শিক্ষকদের মার, অভিযুক্তদের ধরতে পারলো না পুলিশ
৩০ জানুয়ারি ২০২৪দক্ষিণ ২৪ পরগনার নরেন্দ্রপুরের বলরামপুর মন্মথনাথ বিদ্যামন্দিরে হানা দেয় ২০-৩০ জনের একটি দল। টির্চাস রুমে ঢুকে শিক্ষক-শিক্ষিকারদের মারধর করে দুষ্কৃতীরা। এই ভিডিও সামনে আসায় ভারতে হইচই পড়ে গিয়েছে।
স্কুলে হামলা
সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওয় দেখা গিয়েছে, কয়েকজন বহিরাগত টিচার্স রুমে শিক্ষকদের মারধর করছে। লাথি-ঘুষি মারা হচ্ছে। শিক্ষিকারাও রেহাই পাননি। আক্রান্তদের অভিযোগ, তাদের হেলমেট, জলের বোতল দিয়ে আঘাত করা হয়। ছবি তুলতে গেলে মোবাইল ভেঙে দেয়া হয়।
এর পিছনে স্কুলের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ ইমতিয়াজ আহমেদ রয়েছেন বলে দাবি আক্রান্ত শিক্ষকদের। তিনি ছাড়াও আরো ১৪ জনের বিরুদ্ধে শনিবারই নরেন্দ্রপুর থানায় অভিযোগ দায়ের করেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
তাদের দাবি, প্রধান শিক্ষকের মদতেই এই হামলা হয়েছে। তারা স্কুলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হওয়ায় আক্রমণের শিকার হয়েছেন।প্রধান শিক্ষক অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
প্রধান অভিযুক্তদের কেউই সোমবার পর্যন্ত গ্রেপ্তার হননি। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের আর্জির ভিত্তিতে এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে কলকাতা হাইকোর্ট।
গতকাল বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসু এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক নির্দেশ দেন। সোমবার রাতের মধ্যেই প্রধান শিক্ষক-সহ বাকি অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করতে বলেন তিনি। প্রধান শিক্ষকের স্কুলে ঢোকায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
বিচারপতি একইসঙ্গে মহকুমা শাসককে স্কুল পরিচালনার ভার দেন। শিক্ষকদের নিরাপত্তার দিকটি দেখার নির্দেশ দেন পুলিশকে। সেই অনুযায়ী মঙ্গলবার সকাল থেকে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে ওই স্কুলে।
কোথায় দুষ্কৃতীরা?
তৃণমূলের দাপুটে নেতা সন্দেশখালির শেখ শাহজাহান দীর্ঘদিন ধরে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। পুলিশ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না। নরেন্দ্রপুরের স্কুলে হামলাকারীদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই অবস্থা। ঘটনার পর তিনদিন পেরিয়ে গেলেও প্রধান শিক্ষক-সহ মূল অভিযুক্তদের ধরতে পারেনি পুলিশ। অন্য দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ইতিমধ্যে ভারতে ভাইরাল হওয়া ভিডিওয় এক শিক্ষককে মারধর করতে যে বহিরাগতকে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে, তাকে কেন পুলিশ ধরতে পারল না, এ প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয় সূত্রে খবর, ওই বহিরাগতের নাম প্রবীর সর্দার। তিনি এলাকার তৃণমূল কর্মী হিসেবে পরিচিত।
বিরোধীদের অভিযোগ, স্কুলের দুর্নীতির সঙ্গে শাসক দলের যোগ রয়েছে। এর বিরুদ্ধে মুখ খোলায় শিক্ষকরা আক্রান্ত। তাই পুলিশ দুষ্কৃতীদের ধরতে গড়িমসি করছে।
তৃণমূল কংগ্রেস মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, "খুবই অনভিপ্রেত ঘটনা। যারা এ কাজ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। এর সঙ্গে রাজনীতিকে জোড়া ঠিক নয়।"
শিক্ষকদের দায়ের করা অভিযোগে স্থানীয় তৃণমূল নেতা আকবর আলি খান, অলোক নাড়ুর নাম রয়েছে। স্কুলের পরিচালন সমিতির সদস্য মনিজুর রহমানও রয়েছেন অভিযুক্তদের তালিকায়। সোমবার নরেন্দ্রপুরের আইসিকে এজলাসে ডেকে এদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন বিচারপতি বসু।
বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, "পুলিশ তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের ধরবে না। যে কারণে শাহজাহানকে ধরছে না, একই কারণে নরেন্দ্রপুরে হাত গুটিয়ে রয়েছে।"
পঠনপাঠন ব্যাহত
নরেন্দ্রপুরের স্কুলে প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পঠনপাঠন হয়। পড়ুয়ার সংখ্যা ৭০০-র বেশি। এই ঘটনার পর সোমবার থেকে স্কুলের স্বাভাবিক পঠনপাঠন ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষকরা এলেও স্কুলে ছাত্রদের উপস্থিতির সংখ্যা নগণ্য।
তিনদিন পরেও স্কুলের পরিবেশ থমথমে। শিক্ষকদের দাবি, পরিস্থিতি বিরূপ বুঝে পড়ুয়াদের স্কুলে পাঠাতে চাইছেন না অভিভাবকরা। এতে পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছে। পড়ুয়াদের মধ্যেও আতঙ্ক রয়েছে।
ঘটনা এ দিকে গড়াতে পারে, তার আঁচ অতীতেই করেছিলেন আক্রান্ত শিক্ষকরা। তাদের বক্তব্য, স্কুলে দুর্নীতি নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা আদালতে বিচারাধীন। এই মামলা প্রত্যাহারের জন্য সহ শিক্ষকদের উপর চাপ দিয়েছেন ইমতিয়াজ আহমেদ।
আক্রান্ত শিক্ষকদের অন্যতম রত্নদীপ মিশ্র বলেন, "গোটা বিষয়টি কমিশনার অফ স্কুল এডুকেশন, ডিআইকে জানানো হয়েছিল। থানাকেও বলা হয় যে আমাদের নিরাপত্তার অভাব রয়েছে।"
হাইকোর্টে আজ, মঙ্গলবার ফের এই মামলার শুনানি হয়। সরকারি আইনজীবী জানান, অভিযুক্তদের কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। এ কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসু। তিনি বারুইপুরের পুলিশ সুপারের কাছে দুপুর দুটোর মধ্যে রিপোর্ট তলব করেন।
সমালোচনার ঝড়
শিক্ষকদের উপর হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছেন সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজন।
শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, "আমাদের রাজ্যে এই সংস্কৃতি ছিল না। অত্যন্ত লজ্জাজনক ঘটনা। পুলিশ দুষ্কৃতীদের ধরতে পারছে না, এটা আরো উদ্বেগের।"
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, "এই ঘটনার নেপথ্যে রাজনীতি থাক বা নাই থাক, দুষ্কৃতীদের গ্রেপ্তার করা উচিত। এই ঘটনা একেবারেই কাম্য নয়।"
শিবপুর আইআইইএসটি-র সাবেক রেজিস্ট্রার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "প্রশাসন এ সব ঘটনা সম্পর্কে নীরব। সে কারণেই দুষ্কৃতীরা আরো সাহস পাচ্ছে।"
পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন কিংকর অধিকারী। তিনি বলেন, "স্কুলে ঢুকে দুষ্কৃতীরা শিক্ষকদের মারছে, এটা দেখে ছাত্রছাত্রীরা কী শিখছে! শিক্ষকরা আতঙ্কে থাকছেন, স্কুলে পড়াশোনার পরিবেশ থাকছে না। এই পরিস্থিতি খুবই হতাশাজনক।"