সোনার হরিণ আইসিইউ
৭ জুন ২০২০আইসিইউ বেড খালি না থাকায় রোগীর স্বজনরাও যেমন উদ্বিগ্ন তেমনি চিকিৎসকরাও আছেন বিপাকে৷ কয়েকটি হাসপাতালে যোগাযোগ করে জানা যায় এক সপ্তাহ আগে থেকেই আইসিইউ বেড খালি নেই৷ প্রতিটি কোভিড হাসপাতালেই অনেক অপেক্ষমান রোগী আছেন৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, রোগীর স্বজনরা আইসিইউ বেডের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন৷ অনেকে চিকিৎসার শুরুতেই আইসিইউ'র জন্য চাপাচাপি করছেন, তাতে সংকট আরো বাড়ছে৷
সংবাদ মাধ্যমে আইসিইউ'র অভাবে রোগী মারা যাওয়ার খবরও ছাপা হচ্ছে৷ এরকম একজন হলেন ব্যবসায়ী খন্দকার শাহেদুল ইসলাম (৪৭)৷ তিনি ৩১ মে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান৷ ২১ মে তিনি করোনা পজেটিভ নিয়ে ভর্তি হন৷ তার ভাই মনিরুল ইসলাম জানান, ‘‘তিনি শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন৷ শেষ দুই দিনে তার আইসিইউ সাপোর্ট দরকার ছিলো৷ চিকিৎসকরাও বলছিলেন বার বার৷ আমরা নিজেরাও বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করেছি৷ কিন্তু আইসিইউ পাওয়া যায়নি৷ ঢাকা মেডিক্যালে কোভিড রোগীর জন্য আইসিইউ বেড ১০টি৷ কোনো বেডই খালি ছিল না৷’’
তিনি জানান, ওই সময় তারা বাইরের হাসপাতালেও যোগাযোগ করেছিলেন৷ কিন্তু সেখানেও পাওয়া যায়নি৷ কোভিড চিকিৎসকদের একটি অনলাইন গ্রুপের সমন্বয়ক সুমন জাহিদ জানান, ‘‘আমরা প্রতিদিন আইসিইউ'র জন্য পাঁচ-সাতটি অনুরোধ পাই৷ কিন্তু বিভিন্ন কোভিড হাসপাতালে যোগাযোগ করে গত ১০ দিন ধরে কোনো আইসিইউ ম্যানেজ করতে পারছি না৷’’
সরকারি হিসাব অনুযায়ী সারাদেশে এখন কোভিড-১৯ এর জন্য ৩৯৯টি আইসিইউ বেড আছে৷ এর মধ্যে ঢাকায় আছে দেড়শ’র মতো৷ এছাড়া সারাদেশে সব ধরনের চিকিৎসার জন্য মোট আইসিইউ আছে এক হাজার ২০০ বা তার কিছু বেশি৷
বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন-বিএমএ'র মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী জানান, এর বাইরে নতুন যে বেসরকারি হাসপাতালগুলো কোভিড-১৯ চিকিৎসায় যুক্ত হয়েছে তাদের আরো হয়তো সব মিলিয়ে ৫০ টি আইসিইউ আছে৷ তার মতে, রোগী বেড়ে যাওয়ায় আইসিইউর সংকট তৈরি হয়েছে৷ আগে পরিকল্পনা করলে হয়তো এই সংকট এড়ানো যেতে৷
এই চিকিৎসক নেতা বলেন, ‘‘আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী সাধারণ হাসপাতালে মোট বেডের শতকরা পাঁচ ভাগ এবং বিশেষায়িত হাসপাতালে ১০ ভাগ আইসিইউ বেড থাকবে৷ আমাদের এখানে এর অনেক কম৷’’ তিনি জানান, ‘‘ভেন্টিলেটর আছে আরো কম৷ যত আইসিইউ বেড তার ৪০ ভাগ বেডে ভেন্টিলেটর আছে৷’’
আইসিইউ বেডের স্বল্পতার পাশাপাশি আতঙ্কের কারণেও এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি৷ ‘‘কার আইসিইউ প্রয়োজন তা চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নেবেন৷ কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরই পরই রোগীর স্বজনর আইসিইউ'র জন্য চাপ দেন৷ তারা মনে করেন রোগীকে আইসিইউতে না নিলে হয়তো বাঁচানো যাবেনা৷ কিন্তু এটা ঠিক না,’’ বলেন এহতেশামুল হক চৌধুরী৷
এই চিকিৎসক জানান করোনা আক্রান্ত রোগীদের শতকরা ৮০ ভাগ বাসায় থেকেই ভালো হয়ে যান৷ ২০ ভাগকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়৷ আর চার-পাঁচ ভাগ রোগীর আইসিইউ’র প্রয়োজন হয় যাদের অবস্থা খুবই খারাপ থাকে৷
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ঢাকার কয়েকটি প্রাইভেট কোভিড হাসপাতালের কিছু বেড বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আগেই বুকিং দিয়ে রেখেছে৷ আর প্রভাবশালীরা হাসপাতালে ভর্তি হলেই প্রয়োজন না হলেও আইসিইউতে থাকছেন৷ ফলে যাদের প্রভাব বা অর্থ নেই তারা আছেন সংকটে৷ তবে এইসব বিষয়ে দায়িত্বশীল কেউ নাম প্রকাশ করে সরাসরি কিছু বলতে রাজি হননি৷
কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক শাহাব উদ্দিন আহমেদও আইসিইউ স্বল্পতার কথা স্বীকার করেন৷ তিনি জানান, হাসপাতালটিতে আগের ১০টির সঙ্গে শনিবার থেকে আরো ৬টি আইসিইউ বেড যুক্ত হয়েছে৷ তারপরও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম৷
রিজেন্ট হাসপাতালে ১৮ টি আইসিইউ বেডের একটিও খালি নেই৷ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শাহেদ জানান, ‘‘আমার জানামতে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে কোভিড রোগীদের জন্য কোনো হাসপাতালে আইসিইউ খালি নেই৷ এর কারণ শুধু স্বল্পতা নয়৷ আতঙ্কের কারণে সব রোগীই আইসিইউ চায়৷’’ ডা. এহতেশামুল হক বলেন, ‘‘রোগী যেভাবে বাড়ছে তাতে ভবিষ্যতে এই সংকট আরো বাড়বে৷ তাই অল্প আইসিইইউ বেডের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে৷’’