা করা হয়েছে৷”
তিনি বলেন,"থানা আমাদের মামলা না নেয়ায় রোববার আমরা আদালতে গিয়েছিলাম মামলা করতে৷ কিন্তু কোনো আইনজীবীর সহায়তা পাইনি৷ আজ (সোমবার) সকাল থেকে আমরা সিএমএম কোর্টে বসে আছি মামলা করার আশায়৷ কী হবে জানি না৷”
অবশ্য সোমবার হাতিরঝিল থানার ইন্সপেক্টর (অপারেশন) আব্দুল কুদ্দুস জানান বিকেলে হাসপাতপাতাল মর্গ থেকে লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে৷
আইনজীবীরা যা বলছেন:
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন,"এই ঘটনায় মামলা না নেয়াও একটা অপরাধ৷ ২০১৩ সালের হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যু নিবারণ আইন অনুযায়ী অবশ্যই মামলা নিতে হবে৷ এই মামলা থানা না নিলে এসপিকে নিতে হবে অথবা আদালত নেবেন৷”
তার কথা,"মৃত্যু কীভাবে হয়েছে সেটা তদন্তের বিষয়৷ আগে মামলা নিয়ে তারপর তদন্ত করে দেখতে হবে৷ যদি আত্মহত্যা হয় তাহলে কারুর প্ররোচণা ছিলো কী না, আত্মহত্যার মতো অবস্থা তৈরি করা হয়েছিলো কী না এসব তদন্তের বিষয়৷ এমনকী হেফাজতে মানসিক নির্যাতনও অপরাধ৷ এই আইন শুধু পুলিশ হেফাজত নয়, যেকোনো সরকারি কর্মকর্তার হেফাজতের বেলায়ও প্রযোজ্য৷”
সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন,"পুলিশ হেফাজতে যখন কেউ থাকেন তখন তার সব ধরনের নিরাপত্তার দায়িত্ব পুলিশের৷ থানা হাজতে আসামি থাকলে ২৪ ঘন্টা কমপক্ষে দুইজন পুলিশ সদস্যকে পাহারায় থাকতে হবে৷ আর ওই থানায় সিসি ক্যামেরাও আছে৷ সেটাও তো মনিটরিং হয়৷ তাহলে সুমন কীভাবে আত্মহত্যা করল৷ যদি সে আত্মহত্যা করেও থাকে তাহলে পুলিশের অবহেলার কারণেই সে আত্মহত্যা করেছে৷ এর দায় পুলিশকেই নিতে হবে৷”
তার কথা,"হত্যা না আত্মহত্যা সেটাতো তদন্তের বিষয়৷ তার আগে তো মামলা হতে হবে৷ আর আইন অনুয়ায়ী একজন ম্যাজিষ্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে তদন্ত হতে হবে৷ সেটা না করে আত্মহত্যার প্রচারণা উদ্দেশ্যমূলক৷”
তবে ডিএমপির তেজগাঁও জোনের ডেপুটি পুলিশ কশিনার আজিমুল হক বলেন,"আমরা অপমৃত্যুর মামলা করেছি৷ সেটার তদন্ত হবে৷ দায়িত্বে অবহেলার জন্য দুই পুলিশ সদস্যকে সাসপেন্ড করেছি৷ একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে যারা সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে৷ ”
তিনি বলেন,"ম্যাজিষ্ট্রেটের উপস্থিতিতেই লাশের সুরতহাল করা হয়েছে৷ আমাদের কাছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আছে৷ এটা স্পষ্ট আত্মহত্যা৷ তার শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নাই৷ কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি৷ আর ওই যুবক চুরির সঙ্গে জড়িত বলেও আমরা প্রমাণ পেয়েছি৷”
হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছে:
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশে ক্রসফায়ার কমলেও পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু বাড়ছে৷ চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দুইটি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে৷ কিন্তু হেফাজাতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ১১টি৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে গত বছর ২০২১ সালে ৫১ টি ক্রসফায়ার ও ২৯টি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে৷ ক্রসফায়ার বাদ দিয়ে ২০২০ সালে হেফাজতে মৃত্যু ২৪টি, ২০১৯ সালে হেফাজতে মৃত্যু ৩২টি, ২০১৮ সালে ৫৪টি এবং ২০১৭ সালে ৩৫টি৷ কিন্তু ২০১৩ সালে হেফাজতে নির্যাতন এবং মৃত্যু নিবারণ আইন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত মামলা হয়েছে মাত্র মাত্র ১৯টি৷ একটি মামলায় আসামিদের শাস্তি হয়েছে৷ ১৪টি মামলায় মামলা ত্রুটিপূর্ণ বলে চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে৷
আইনজীবী ইশরাত হাসান বলেন,"মানুষ এই আইনটি সম্পর্কে সচেতন নয়৷ আবার যারা মামলা করতে চান তারা নানা অসহযোগিতার কারণে মামলা করতে পারেন না৷”
আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু বলেন,"মামলা হলেও তার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া কঠিন৷ কারণ পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ ছাড়া সাধারণত আর কেউ থাকেনা৷ ফলে প্রমাণ করা কঠিন৷ আর পুলিশ চায় তাদের জড়িত সহকর্মীদের রক্ষা করতে৷”
এই দুইজন আইনজীবী বলেন, আইনের বিধান হলো মামলার বাদী, তার পরিবার ও সাক্ষীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা৷ সেটাও করা হয় না৷