শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক জটিলতা, ভারতের কপালে ভাঁজ
৩১ অক্টোবর ২০১৮নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজাপক্ষে চীন-ঘেঁষা বলেই দিল্লির দুশ্চিন্তা বেশি৷ দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মৈথিরিপালা সিরিসেনা যেভাবে প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিংহেকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় বসালেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষকে, তাতে দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক তথা সাংবিধানিক সঙ্কট৷ সংসদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয়েছে৷ বিক্রমসিংহে এটাকে বলেছেন, অগণতান্ত্রিক অভ্যুথ্থান৷ এই পটপরিবর্তনে ভারতের কপালে পড়েছে ভাঁজ৷ কেন ? প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষ বরাবরই চীনপন্থি৷ তাঁর আমলে, অর্থাৎ ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে চীন অনেকটাই শিকড় গাড়তে পেরেছিলশ্রীলঙ্কার মাটিতে৷ ব্যবসা-বাণিজ্য এবংপরিকাঠামো উন্নয়নে প্রচুর অর্থ ঢেলেছিল চীন৷ রাজাপক্ষ চীনের টাকায় দক্ষিণে নিজের নির্বাচন কেন্দ্রে হামবানটোটা বন্দর তৈরি করতে গিয়ে নাকানি-চুবানি খেয়ে শেষ পর্যন্ত চীনকেই তা বেচে দেন৷ দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালে রাজাপক্ষের ক্ষমতা হারানোর পেছনে নাকি হাত ছিল দিল্লির, এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা৷ অন্যদিকে বিক্রমসিংহে ছিলেন কিছুটা ভারত-ঘেঁষা৷ ফলে রাজাপক্ষের ক্ষমতায় ফিরে আসাটা দিল্লির পক্ষে দুশ্চিন্তার কারণ হবে বলে মনে করা হচ্ছে৷ রাজাপক্ষকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনায় এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক অভিঘাত চীনের অনুকূলে যাবে৷ বেজিং আবার কলম্বোর অর্থনীতি কব্জা করবে৷ চীনের জন্য দরজা খুলে দেবেন রাজাপক্ষ৷ প্রতিকূল অভিঘাতে কলম্বোর উপর দিল্লির প্রভাব শিথিল হবে৷ ভারতের পররাষ্ট্র বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কার ক্ষমতা দখলের রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে চলেছে দিল্লি৷ ভারত আশা করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়াকে মর্যাদা দেওয়া হবে৷
দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ত্রিদিব চক্রবর্তী এই প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে বললেন, এই পরিস্থিতির মূলে আছে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার সংঘাত৷ কে বেশি ক্ষমতাবান ? এটা হচ্ছে প্রথম প্রশ্ন৷ প্রেসিডেন্টের সাংবিধানিক ক্ষমতা থাকলে তিনি তা করতে পারেন৷ আর তা না থাকলে তিনি তা করতে পারেন না৷ তবে কথা হচ্ছে, ক্ষমতার এই সংঘাতে বাইরের শক্তির ভূমিকা থাকতে পারে৷ চীনের ভূমিকা থাকতে পারে৷ চীন নানাভাবে তার ডানা বিস্তার করে চলেছে এই অঞ্চলে৷ যেমন, ভুটান, নেপাল এবং দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে৷ মালদ্বীপের সাম্প্রতিক নির্বাচনে হেরে গেছেন চীনপন্থি আবদুল্লা ইয়ামিন৷ সেই লোকসানটা পুষিয়ে নেবে শ্রীলংকায় চীনের মুঠো শক্ত করে৷ ভুটান সীমান্তে যাকে বলে চিকেন নেকে রাস্তা তৈরির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে, যদিও ভুটান এখনো ভারতের উপর নির্ভরশীল৷ চীনের সঙ্গে এখনো ভুটানের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই৷ ভিয়েতনামের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্পর্কে বাধা দিতে চাইছে বেজিং, ডয়চে ভেলেকে বললেন দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ত্রিদিব চক্রবর্তী৷ পাশাপাশি দক্ষিণ চীন সমুদ্র নিয়ে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে চীন৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই ইস্যুতে ভারতের হাত মেলানোটাও না-পসন্দ চীনের৷ শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দুজনেই চীনের একান্ত বশংবদ৷ অন্যদিকে অপসারিত প্রধানমন্ত্রী বিক্রমসিংহে কিছুটা ভারতপন্থি, এমনটাই মনে করেন তিনি৷
অপসারিত প্রধানমন্ত্রী বিক্রমসিংহে শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্র নীতিতে একটা ভারসাম্য আনার চেষ্টা করে গেছেন৷ ভারত ও জাপানের সঙ্গে সম্পর্কে আনতে চেয়েছেন নতুন গতি৷ অপসারিত প্রধানমন্ত্রী বিক্রমসিংহে বলেছেন, সংসদের অনুমোদন ছাড়া তাঁকে অপসারিত করা যায় না৷ সংসদে এখনো তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে৷ সংসদের ২২৫ জন সাংসদের মধ্যে তাঁর দিকে আছেন ১০৬ জন সাংসদ এবং সিরিসেনা আর রাজাপক্ষের দিকে আছেন মাত্র ৯৫ জন সাংসদ৷ সেটা প্রমাণ করার জন্য অবিলম্বে সংসদের অধিবেশন ডাকার দাবি জানিয়েছেন তিনি৷ সংসদের স্পিকারও বলেছেন একই কথা৷ অবিলম্বে সংসদের অধিবেশন ডাকা দরকার, যদি চলতি সংঘাতের মীমাংসা করতে হয়৷
কিন্তু প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা যদি অধিবেশন না ডেকে ঝুলিয়ে রাখেন, তাহলে সন্দেহ ঘনীভূত হবে৷ দলে টানার জন্য রাজাপক্ষ সাংসদদের টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করছেন৷ তাঁকে মদত দিচ্ছে চীন৷ সংসদের অধিবেশন ডাকার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে৷ চাপ আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলি থেকেও৷ বিক্রমসিংহের অনুগামী জয়সূর্য হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন এই বলে যে, সংসদের অধিবেশন ডাকা না হলে আমরা পথে নামবো৷ পথে নামলে রক্তগঙ্গা বইবে৷ অন্যদিকে রাজাপক্ষের নিয়োগে চীন খুশি৷ নতুন প্রধানমন্ত্রী রাজাপক্ষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট৷ মোটকথা শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতিতে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় চীন আর ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াবে৷ ফলে শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতিতে ভারত রয়েছে অস্বস্তিতে৷