সময়ানুবর্তিতা, জার্মানদের সবচেয়ে বড় গুণ
১২ মে ২০১১‘‘পাশের বাড়ির বয়স্ক লোকটিকে খেয়াল করেছি দীর্ঘ দশ বছর ধরে৷ ভদ্রলোকের বয়স ছিল ৮০'র উপরে৷ সকাল আটটায় টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে তিনি বসতেন৷ আশ্চর্য লাগতো প্রতিদিন দুপুরে একই সময়ে বাসা থেকে বের হতেন, রেষ্টুরেন্টে খেতে যেতেন৷ এক মিনিট আগেও নয়, পরেও নয়৷ অথচ ঠিকঠাকমতো নিজেকে গুছিয়ে কিন্তু তিনি বাইরে যেতেন৷'' জার্মান প্রবাসী এক বাংলাদেশী সময়ের প্রতি জার্মানদের একনিষ্ঠতা বোধের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলছিলেন এই কথা৷
প্রতিদিন একই সময়ে খাওয়া-দাওয়া, সপ্তাহান্তে বাজার করা, আমন্ত্রণকর্তার বাড়িতে উপস্থিত হওয়া, বেড়াতে যাওয়া জার্মানদের সবকিছুই যেন ঘড়ির কাঁটাকে ঘিরে৷ এ প্রসঙ্গে আঙ্গেলিকা পির্ক বললেন, ‘‘সময় মেনে চলাকে জার্মানরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখে৷ জার্মানিতে একটা কথা আছে, সময় যেন অর্থ৷ আমি নিজেও চাই মানুষ সময়কে মেনে চলুক৷ কারো সঙ্গে আমার যদি দেখা করার কথা থাকে কোনো কারণে যদি তিনি সময়মতো আসতে না পারেন আমি মনে করি অন্তত ফোনে হলেও আমাকে জানিয়ে দেওয়া উচিত যে তিনি নির্দিষ্ট সময়ে আসতে পারছেননা৷''
পাশের দেশ ইটালি৷ অথচ সময়ের দিক বিবেচনা করলে সেখানকার লোকজন ঠিক যেন জার্মানদের বিপরীত৷ অনেকটা উপ-মহাদেশের লোকজনদের মতো৷ বলছিলেন হাসিব রেজা৷ তিনি ঢাকায় বহুজাতিক একটি কোম্পানিতে প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করছেন৷ অফিসের কাজে বেশ কিছুদিন থাকতে হয়েছিল ইটালিতে৷ তখন অল্প সময়ের জন্য বেড়িয়ে যান জার্মানিতে৷
রেজা'র কথায়, ‘‘জার্মানিতে গিয়ে এই বিষয়টি আমার খুব ভালো লেগেছিলো৷ সবাই কী করে এতো সুক্ষ্মভাবে সময় মেনে চলছে৷ কীভাবে এক মিনিট এদিক সেদিক না করে নির্দিষ্ট সময়ে বাস-ট্রেনগুলো বাস স্টপেজ এবং প্ল্যাটফর্মগুলোতে আসছে৷ আর মানুষজনও ব্যস্ত হয়ে পথঘাট চলছেন৷ কারণ তারা জানেন এক মিনিটের জন্য তারা একটা ট্রেন মিস করতে পারেন৷ কিংবা নির্দিষ্ট সময়ের একমিনিট পরে গেলেই দোকানটি আর খোলা পাবেননা৷''
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার, ব্যাংক, বিভিন্ন অফিস আদালত সবক্ষেত্রেই সময়ানুবর্তিতা চোখে পড়ার মতো৷ ‘‘সময় মেনে চলার বিষয়টি জার্মানদের মধ্যে শিশু বয়স থেকেই গড়ে উঠে৷ জার্মানির স্কুলে বাচ্চারা যদি ঠিক সময়মতো না আসে তাহলে তাদেরকে খারাপ চোখে দেখা হয়৷ তার নামে খারাপ রিপোর্ট হয়ে যায়৷ ট্রাম কয়েক মিনিট দেরি করেছে এটা কোনো যুক্তি হতে পারেনা৷ তাহলে আগের ট্রামে কেন সে আসেনি? আর সময়মতো স্কুলে না পৌঁছে কোনো উপায়ও নেই৷ কেননা, স্কুলের গেট যথাসময়ে বন্ধ হয়ে যায়৷''
হাসিব বললেন, ‘‘বিশেষ করে আমরা যারা ঢাকা শহরে বাস করি তাদের কাছে এটা রীতিমতো আশ্চর্যের একটি বিষয়, যাদেরকে ট্রাফিক জ্যামের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়িতে বসে থাকতে হয়৷ বাড়ি থেকে আধা ঘন্টার রাস্তায় যাওয়ার জন্য দেড়ঘন্টা আগে গাড়িতে উঠতে হয়৷ তারপরও ঠিকসময়মতো পৌঁছতে পারা সবসময় সম্ভব হয়ে উঠেনা৷''
জার্মানদের সময় মেনে চলতে পারার নেপথ্যে কী রয়েছে? আঙ্গেলিকা পির্ক বললেন, ‘‘অফিসে আমার অনেক সহকর্মী আছেন যারা দক্ষিণ এশিয়া থেকে এসেছেন৷ ওদের সময়জ্ঞানটা আমাদের চেয়ে একটু অন্যরকম৷ তবে সবাই না৷ তাদের কাছে গল্প শুনেছি তাদের দেশের বাস, ট্রেন আমাদের দেশের মতো নির্দিষ্ট সময়ে আসেনা৷ তাই তারা ঠিক সময়মতো পৌঁছাতে পারেনা৷ অথচ আমাদের দেশে ট্রেন যদি দু'এক মিনিট দেরিতে আসে তাহলেই আমরা বিরক্ত হই৷ আসলে এদেশের পরিবেশ এবং সুযোগ-সুবিধা মানুষকে সময় মেনে চলাতে সাহায্য করে৷''
প্রতিবেদন: জান্নাতুল ফেরদৌস
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক