সারাদেশের নির্বাচনের প্রভাব সুপ্রিম কোর্টেও পড়েছে: মোরসেদ
২৪ মার্চ ২০২৩শুধু সুপ্রিম কোর্ট নয়, সবগুলো পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচন এখন একইভাবে হচ্ছে৷ পেশাজীবী নেতাদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণেই কী পরিস্থিতি এই পর্যায়ে পৌঁছেছে? এখন এসব সংগঠনের গুরুত্বই বা কতটুকু? এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ৷
ডয়চে ভেলে : সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন হয়ে গেল৷ এটা কেমন হল?
অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ : মিডিয়ার রিপোর্টগুলো যদি পড়েন তাহলে বুঝতে পারবেন নির্বাচন নিয়ে বেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে৷ কারণ নির্বাচনে তো দুইটা পক্ষ থাকে, এই দুই পক্ষের বিপরীত অবস্থানের কারণে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে৷ একটা অংশ তো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি৷ নির্বাচনের কমিশন যখন করা হয়েছে, অর্থাৎ চিফ ইলেকশন কর্মকর্তাকে কেউ কেউ বলেন হুমকি দেওয়া হয়েছে৷ বা উনার পছন্দমতো কাজ করতে দেওয়া হয়নি৷ তখন উনি পদত্যাগ করেছেন৷ এরপর দুই পক্ষ দুইটা নির্বাচন কমিশন করেছে৷ এরপর একপক্ষ নির্বাচন করেছে, আরেকপক্ষ নির্বাচন করেনি৷ সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এটাকে স্বচ্ছ নির্বাচন বলা যাবে না৷
শীর্ষ আদালতের নির্বাচনের প্রভাব অন্য পেশাজীবীদের নির্বাচনে কতটা পড়ে?
শীর্ষ আদালতের নির্বাচনের প্রভাব অন্য প্রতিষ্ঠানে পড়ার দরকার নেই৷ অন্য প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনের যে সিস্টেম সেটা শীর্ষ আদালতেই প্রভাব পড়েছে৷
পেশাজীবীদের নির্বাচন আগে বেশ জমজমাট হতো৷ এসব নির্বাচন নিয়ে আগে কোন প্রশ্ন উঠত না৷ এখন প্রশ্ন উঠছে কেন?
পেশাজীবীদের নির্বাচন যে জমজমাট হতো সেটা সুপ্রিম কোর্ট বাদে অন্য জায়গায় ১০ বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে৷ শুধু সুপ্রিম কোর্টটা ছিল জমজমাট, সেটাও এই বছরের আগ পর্যন্ত৷ এটাও ধ্বংস হলো৷ কারণ পেশাজীবীদের মধ্যে রাজনীতি ঢুকে গেছে৷ পেশাজীবীরা রাজনৈতিক ইস্যুকে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে৷
সরকার কী পেশাজীবীদের সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে?
বর্তমান সরকার, আগের সরকার এরা দুইজন মিলেই পেশাজীবীদের বিভক্ত করার কাজটা সুচারুভাবে করেছে৷ এটার ইফেক্ট এখন আমরা দেখছি৷ বর্তমানে পেশাজীবীদের মধ্যে ঐক্যও নাই, কিছুই নাই৷ এখন পেশাজীবীদের পেশার উন্নয়নে কাজ করার কোন সুযোগ নেই৷ পেশায় থেকে তারা দলীয় অবস্থান, সুযোগ সুবিধা, দলীয় কাজকর্ম নিয়েই নেতারা ব্যস্ত থাকছেন৷ কারণ ওইখানেই তারা লাভবান হচ্ছেন৷
আগে পেশাজীবীদের নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতো, এখন সবখানে সরকার সমর্থকেরাই নির্বাচিত হচ্ছেন, এর কারণ কী?
আগে যারা নির্বাচন করতেন তারা পেশার লাভের জন্য কাজ করতেন৷ পেশাজীবীরাও ভোটে সেই সব নেতাকে নির্বাচিত করতেন৷ এখন মনে করা হয়, পেশাজীবী নিজেরা কিছু করতে পারবেন না, যদি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকে৷ অর্থাৎ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেই পেশার জন্য কিছু করা সম্ভব৷ এই ধারণা ও সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়েছে৷ তার কারণে অনেকেই পেশার মধ্যে থেকেও রাজনীতিতে ঢুকে যাচ্ছেন৷ তারা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পেশাজীবীদের নেতৃত্ব দিতে চাচ্ছেন৷ এতে দু'টো জিনিস হচ্ছে, পেশাজীবীদের নেতৃত্ব উনি পাচ্ছেন৷ আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা, উপরে উঠা সেই সুযোগও পাচ্ছেন৷ সেই কারণে সবাই এখন এদিকে ধাবিত হচ্ছেন৷
পেশাজীবীদের নির্বাচন ধ্বংস হওয়ার মূল কারণ কী তাহলে দলীয় লেজুড়বৃত্তি?
নব্বইয়ের দশকে এরশাদ কিন্তু চেষ্টা করেছিলেন পেশাজীবীদের বিভক্ত করতে৷ তখন শামসুল হক চৌধুরী সুপ্রিম কোর্টের লিডার ছিলেন, তখন তাকে মন্ত্রী করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল৷ কিন্তু উনি তা গ্রহণ করেননি৷ এই ধরনের চরিত্র এখন আর নেই৷ এখন যদি কাউকে মন্ত্রী করার প্রস্তাব দেওয়া হয় তাহলে তিনি পেশাজীবীদের সমস্ত স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে পরদিনই শপথ নিতে যাবেন৷ এই বৈশিষ্ট্যের লোকই এখন বেশি৷ এটা বিভিন্ন কারণে হয়েছে৷ রাজনীতি যারা করেন বা যারা সরকার পরিচালনা করেন তারা যেটা চেয়েছেন সেটাই সুপ্রিম কোর্টের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে৷ পেশাজীবীদের বিভক্ত করলে সুবিধা আছে তো? পেশাজীবীরা যদি ঐক্যবদ্ধ হন, প্রতিবাদ করেন তাহলে সরকার আর সেখানে আগাতে পারে না৷ যারা রাজনীতি করেন তারা মনে করেন, পেশাজীবীরা একটা উটকো ঝামেলা৷ পেশাজীবীরা যদি মনে করেন এটা তারা করতে দেবেন না, তাহলে সরকার সেটা করতে পারে না৷ এই সমস্যা থেকেই তারা চিন্তা করেছেন পেশাজীবীদের বিভক্ত করে দেওয়ার, এবং সেটা তারা সফলভাবে করেছেন৷ এখন পেশাজীবীদের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আর কোন বাধা নেই৷ এখন আর পেশাজীবীরা বলেন না এটা করা যাবে না৷ ফলে সরকার এখন রিলাক্স মুডেই আছে৷
এসব কারণে কী পেশাজীবী সংগঠন গুরুত্ব হারাচ্ছে?
অবশ্যই৷ সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে সাংবাদিক, আইনজীবী সবাই মিলে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ করা হয়েছিল৷ সবাই মিলে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল৷ যার কারণে রাজনীতিবিদেরাও সফল হয়েছিলেন সামরিক শাসন পরিবর্তন করতে৷ একটা উদাহরণ হিসেবে বলি, সুপ্রিম কোর্টে যদি কোন অবিচার হয়, সুপ্রিম কোর্ট যদি সঠিকভাবে কাজ না করে সেক্ষেত্রে পেশাজীবীরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করাতে পারতো তাহলে সেটা সম্ভব ছিল না৷ এখন দেখেন সুপ্রিম কোর্টে একটা রায় নিয়ে যখন বিভক্তির সৃষ্টি হয়, যখন বলা হয় এই রায় বাইরে থেকে লিখে দেওয়া হয়েছে৷ তখনও কিন্তু পেশাজীবীরা ঐক্যবদ্ধভাবে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারেন না৷
জাতীয় রাজনীতি বা নির্বাচনের প্রভাব কতটা পড়ছে পেশাজীবীদের নির্বাচনে?
সারাদেশে যেভাবে নির্বাচন হয় তার প্রভাব সুপ্রিম কোর্টেও পড়েছে৷ পড়বে না, তা নয়৷ সারাদেশে যেভাবে নির্বাচন হয় সুপ্রিম কোর্টেও সেটা করতে চেয়েছে এবং সেটা হয়েছে৷
কীভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে এসব সংগঠনকে আরও বেশি কার্যকর করা সম্ভব?
রাজনৈতিক দলগুলোর বোধদয় হলে এটা কার্যকর করা যাবে৷ তারা যেন পেশাজীবীদের কাজে হস্তক্ষেপ না করে৷ তাদের বোধোদয় হলেই কেবল তখন সেটি সম্ভব হবে৷