‘গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বারবার বিচ্যুত হয়েছি’
৩০ ডিসেম্বর ২০২১প্রাপ্তি অনেক, কিন্তু অপ্রাপ্তি কী? কোথায় কোথায় এখনও উন্নতি দরকার? সেসব নিয়েই ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন অধ্যাপক ড. রওনক জাহান৷
ডয়চে ভেলে : স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে দেশ৷ এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের বড় অর্জন কী?
অধ্যাপক ড. রওনক জাহান : প্রথমত, আমরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতে অনেক অর্জন করেছি৷ আমরা যখন স্বাধীন হয়েছিলাম, তখন আমাদের দুঃশ্চিন্তা ছিল আমাদের তো কোন প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, তাহলে এত কোটি মানুষকে আমরা কিভাবে খাওয়াবো? তখন তো আমাদের তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হয়েছিল৷ আমরা কিন্তু ধাপে ধাপে উন্নতি করেছি৷ অর্থনৈতিক সূচক যদি আমরা দেখি, আমাদের যে পরিমাণ মানুষ গরীব ছিল, তার চেয়ে আমরা অনেকটাই কমাতে পেরেছি, জিডিপিও অনেক বাড়াতে পেরেছি৷ স্বাস্থ্য, শিক্ষাখাতেও আমাদের উন্নতি হয়েছে৷ তখন আমাদের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছরের কম, এখন সেটা ৭০ বছরের বেশি৷ আমাদের জন্য আনন্দের খবর হচ্ছে, স্বাধীনতার সময় আমরা অর্থনৈতিক ও সমাজিক সব সূচকেই পাকিস্তানের চেয়ে পিছনে ছিলাম৷ এখন প্রায় সব সূচকেই আমরা তাদের ছাড়িয়ে গেছি৷ সব মিলিয়ে আমি বলব, ৫০ বছর উদযাপনে আমাদের অনেক কিছুই আছে৷
এই ৫০ বছরে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা কী?
সব থেকে বড় ব্যর্থতা যেটা বলব, সুশাসনে আমরা কখনোই আগাতে পারছি না৷ এর সঙ্গে আমি বলব, স্বাধীনতার শুরুতেই আমরা গণতান্ত্রিক দেশ শুরু করেছিলাম৷ সেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে আমরা বারবার বাইরে পড়ে যাচ্ছি৷ অর্থনৈতিক ও সমাজিক ক্ষেত্রে যেমন আমরা ক্রমান্বয়ে উন্নতি করেছি, কিন্তু সুশাসন ও গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা বারে বারে পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছি এবং আমরা পিছিয়ে পড়ছি৷ এই দু'টো ক্ষেত্রে আমাদের বিপরীত যাত্রা৷
দেশের উন্নয়নের সঙ্গে জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন কতটা হয়েছে?
উন্নয়নের সুফল অনেক সময় জনগোষ্ঠীর সবার জন্য সমান হয় না৷ আমরা যে সমস্ত পরিসংখ্যান বলছি, যেমন মাথাপিছু আয়, এটা কিন্তু গড় হিসাব৷ এর সঙ্গে যদি আমরা দেখি ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য, সেটা কিন্তু ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে৷ সবারই ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু যারা অনেক ধনী তারা আরও বেশি ধনী হয়েছে৷ বাংলাদেশ তো একটা ছোট দেশ৷ আমাদের যে উন্নয়ন হচ্ছে, সেটার জন্য যারা শ্রমিক বা অভিবাসী তারা খুব কষ্ট করে আয় করছেন৷ তারা অনেক শোষণ বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন৷ আমরা যে দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে বেরিয়ে আসছি, সেখানে এই গার্মেন্টস শ্রমিক বা বিদেশ থেকে যারা টাকা পাঠাচ্ছেন তাদের একটা বড় অবদান রয়েছে৷ আমরা যদি দেখি, গার্মেন্টস সেক্টরে আমাদের পরে শুরু করে ভিয়েতনাম এগিয়ে গেছে৷ কম্বোডিয়াও এগিয়ে যাচ্ছে৷ ওদের শ্রমিকেরা কিন্তু আমাদের শ্রমিকদের থেকে বেশি বেতন পাচ্ছে৷ বিদেশে যারা বড়লোক তারা তো আর টাকা পাঠাচ্ছে না৷ কিন্তু যারা টাকা পাঠাচ্ছে তারা গরিব, কিন্তু তারা দেশে ও বিদেশে নানা হয়রানির শিকার হন৷
৫০ বছরে রাজনীতির গতিপথ কি বদলেছে?
স্বাধীনতার উত্তরকালে রাজনীতিতে একটা মূল্যবোধ ছিল, চেতনা ছিল যে আমরা একটা গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক দেশ হবো৷ তখন যারা রাজনীতি করতেন তারা অনেক সংগ্রাম করে এসেছেন৷ ৫০ বছর পর এসে আমরা দেখছি, অধিকার বা মূল্যবোধের জন্য যে রাজনীতি সেটা না করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করা হচ্ছে এবং ক্ষমতায় গিয়ে তারা টাকা পয়সা বানাচ্ছেন৷ আগে গ্রামের কিংবা শহরের সাধারণ মধ্যবিত্তেরা রাজনীতি করতেন এখন খুব বড়লোক, ব্যবসায়ি বা অবসরপ্রাপ্ত আমলা বা সামরিক কর্মকর্তারা যাদের অনেক টাকা পয়সা আছে তারা রাজনীতি করছেন৷ এখনকার রাজনীতির সঙ্গে টাকা পয়সা অনেকটা জড়িয়ে গেছে৷
নির্বাচনই কি গণতন্ত্র উন্নয়নের একমাত্র পরিমাপক?
নির্বাচন একটা পরিমাপক৷ নির্বাচন ছাড়া কিভাবে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার বদল সম্ভব? এর বাইরেও বাকস্বাধীনতা গণতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ৷ আইনের শাসন এবং আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমান হওয়া উচিৎ৷ পাশাপাশি গণমাধ্যমের স্বাধীনতাসহ যেসব সূচক দিয়ে গণতন্ত্রকে মাপা হয় তারা কোনোটাতেই আমরা ক্রমাগত উন্নতি করতে পারছি না৷ একটু উন্নতি কখনও হলেও পরক্ষণেই আবার পড়ে যাচ্ছে৷
নির্বাচন সুষ্ঠু হলেই কি মানুষের বাক-স্বাধীনতা বেড়ে যায়?
নির্বাচনটা কেন রাখা হয়েছে? ক্ষমতার বদল যেন শাস্তিপূর্ণ উপায়ে হয় এবং সবাই মেনে নেয়৷ সেটার জন্য তো আর কোন উপায় নেই৷ এই কারণে গণতান্ত্রিক দেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ ভোটে যারা জিতবে তারা দেশ শাসন করবে৷ যে কোন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে বাক স্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর সংবিধানে বাক স্বাধীনতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের সংবিধানেও এটা আছে৷
বৈশ্বিক বিবেচনায় বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা কি খুব বেশি নিচের দিকে?
বৈশ্বিক বিবেচনায় আমাদের থেকে উপরেও অনেক দেশ আছে, নিচেও অনেক দেশ আছে৷ আমরা এখন দেখছি, পৃথিবীর অনেক জায়গায় বাকস্বাধীনতা অনেক সংকটে পড়েছে৷ শুধু যে সরকারের চাপে সংকটে পড়েছে তা নয়, সামাজিক মাধ্যমেও অনেক সময় ভুয়া তথ্য দেওয়া হচ্ছে৷ সরকারের বাইরেও অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি হুমকি ধামকি দেন৷ ফলে এখন বাক স্বাধীনতা অনেক রকম থ্রেটের মধ্যে পড়েছে৷ উপরে কে, নিচে কে সেটা না দেখে আমাদের আকাঙ্খা একটু উঁচু মাত্রায় রাখতে হবে৷ আমাদের অর্থনীতি উন্নত দেশের মতো হবে, এটা তো একটা আকাঙ্খার অংশ৷ তেমনি আমাদের দেশের মানুষের আকাঙ্খা থাকবে, আমরা স্বাধীনভাবে, মুক্তভাবে কথা বলতে পারব৷
উন্নয়ন আর গণতন্ত্র কি একসঙ্গে এগুতে পারে?
অবশ্যই পারে৷ এটা নিয়ে ৫০ এর দশক থেকে নানা ধরনের কথাবার্তা হয়েছে৷ এটা কখনোই প্রমাণ করা যায়নি যে, উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র একটা বাধা৷ অবশ্যই অনেক অগণতান্ত্রিক দেশেও উন্নয়ন হয়েছে, আবার অনেক গণতান্ত্রিক দেশেও উন্নয়ন হয়েছে৷ কিন্তু মানুষ উন্নয়নও চায়, গণতন্ত্রও চায়৷ একটার জন্য আরেকটা হবে না, তা নয়৷ এদের মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই৷ বৈজ্ঞানিক কোন গবেষণায়ও সেটা পাওয়া যায়নি৷
সামনের দিনে বাংলাদেশকে আপনি কিভাবে দেখতে চান?
আমাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়ন হোক৷ আমি আমার দেশকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখতে চাইব৷ বিশেষ করে আমি চাইব, মানবিক ও সহনশীল একটি সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক৷