রবীন্দ্র-ভাষণের পুনরুদ্ধার
২ জুন ২০১৪আজকের তারিখ থেকে ঠিক ৯৩ বছর আগে, ১৯২১ সালের ২রা জুন জার্মানির রাজধানী বার্লিনের হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়, তৎকালীন ফ্রিডরিশ ভিলহেল্ম ইউনিভার্সিটিতে একটি ভাষণ দিয়েছিলেন জার্মানি সফররত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ সারা জীবনে তিনবার জার্মানি গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ ১৯২১, ১৯২৬ এবং ১৯৩০ সালে৷ অর্থাৎ সেটি ছিল তাঁর প্রথম জার্মানি সফর৷ কিন্তু তখনই জার্মানি সহ গোটা ইউরোপে কবি, দার্শনিক এবং চিন্তাবিদ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে৷ তার আগে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন৷ তাঁর ব্যাপারে ইউরোপের আগ্রহ তখন তুঙ্গে৷ প্রাচ্যের ওই ঋষিপ্রতিম মানুষটি কী বলছেন, সবাই সেটা শুনতে চান৷
ফ্রিডরিশ ভিলহেল্ম ইউনিভার্সিটিতে প্রথমবার এই ভাষণটি রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন ১লা জুন এক অনুষ্ঠানে৷ কিন্তু যত মানুষ সেদিন তাঁর ভাষণ শুনেছিলেন, তার থেকে বেশি লোক সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন৷ ফলে সমবেত অনুরোধে, পরদিন, ২রা জুন আবার কয়েক হাজার শ্রোতার সামনে ভাষণটি দেন রবীন্দ্রনাথ৷ সেই সময় ফ্রিডরিশ ভিলহেল্ম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রথা ছিল, যত বিখ্যাত মানুষজন এসে ওখানে আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে এসে বক্তৃতা দিতেন, তাঁদের ভাষণের অংশবিশেষ রেকর্ড করে রাখা হতো৷ সেই মতো, ৪ঠা জুন বার্লিনের হোটেল এসপ্ল্যানেড-এ রবীন্দ্রনাথের ভাষণের শেষ অনুচ্ছেদটি রেকর্ড করা হয়েছিল৷
মূল রেকর্ডিংয়ের সেই গালার রেকর্ডটি এতদিন সযত্নে রক্ষিত ছিল বর্তমান হুমবোল্ট ইউনিভার্সিটির ‘লাউটআরশিভ' অথবা ধ্বনি সংরক্ষণাগারে৷ অতি সম্প্রতি ঐতিহাসিক ওই রেকর্ডিং আবার জনসমক্ষে আনা হলো৷ অবশ্য এই প্রথম নয়, এর আগেও রবীন্দ্রনাথের ভাষণের এই রেকর্ডিংয়ের কপি ভারতে এসেছে৷ ১৯৫৯ সালে, তৎকালীন পূর্ব জার্মানির প্রধানমন্ত্রী অটো গ্রোটেভোল যখন তাঁর দেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে সচেষ্ট, তখন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে একটি কপি পাঠিয়েছিলেন৷ তবে এবার এই ঐতিহাসিক পুনরুদ্ধারের পিছনে পুরো পরিশ্রমটাই কলকাতার জার্মান কনসাল জেনারেল রাইনার শ্মিডশেনের একার৷
ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগকে কনসাল জেনারেল শ্মিডশেন জানালেন, গত বছর ফরাসি দূতাবাসের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তাঁরা যে কমিক স্ট্রিপ কর্মশালা করেছিলেন, সেখানে এরকম একটি গল্প বেছে নেওয়া হয়েছিল যেখানে কলকাতার এক বাঙালি ছেলে জার্মানি গিয়ে নিজের দেশ এবং সংস্কৃতিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করছে৷ সেই গল্পেই ছিল, বার্লিনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, সংগ্রহশালায় রবীন্দ্রনাথের যেসব স্মারক আছে, ছেলেটি সেগুলির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে৷ শ্মিডশেন জানালেন, তাঁর নিজেরও তখনই জার্মানিতে সংরক্ষিত রবীন্দ্র-ঐতিহ্য সম্পর্কে আগ্রহ জন্মায়৷ বিশেষ করে হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভে রাখা রবীন্দ্র-ভাষণের ওই রেকর্ডিং সম্পর্কে তাঁর আগে থাকতেই জানা ছিল, যেহেতু শ্মিডশেন নিজে হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তনী৷
রাইনার শ্মিডশেন এবং তাঁর স্ত্রী এর পর নিজেরাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষণশালায় গিয়ে রেকর্ডটি খুঁজে বের করেছেন৷ কবি-কণ্ঠের সেই ঐতিহাসিক রেকর্ডিং এবং তার বয়ানের অনুলিপি যাতে রবীন্দ্র অনুরাগীরা শুনতে এবং পড়তে পারেন, সে জন্য কলকাতার জার্মান কনসুলেটের ওয়েবসাইটে অনলাইন রাখার ব্যবস্থা করেছেন৷ ওই ওয়েবপাতায় গেলেই পাওয়া যাচ্ছে দুটি লিঙ্ক এবং সেই সঙ্গে কিছু দুষ্প্রাপ্য ছবি৷
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বার্লিনের হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ধ্বনি সংরক্ষণাগারটি ১৯২০ সালে স্থাপনা করেছিলেন বিখ্যাত জার্মান ভাষাবিদ ভিলহেল্ম ড্যোগেন৷ বিংশ শতকের বহু বিশিষ্ট, বিখ্যাত মানুষের কণ্ঠের প্রায় ৭৫০০ রেকর্ডিং গালার রেকর্ডে বিধৃত আছে, যা শুধু জার্মানি নয়, সারা পৃথিবীর জন্যেই এক অমূল্য সঞ্চয়৷ এই সঙ্গে সংরক্ষিত আছে জার্মান ভাষার বিভিন্ন প্রাদেশিক কথ্যভাষার নমুনা-সহ বিশ্বের সবকটি বিদেশি ভাষার নমুনা, যার মধ্যে একটি ভাষা অবশ্যই বাংলা!