‘শিরশ্ছেদের মুখে' সৌদি নারী
২৫ আগস্ট ২০১৮ইসরা আল-গোমাম নামের ২৯ বছরের এই নারীকেমৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতে পারে বলে উদ্বেগ জানিয়েছে মানবাধিকার গ্রুপগুলো৷ সৌদি আরবে সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ায় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পূর্বাঞ্চলীয় শহর কার্তিফ থেকে স্বামীসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এরপর থেকে কারাগারে আছেন আল-গোমাম৷
গত ৬ আগস্ট দেশটির টেররিজম ট্রাইব্যুনালে এই মামলার বিচার শুরু হয়, আগামী ২৮ অক্টোবর রায় ঘোষণা হতে পারে৷ মামলায় আল-গোমামসহ পাঁচ অধিকার কর্মীর মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন সৌদি আইনজীবীরা৷ আল-গোমামের মৃত্যুদণ্ড হলে দেশটিতে প্রতিবাদের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তিপ্রাপ্ত প্রথম নারী হবেন তিনি৷
এ বিষয়ে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্য পরিচালক সারাহ লি উইটসেন বলেন, ‘‘যে কারো মৃত্যুদণ্ডই দুঃখজনক৷ কিন্তু ইসরা আল-গোমামের মতো অধিকারকর্মীর (যাঁর বিরুদ্ধ সহিংসতার অভিযোগও নেই) মৃত্যুদণ্ড চাওয়া ভয়াবহ ব্যাপার৷''
শিরশ্ছেদের পর মৃতদেহ দেখানো একটি ভিডিও গত কয়েক দিন ধরে অনলাইনে ঘুরছে, যা আল-গোমামের বলে দাবি করা হয়৷ তবে ওই ফুটেজটি তিন বছর আগের বলে জানা গেছে৷ এ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটাতে ইউরোপিয়ান-সৌদি অর্গানাইজেশন ফর হিউম্যান রাইটসের (ইএসওএইচআর) পরিচালক আদুবিসি মঙ্গলবার এক টুইটে লিখেছেন, ‘‘তিনি এখন নিরাপদে আছেন৷''
আল-গোমামের অবস্থানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ এবং তাঁর জীবন ও স্বাধীনতা রক্ষার দাবিতে বিশ্বজুড়ে কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানিয়েছেন আদুবিসি৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কারাগারে তিনি কেমন আছেন সে বিষয়ে তেমন কিছু জানা যায় না৷'' দুই বছর আগে তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে স্বজনদের উদ্বেগ জানানোর কথা তুলে ধরেন তিনি৷
সৌদি আরবে রাজনৈতিক বন্দিদের সঙ্গে মাসে একবার কিছুক্ষণের জন্য স্বজনদের দেখা করতে দেওয়া হয়৷ দেশটির একটি কারাগারে এক মাস কাটিয়ে আসা আদুবিসি কারাবন্দিদের শোচনীয় অবস্থার কথা জানান৷ বলেন, ‘‘সেখানে বন্দিদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়৷''
শিয়াদের জন্য বার্তা?
২০১১ সালে আরব বিশ্বে প্রতিবাদের ঢেউ উঠলে সৌদি আরবের শিয়া মতাবলম্বীরাও সমান সুযোগ-সুবিধার দাবিতে রাজতান্ত্রিক দেশটির সুন্নি সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকরেন৷ সৌদি আরবের তেল সমৃদ্ধ পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের কাতিফ শহরে বিক্ষোভাকারী শিয়াদের মধ্যে ছিলেন আল-গোমাম৷
সৌদি সরকারি আইনজীবীর ভাষ্য অনুযায়ী, কাতিফে বিক্ষোভে অংশ নিয়ে ‘সরকারবিরোধী স্লোগান এবং বিক্ষোভ উসকে দেওয়ার' সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷
আল-গোমামের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আনার পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলা হয়েছে, বিক্ষোভের পাশাপাশি তিনি ‘দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য সন্ত্রাসী দলে যোগ দিয়েছিলেন'৷
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১৮ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে সৌদি আরবে শিক্ষা, বিচার ব্যবস্থা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে শিয়া ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণের বিষয়টি তুলে ধরা হয়৷
আল-গোমামের বন্দিত্ব ও সম্ভাব্য মৃত্যুদণ্ডকে শিয়াদের প্রতি সরকারের কঠোর বার্তা হিসেবে দেখছেন জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ গুইডো স্টাইনব্যার্গ৷
তাঁর মতে, কোনো ধরনের বিক্ষোভ ‘সহ্য করা হবে না'-এ বার্তাই শিয়াদের দিতে চায় সরকার৷
‘‘২০১১ ও ২০১২ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সে লক্ষ্যে সম্ভাব্য বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ভয় ধরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলেই সৌদি সরকারের কৌশল দেখে মনে হচ্ছে,'' ডয়চে ভেলেকে বলেন তিনি৷
২০১৬ সালে শিয়া ধর্মীয় নেতা শেখ নিমর আল-নিমরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে সৌদি সরকার৷ এর জের ধরে ওই অঞ্চলে রিয়াদের প্রধান প্রতিপক্ষ ইরান তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে৷ তবে আল-গোমামের বেলায় সেটি ঘটবে না বলে মনে করছেন স্টাইনব্যর্গ৷ তিনি বলেন, ‘‘ইরানের পক্ষ থেকে এ রকম বড় কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে মনে করি না৷''
সৌদি আরবে মৃত্যুদণ্ড
আল-গোমামকে শিরশ্ছেদ করা হতে পারে বলে যে খবর বেরিয়েছে তাতে সংশয় রয়েছে স্টাইনব্যার্গের৷
‘‘সৌদি আরব একজন সৌদি নারীকে, সৌদি নাগরিককে এভাবে হত্যা করবে তা ভাবতে আমরা সমস্যা হচ্ছে৷''
সৌদি আরবের শরিয়া আইনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আরো দু'টি পদ্ধতি আছে-ফায়ারিং স্কোয়াড ও পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা৷
দেশটির বিচার ব্যবস্থায় ধর্মীয় নেতাদের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে৷ আর সে কারণেই মৃত্যুদণ্ড ও শিরশ্ছেদ বিলুপ্ত হবে না বলে মনে করেন স্টাইনব্যার্গ৷
‘‘সৌদি আরব যুক্তি দেখিয়ে বলবে, এটা ইসলামের বিধান এবং ধর্মীয় দায়িত্ব৷''
আল-গোমামই সৌদি আরবে গ্রেপ্তার একমাত্র নারী অধিকারকর্মী নন৷ জুলাইয়ে সামার বাদাবি নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যিনি ১৫ বছর ধরে শারীরিক নিপীড়নকারী বাবার কাছ থেকে পালিয়ে এসেছিলেন৷
সৌদি আরবে প্রত্যেক নারীরই একজন পুরুষ অভিভাবক থাকতে হবে৷ সামার বাদাবির ভাই রাফি বাদাবিও ২০১২ সাল থেকে কারাবন্দি, তাকে শাস্তি দেওয়া হয় ‘ইলেকট্রনিক চ্যানেলের মাধ্যমে' ইসলাম অবমাননার অভিযোগে৷
মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের যুবরাজ হওয়ার পর নারীদের গাড়ি চালনা, সিনেমা নির্মাণ এবং রাস্তায় গান বাজানোর মতো অনেক উদারপন্থি উদ্যোগ নিলেও তিনি দেশটির রক্ষণশীল প্রতিষ্ঠান ও রীতি-নীতিকেও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে চলেছেন৷
এ বিষয়ে স্টাইনব্যর্গ বলেন, ‘‘সালমানের ওপর দেশটির রক্ষণশীল অংশের চাপ বাড়ছে, যারা তাঁর সংস্কারমূলক উদ্যোগগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছে৷ এ কারণে তিনি উদারপন্থি ও সংস্কারবাদী কণ্ঠস্বরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান৷ তিনি রক্ষণশীলদের দেখাতে চান ওয়াহাবি মতবাদের সঙ্গে রাজতন্ত্রের সম্পর্ক এবং দেশের ধর্মীয় আবহ এখানই শেষ হয়ে যাচ্ছে না৷''
তবে আল-গোমামের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে তা যুবরাজ বিন সালমানের ‘কলঙ্ক' হয়েই থাকবে৷
আপনার কোন মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷
ভেসলে ডকেরি/এএইচ