সীতাকুণ্ডের নির্যাতিত তিন সংখ্যালঘু নারী এখনো আতঙ্কে
১০ জুন ২০২২আপাতত নিরাপত্তা পেলেও যে কোনো দিন আবার হামলার আশঙ্কা করছেন নির্যাতিত তিন নারী৷
পরিবারটির পুরুষ সদস্যরা প্রবাসে থাকেন৷ বাড়িতে থাকেন শুধু চারজন নারী৷ আর এই সুযোগেই প্রতিবেশী আমিন সওদাগরের ছেলেরা হিন্দু পরিবারটির জমি দখলের চেষ্টা করছেন৷ ওই নারীদের অভিযোগ, তারা নিজেদের পুকুরে নামতে গেলে বাধা দেয়া হয়৷ তাদের গাছের ফল জোর করে পেড়ে নিয়ে যায়৷ এমন চলছিল দীর্ঘদিন ধরে৷ সর্বশেষ গত ৪ জুন তাদের একটি গাছের জাম পেড়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন আমিন সওদাগরের দুই ছেলে তৌহিদুল ইসলাম ও আলমগীর হোসেন৷ তাদের বাধা দেওয়ায় তিন নারীকে লাঠি, রড দিয়ে পেটান ওই দুই ভাই৷
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. শাহাব উদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমিন সওদাগরের ছেলেরা দস্যু প্রকৃতির৷ তারা কোনো সালিশ মানে না৷ মাত্র ১২ বছর আগে আমিন সওদাগর এখানে বাড়ি করেছে৷ আর ওই হিন্দু পরিবারটি যুগ যুগ ধরে এখানে বসবাস করে৷ আমরা কয়েক দফা সালিশের মাধ্যমে সামাধানের চেষ্টা করেছি৷ কিন্তু ওরা সালিশ ডাকলেই আওয়ামী লীগের ৫০-৬০ জনকে ডেকে নিয়ে আসে৷ ফলে কোনো সমাধান হয় না৷ ওই হিন্দু পরিবারটির বাড়ি যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ করে দিয়েছেন আমিন সওদাগর৷ আমি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে কয়েকবার সমাধানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি৷’’
মারধরের শিকার নারীরা হলেন, যোগেন্দ্র চন্দ্র দাসের স্ত্রী শ্রীমতি রানী দাস (৩০), মিলন চন্দ্র দাসের স্ত্রী অঞ্জনা রানী দাস (৩২) ও কৃষ্ণ চন্দ্র দাসের স্ত্রী রীমা রানী দাস (২৭)৷ এই ঘটনায় রীমা রানী দাস বাদি হয়ে তৌহিদুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন ও তাদের বাবা আমিন সওদাগরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন৷ ওইদিনই পুলিশ আমিন সওদাগরকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়৷ বয়স্ক হওয়ায় আদালত আমিন সওদাগরকে জামিন দিয়েছেন৷ তবে তার দুই ছেলে বর্তমানে পলাতক রয়েছেন৷
সীতাকুণ্ড থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল কালাম আজাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ঘটনার পরপরই আমরা আমিন সওদারকে গ্রেপ্তার করি৷ তার দুই ছেলে পলাতক রয়েছেন৷ আসলে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের কারণে এই মামলার দিকে খুব বেশি মনোযোগ দেওয়া যায়নি৷ শিগগিরই দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হবে৷ পাশাপাশি ওই পরিবারটির নিরাপত্তা আমরা নিশ্চিত করেছি৷’’
ঘটনার সূত্রপাত কিভাবে জানতে চাইলে রীমা রানী দাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের বাড়ির সঙ্গে একটি পুকুর আছে৷ এই পুকুরের কিছু জমি আমাদের, আর কিছু জমি ওদের৷ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সালিশ করে বলেছেন, দুই পরিবারই এই পুকুরটি ব্যবহার করবে৷ মাছও ভাগ করে নেবে৷ কিন্তু ওরা আমাদের পুকুরের কাছেও যেতে দেয় না৷ পুকুরের কাছে কিছু জমি আছে, সেগুলো পুরোটাই আমাদের৷ কত শতাংশ সেটা আমি বলতে পারবো না৷ কিন্তু ওই জমিটা ওরা দখল করে রেখেছে৷ চাষাবাদ করে ওরাই খায়৷ এ নিয়ে আদালতে মামলাও চলছে৷ আমাদের বাড়ির সঙ্গে কিছু গাছ আছে৷ এর সবগুলোই আমাদের৷ সেদিন আমাদের গাছ থেকে ওরা দুই ভাই জাম পেড়ে নিয়ে যাচ্ছিল৷ আমরা প্রতিবাদ করায় মারধর করে৷ এর আগেও তারা আমাদের মারতে উদ্যত হয়েছে৷ আমাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যরা যেহেতু দেশের বাইরে থাকেন, তাই আমরা ঝামেলা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি৷ বয়স্ক শাশুড়ি আর আমরা তিন জা৷ আর এই সুযোগেই ওরা আমাদের উপর প্রতিনিয়ত নির্যাতন চালিয়ে আসছে৷’’
ঘটনার পর নতুন করে আর হুমকি দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে রীমা রানী দাস বলেন, ‘‘পুলিশ এসে আমাদের আশ্বাস দিয়ে গেছে৷ ওরা দুই ভাই দিনের বেলায় বাড়িতে থাকে না৷ রাতে আসে৷ এই মুহুর্তে কোনো হুমকি নেই৷ কিন্তু যে কোনো সময় তো ওরা আবারও ঝামেলা করতে পারে৷’’
আমিন সওদাগরের সঙ্গেও কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরাই বরং বহুবার সালিশের চেষ্টা করেছি, ওরাই মানতে চায় না৷ ওই বাড়ির নারীরা দস্যু টাইপের৷ ওইদিন তো ওরাই আমার ছেলেদের উপর হামলা চালিয়েছে৷ পুরো পুকুরটি আমাদের, তারপরও আমরা ওদের ব্যবহার করতে দেই৷’’
যে জাম গাছ থেকে জাম পাড়া নিয়ে ঘটনার সূত্রপাত সেই গাছের মালিকানা সম্পর্কে জানতে চাইলে আমিন সওদাগর বলেন, ‘‘ওই জমি নিয়েই তো ওরা ঝামেলা করছে৷ জমি তো আমাদের৷ কিন্তু ওরা দাবি করে ওদের৷ এ নিয়ে মামলা চলছে৷ আমরা তো ওদের চলাচলের রাস্তাও দিয়েছি৷ আমরা জমি না দিলে ওরা বাড়ি থেকে বের হতেই পারবে না৷ মানবিক কারণে আমরা আমাদের জমি দিয়ে ওদের চলতে দেই৷ এখন ওরা টাকার জোরে আমাদের উপরই নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে৷’’
বিদেশ থেকে টেলিফোনে যোগেন চন্দ্র দাস ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি আগেরবার দেশে গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করেছি৷ ছাড় দিয়েও চেষ্টা করেছি৷ তা-ও ওরা মানে না৷ পুরোটাই ওরা দখল করতে চায়৷ চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ স্থানীয় গণ্যমান্য লোকজন চেষ্টা করেও ওদের বোঝাতে পারেনি৷ আমরা দেশের বাইরে থাকি, নারীরা বাড়িতে থাকেন, ফলে আমরা খুবই দুশ্চিন্তায় থাকি৷ এই পরিস্থিতি অব্যহত থাকলে তো দেশে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না৷’’
ঘটনার পরপর পূজা উৎযাপন পরিষদের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে৷ ঢাকা মহানগর পূজা উৎযাপন পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নির্মল চ্যাটার্জি বিষয়টির সমন্বয় করছেন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমরা স্থানীয় প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেছি৷ পাশাপাশি পরিবারটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথাও বলেছি৷ প্রশাসন আমাদের আশ্বস্ত করেছে৷ ওই দুই ভাই গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত পরিবারটির ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে, এ কথাও আমরা প্রশাসনকে বলেছি৷’’
আইনের শাসন না থাকার কারণে যেখানে যার জোর আছে, সেই প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এই ঘটনাটি প্রমান করে দেশে দুর্বল মানুষ কতটা ঝুঁকিতে আছেন৷ শুধু সংখ্যালঘুরা নয়, মুসলমানদের মধ্যে যারা দুর্বল তাদের ঝুঁকিও কম নয়৷ গণতান্ত্রিক একটা পরিবেশ ফিরে না আসা পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নতি হবে না৷’’