সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ সমাজের মুক্তি কোথায়
১০ অক্টোবর ২০১৭সভ্যতার আশীর্বাদকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই, কিন্তু সেটাই যেন পরমাণু বোমার মতো সভ্যতাকে আঘাত করতে চাইছে৷
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার হাবরার বাসিন্দা মাম্পি দাস একাদশ শ্রেণিতে পড়তো৷ ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে দিনভর বুঁদ থাকার জন্য অভিভাবকরা তাকে বকাবকি করেছিলেন৷ তাই সে আত্মহত্যা করে! মাম্পির ঘটনা ব্যক্তিগত স্তরে একটি মানুষের বিপন্নতাকে তুলে ধরছে৷ কিন্তু, এই সমস্যা যখন সমষ্টিকে স্পর্শ করে, তখন সঙ্কটের ব্যাপকতা ও গভীরতা অনেকটাই বেড়ে যায়৷ তখন তা আর বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, গোটা সমাজকেই বিপন্ন করে তোলে৷
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বাদুড়িয়ার একটি ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গেল৷ এলাকার এক তরুণ তাঁর ফেসবকু প্রোফাইলে একটি সম্প্রদায়ের ভাবাবেগে আঘাত দিতে পারে, এমন ছবি পোস্ট করেছিলেন৷ সেই পোস্ট ঘিরে উত্তাল হয়ে ওঠে বাদুড়িয়া৷ দশকের পর দশক যে এলাকায়, একেবারে পাশাপাশি হিন্দু-মুসলমানের বাস, সেখানে রাতারাতি পাল্টে যায় পরিস্থিতি৷ সত্যজিৎ রায় ‘আগন্তুক' ছবিতে উৎপল দত্তকে দিয়ে যে কথাটা বলিয়েছিলেন, সেটি এখানে প্রণিধানযোগ্য৷ প্রশ্ন ছিল, ‘‘আপনি ধর্মে বিশ্বাস রাখেন?'' উৎপল দত্ত জবাব দিয়েছিলেন, মানুষে মানুষে যা বিভাজন করে, তিনি তা মানেন না৷ তিনি মনে করেন, ধর্ম সেটা করে৷
ওই ফেসবুক পোস্টের সাহায্যে বাদুড়িয়ায় ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন তৈরি হয়ে গেল নিমেষে৷ পড়শিরা একে অপরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন৷ এতকালের একান্নবর্তী হয়ে বেঁচে থাকে, হাতে হাত মিলিয়ে এলাকার উন্নয়ন, বিপদে পাশে এসে দাঁড়ানোর ঐতিহ্য চোখের পলকে হারিকেন হার্ভে বা ইরমার মতো এসে ধর্মের ঝোড়ো বাতাস উড়িয়ে নিয়ে গেল খড়কুটোর মতো৷
বাড়ির এককোণে বসে, অলস মুহূর্তে একটা ছবি ও দুটো লাইনের ‘কমেন্ট' লিখে দিলেই এত বড় গন্ডগোলের জন্ম দেওয়া যায়৷ এটা দেখে উল্লসিত হলো হিন্দু ও মুসলিম মৌলবাদীরা৷ কী দরকার কানে-কানে গোপন প্রচার কিংবা কাগজের ফাঁকে লিফলেট বিলি করার! একটা ফেসবুকের এমন শক্তি যে, তা আমাদের ভিতরে থাকা সুপ্ত সাম্প্রদায়িকতাকে জাগিয়ে তুলতে পারে, এত সহজে৷ এই ঘটনাই প্রমাণ করে দিচ্ছে, সভ্যতার আশীর্বাদ এই মুহূর্তে কীভাবে সোশ্যাল নেটওয়ার্কের নামে আমাদের আজন্মলালিত মানবতার বন্ধন বা নেটওয়ার্ককে ধ্বংস করার চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে৷
মাম্পির মতো এ সময় ভারত-বাংলাদেশের একটা আস্ত প্রজন্ম, যারা এখন কৈশোরে, তাদের মধ্যেসোশ্যাল মিডিয়ার নেশা বাড়ছে কেন?মনোবিদ ডা. কামাল হোসেন বলেন, ‘‘এইভার্চুয়াল জগতটাকেছেলে-মেয়েরা বড় ভালোবেসে ফেলছে৷ তাই তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু, এই জগতের সবটাই সত্যি নয়৷ এর মধ্যে অনেক চোরাবালি আছে৷ ভুয়ো অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অসৎ উদ্দেশ্যে অনেকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে৷ তাদের ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে কৈশোর৷''
তা হলে সোশ্যাল মিডিয়ার কুপ্রভাব থেকে ছেলেমেয়েদের মুক্ত করার পথ কী? মনোবিদ ডা. কামাল হোসেনের মতে, এ জন্য দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবকদেরই৷ তিনি বলেন, ‘‘ওদের হাত থেকে স্মার্টফোন কেড়ে নিলে হিতে বিপরীত হবে৷ সেই কাজটি করবেন না৷ তাতে ওরা আরও বিপথে চলে যাবে৷ তা ছাড়া সভ্যতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে প্রযুক্তির সুবিধা নিতে হবে৷ তাই কঠিন কাজ হলেও অভিভাবকদেরই দেখতে হবে, ছেলেমেয়েরা গোপন জগতে কার সঙ্গে বাক্যালাপ করছে৷ এই নজরদারিটার প্রয়োজন আছে৷ তা হলে সমস্যা থেকে কিছুটা মুক্তি মিলতে পারে৷''
কোন অংশের পড়ুয়াদের ফেসবুকের পাগলামি বেশি গ্রাস করছে? এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নতুন একটি দিকে আলোকপাত করলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের এক শিক্ষক৷ ঘাটালের যোগদা সৎসঙ্গ শ্রীযুক্তেশ্বর বিদ্যাপীঠের শিক্ষক প্রভাস রায় বলেন, ‘‘বরাবরই পাঁচ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর মেধা বেশি৷ তারা পড়াশোনাতেই ডুবে থাকে৷ আরও ধরুন ১০-১৫ শতাংশের ইচ্ছে থাকে ঘষেমেজে নিজেকে গড়ে তোলার৷ এর বাইরের যে বিপুল অংশ পড়াশোনায় অমনোযোগী, তাদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব বেশি৷ আমাদের ছোটবেলায় এই অংশের ছেলেমেয়েরা মাঠেঘাটে দিনভর খেলে বেড়াতো৷ এখন খেলাধুলোর জায়গা নিয়েছে ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া৷''
শিক্ষার্থীরাই দেশের ভবিষ্যৎ চালিকাশক্তি৷ তাদের মোবাইল আসক্তি ভবিষ্যতে কী প্রভাব ফেলবে, তার জবাব সময় দেবে৷ কিন্তু, সোশ্যাল মিডিয়া এখনই প্রশাসনের মাথাব্যথা হয়ে উঠেছে৷ পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ে বেশ কিছুদিন ধরে উত্তেজনা চলছে৷ এই উত্তেজনায় ইন্ধন দিচ্ছে, এই অভিযোগে একটি পত্রিকার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার উদ্যোগ নেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার৷ উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার ওই ফেসবকু অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়৷ এর বিরুদ্ধে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন৷ রাজ্য সরকার হলফনামা দিয়ে জানিয়েছে, তারা কী পরিস্থিতিতে এ ধরনের ‘অগণতান্ত্রিক' পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছেন৷ হাতে হাতে স্মার্টফোন, সকলের একটি করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, তাই আর আকাশবাণীর দরকার নেই, সকলেই একইভাবে ঋদ্ধ ও বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারেন একটি য়৷ মহাশক্তিধর রাষ্ট্রও তাতে বিপাকে পড়ে যেতে পারে৷
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দল বিজেপি বিসর্জন-মহরম বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগ করেছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যালঘুদের তোষণ করছেন৷ এর লক্ষ্য, ২৭ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট নিশ্চিত করা৷ এই অভিযোগকে উপজীব্য করে একটি ফেসবুক পোস্ট সামনে এলো৷ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনও কোনও পুরুষের সঙ্গে সাযুজ্য রাখে এমন শ্মশ্রূ-গুম্ফবিশিষ্ট করে তোলা হলো মুখ্যমন্ত্রীকে৷ ফটোশপের কারিকুরিতে তৈরি এই পোস্ট এ রাজ্যের ৭০ শতাংশের বেশি হিন্দুকে যে বার্তা দিলো, তা হাজারো বিদ্বেষমূলক লেখা বা ভাষণে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মৌলবাদীরা এমন সুচারুভাবে দিতে পারতেন না৷ একইভাবে বাংলাদেশে কয়েকমাস আগে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ধর্মস্থানে হিন্দু দেবতার ছবি সেঁটে দিয়ে হিংসা ডেকে আনা হয়েছিল৷ এ ধরনের ঘটনা ঘটলে পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয় বটে, কিন্তু ভুয়া অ্যাকাউন্ট করে এসব বিদ্বেষ ছড়ালে কাকে আপনি ধরবেন? লড়াই লাগিয়ে দিয়ে মৌলবাদের চাঁইরা উধাও হয়ে যাবে, রক্ত ঝরবে সাধারণ মানুষের৷
শহরে সভ্যতার আগ্রাসন যতটা বেশি, গ্রামাঞ্চলে তার তুলনায় অনেকটা কম৷ তাই কলকাতা ও তার কাছের শহরতলিতে ফেসবুকের কুপ্রভাব যতটা, তার থেকে কম গ্রামীণ এলাকায়৷ ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাবিজ্ঞানের পাঠ দেওয়া প্রভাস রায় এর পিছনের অর্থনৈতিক কারণটি তিনি ব্যাখ্যা করেন৷ শিক্ষাবিজ্ঞানের এই শিক্ষক বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলগুলিতে যারা পড়তে আসে, তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়৷ তাই উচ্চমাধ্যমিক স্তরে একটি ক্লাসে দু-চারজনের হাতে মোবাইল দেখা গেলেও ৯০ শতাংশের কাছে তা থাকে না৷ মোবাইল না থাকায় তার দ্বারা সমস্যাগুলিও তৈরি হয় না৷'' শিক্ষক জানান,সোশ্যাল মিডিয়া ও ব্লু হোয়েলের মতো ‘মারণ গেম'সম্পর্কে তবু আগেভাগে পড়ুয়াদের সতর্ক করার জন্য কাউন্সেলিং হয়েছে৷ সমাজও ক্রমশ বুঝছে এর প্রয়োজনীয়তা৷ তাই এবার মহরমের শোকযাত্রাতেও দেখা মিলল এমন উদ্যোগের৷ পশ্চিম মেদিনীপুরের গোপীগঞ্জে তাজিয়ার সঙ্গেই পদযাত্রায় ছিল ব্লু হোয়েলের বিরুদ্ধে বার্তাবহ ব্যানার৷
ফেসবুক কিংবা মোবাইল গেম যে বিপদ উপস্থিত করেছে, সে জন্য বিজ্ঞানকে পরিহার করা যায় না৷ প্রযুক্তির সাহায্য না নিলে পড়ুয়ারা ভবিষ্যতে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়বে, এই আশঙ্কা রয়েই যায়৷ তাই ফিরতে হবে ডা. কামাল হোসেনের দেখানো পথে৷ ছেলেমেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক হলে হাতে স্মার্টফোন রাখতেই পারে, কিন্তু তারা কীভাবে সেটি ব্যবহার করছে, তার উপর নজরদারি রাখলে সমস্যা থেকে মুক্তি অনেকটাই সম্ভব৷