শিরোপা জিততে অস্ট্রেলিয়ার চাই ২৪১
১৯ নভেম্বর ২০২৩প্রত্যাশার চাপে দমে গিয়ে রোহিত শর্মার দল করেছে ২৪০ রান। লোকেশ রাহুল করেছেন ৬৬ রান। মিচেল স্টার্কের উইকেট ৩টি।
ফাইনাল শুরুর আনেক আগেই উৎসবের নগরী হয়ে উঠেছিল আহমেদাবাদ। এমন ঢেউয়ে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়াম রীতিমত নীল সমুদ্র। ছিল নিরাপত্তার কড়াকড়িও। অথচ সেই ফাঁক গলে ১৪তম ওভারে এক দর্শক ঢুকে পড়লেন মাঠে!
ক্রিজে তখন বিরাট কোহলি। দর্শকটির মুখ ফিলিস্তিনের পতাকায় ঢাকা আর জার্সিতে লেখা,‘স্টপ বম্বিং প্যালেস্টাইন’। ৪৫ সেকেন্ড বন্ধ থাকার পর আবার শুরু হয় খেলা।
শুরুতে ব্যাট করতে নেমে টানা ৯৭ বল ভারতের বাউন্ডারিমারতে না পারা! যে দলটা প্রথম ১০ ম্যাচ জিতেছে প্রতিপক্ষকে একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়ে তারাই ফাইনালে ভুগেছে স্নায়ুর চাপে। শিরোপা স্বপ্নে বিভোর এক লাখ ৩২ হাজার দর্শকের সামনে শেষ পর্যন্ত ২৪০ রানে অলআউট স্বাগতিকরা। মিচেল স্টার্ক নেন ৩ উইকেট।
প্রথম ১০ ওভারে ভারতের রান ছিল ৮০। শেষ ১০ ওভারে ৪৩! পুরো ইনিংসটাই এমন দুইভাবে বিভক্ত ভারতের। উড়ন্ত শুরুর পর মাঝখানে কোহলি-লোকেশ রাহুল জুটি গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে আহমেদাবাদের ধীরগতির উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের গতি, কাটার,স্লোয়ার, বাউন্সারে স্কোরটা বড় করতে পারেনি তারা।
ভারতের শুরুটা হয়েছিল উড়ন্ত। ৯.৩ ওভারে ১ উইকেটে স্কোর ৭৬। রোহিত শর্মা তখন শাসন করছেন অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের। ফাইনালের আগে স্টুয়ার্ট ব্রডের ‘ভারত হচ্ছে ফুটবলের ব্রাজিল’ কথাটা তখন আলোচনা হচ্ছিল ধারাভাষ্যকক্ষে।
কিন্তু প্রতিপক্ষের নাম যে অস্ট্রেলিয়া। নকআউটের প্রবল চাপের ম্যাচে সেরাটা খেলে তারা। এর আগে সাতবার বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলে পাঁচবারই জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। ২০০৩ সালে ভারতকেই জোহানেসবার্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ১২৫ রানে। রিকি পন্টিংয়ের ১৩২ রানের অতিমানবিক ইনিংসে স্রেফ উড়ে গিয়েছিল সৌরভ গাঙ্গুলির দল।
আজ তাই ভারতের জন্য ছিল প্রতিশোধের মিশন। তবে আহমেদাবাদ স্টেডিয়াম নীল সমুদ্র হয়ে গেলেও তাতে ডুবে যায়নি পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। বরং পাল্টা আঘাতে ম্যাচে ফিরেছে দুর্দান্তভাবে।
বিশ্বকাপের মাঝেই শুভমান গিল বলেছিলেন ‘‘শুরতে রোহিত খেলে আমি দেখি’’। আজও প্রথম ২৫ বলের কেবল ৬টা খেলেছেন তিনি। সপ্তম বলে ফিরে যান ৪ রান করে। মিচেল স্টার্ককে পুল করতে যেয়ে ক্যাচ তুলে দেন মিডঅনে। ‘‘কাম অন’’ বলে সতীর্থদের উজ্জীবিত করছিলেন স্টার্ক।
সেই স্টার্ককে টানা তিন বাউন্ডারিতে স্বাগত জানান কোহলি। পাওয়ার প্লের শেষ ওভারে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের ওপর চড়াও হয়ে দ্বিতীয় বলে ছক্কা আরা তৃতীয় বলে বাউন্ডারি মারেন রোহিত। পরের বলটা ক্রিজ ছেড়ে বেড়িয়ে ছক্কা মারতে যেয়ে আকাশে তুলে দেন রোহিত (৩১ বলে ৪৭)।
কাভার থেকে ছুটে এসে দুর্দান্ত ক্যাচ নেন ট্রাভিস হেড। এই ক্যাচই মোড় ঘুড়িয়ে দেয় ফাইনালের। কমে যায় ভারতের রানের গতি। ৪ রান করে প্যাট কামিন্সের বলে শ্রেয়াস আয়ার ফিরে গেলে চাপটা বাড়ে আরও। টানা দুই সেঞ্চুরি করা আয়ার ব্যর্থ আসল মঞ্চেই। এই বিশ্বকাপে প্রথম ১০ ওভারে তিনবার ব্যাটিংয়ে নেমে ০, ৪ ও ৪ রানে আউট হয়েছেন তিনি।
গ্রুপ পর্বে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই দ্রুত উইকেট হারানোর পর হাল ধরেছিলেন বিরাট কোহলি ও লোকেশ রাহুল। আজ ফাইনালেও দুজন চতুর্থ উইকেটে গড়েন ৬৭ রানের জুটি। তবে ধীর গতিতে খেলায় ১১ থেকে ২০ ওভারে ৩৫ আর ২১ থেকে ৩০ ওভারে কেবল ৩৭ রান যোগ হয় স্কোরে। পরপর দুই উইকেট হারিয়ে টানা ৯৭ বল ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা বাউন্ডারি মারেননি অতি সতর্কতায়।
৯৭ বল পর ২৭তম ওভারে প্রথম বাউন্ডারি পায় ভারত। ম্যাক্সওয়েলকে স্কুপ করে বাউন্ডারিতে পাঠান রাহুল। কোহলি ফিফটি করেন ৫৬তম বলে। তাতে সপ্তম ব্যাটসম্যান হিসাবে বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের পর ফাইনালে ফিফটি করলেন এই কিংবদন্তি। আগের ছয়জন মাইক ব্রেয়ারলি (১৯৭৯), ডেভিড বুন (১৯৮৭), জাভেদ মিয়াঁদাদ (১৯৯২), অরবিন্দ ডি সিলভা (১৯৯৬), গ্র্যান্ট এলিয়ট (২০১৫) ও স্টিভেন স্মিথ।
ফিফটির কিছুক্ষণ পরই পুরো স্টেডিয়াম স্তব্ধ করে দিয়ে কোহলি বোল্ড হয়ে যান ৬৩ বলে ৫৪ করে। প্যাট কামিন্সের শর্ট বলটা ব্যাটের্ কানায় লেগে আঘাত হানে স্টাম্পে। ডাগআউটে তখন মাথায় হাত অশ্বিনের। চুপসে যায় পুরো গ্যালারি।
সূর্যকুমার যাদবের আগে পাঠানো হয় রবীন্দ্র জাদেজাকে। তবে শুরু থেকে অস্বস্বিতে থাকা জাদেজা ২২ বলে ফেরেন ৯ করে। ৮৬ বলে ফিফটি করা রাহুল মনযোগ দিয়েছিলেন ইনিংস গড়ায়। মিচেল স্টার্কের স্বপ্নের এক বলে ৬৬ রানে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন তিনি। সিমে পড়ে মুভমেন্ট করেছিল বলটা, যার ক্রিকেটীয় নাম ‘স্ক্র্যাম্বলড সিম’।
৪০ ওভার শেষে ভারতের স্কোর ৫ উইকেটে ১৯৭। সেখান থেকে ২৮০-২৯০ রানের পুঁজি পাওয়াটা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে সম্ভব হয়নি সেটা।
গ্রুপ পর্বে কেবল তিন ম্যাচে ৬ উইকেটে হারিয়েছিল তারা। এর দুটিতে ৬ উইকেট হারানোর সময় স্কোরবোর্ডে রান ছিল ৩৩৩ ও ২৬৯। সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষটাই হল আজ। মোহাম্মদ সামি ৭ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসাবে উইকেটে আসেন ৪১তম ওভারে।
তখন নিশ্চিতভাবে হার্দিক পান্ডের অভাববোধ করছিল ভারত। এই অলরাউন্ডার না থাকায় নষ্ট হওয়া ভারসাম্যটা বাজেভাবে ফুটে উঠল ফাইনালের মঞ্চে। টেলএন্ডারদের ব্যর্থতায় ভারত থামে ২৪০ রানে। কুলদীপ যাদব ১০ ও মোহাম্মদ সিরাজ ৯ না করলে স্কোরটা আরও কম হতে পারত স্বাগতিকদের।
ফাইনাল জিততে অস্ট্রেলিয়ানরা যেভাবে ফিল্ডিং করছিলেন তাতে ধারাভাষ্যে আলোচনা হচ্ছিল,‘‘অস্ট্রেলিয়া কি ২০ ফিল্ডার নিয়ে খেলছে।’’ এখন অবশ্য ২০ জনের ব্যাটিংয়ের দরকার নেই। ২৪১ করলেই ‘হেক্সা’ (ষষ্ঠ শিরোপা) জিতবে প্যাট কামিন্সের দল।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
ভারত ৫০ ওভারে ২৪০/১০ (রাহুল ৬৬, কোহলি ৫৪, রোহিত ৪৭ ; স্টার্ক ৩/৫৫, কামিন্স ২/৩৪)