২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন পর্ব। একটি প্রথম সারির বাংলা পত্রিকার রিপোর্টার। ভোট উপলক্ষে দায়িত্ব ছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপির তৎকালীন সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে যে কটি সভা করবেন, তার প্রতিটি কভার করা।
তেমনই এক উপলক্ষে অমিত শাহ এলেন কলকাতা। সাংবাদিক বৈঠক হবে। তার বলা শেষ হওয়ার পর সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করার সুযোগ পেলেন। প্রায় শেষের দিকে অধমের প্রশ্ন শুনে ৩০ সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন সর্বভারতীয় সভাপতি। তারপর মুখে সামান্য শ্লেষ এনে বললেন, ''ইয়ে তো অ্যান্টি ন্যাশনাল সওয়াল হো গ্যায়া।'' বলে সটান উঠে পড়লেন চেয়ার ছেড়ে। শেষ হয়ে গেল সাংবাদিক সম্মেলন। সেই থেকে এখনো বহু বন্ধু অধমকে 'অ্যান্টি ন্যাশনাল' বলেই ডাকেন। বলা বাহুল্য, তারা মজা করেন। কিন্তু ভারতীয় সমাজে অ্যান্টি ন্যাশনাল খুব মজার সম্বোধন নয়। অ্যান্টি ন্যাশনাল- এই অভিযোগে খুন হতে হয়েছে সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে। উত্তর ভারতে অ্যান্টি ন্যাশনাল শব্দবন্ধ সিরিয়াস গালাগাল হিসেবেই ব্যবহৃত হয়। যে কারণে, জেএনইউ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে অতি দক্ষিণপন্থিরা অ্যান্টি ন্যাশনালদের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত করে।
শুধুই কি অতি দক্ষিণপন্থি? ২০১৯ থেকে সাত-আট বছর পিছনে চলে যাওয়া যাক। সদ্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একদল বিশেষজ্ঞ ততদিনে বলতে শুরু করেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আক্ষরিক অর্থে একজন বামপন্থি মনোভাবাপন্ন রাজনীতিবিদ। তিনি সাবঅলটার্নদের প্রতিনিধি, ইত্যাদি ইত্যাদি। তা সে হেন সাবঅলটার্নদের প্রতিনিধি এক মুখ্যমন্ত্রী কলকাতার ঐতিহ্যমণ্ডিত টাউন হলে সাংবাদিক সাগরিকা ঘোষের একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেছিলেন। সাগরিকার পাশাপাশি সেখানে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও মজুত ছিলেন। তারাও প্রশ্ন করার সুযোগ পাচ্ছিলেন। এক ছাত্রীর প্রশ্ন শুনে মুখ্যমন্ত্রী সটান তাকে 'মাওবাদী' বলে দাগিয়ে দিলেন। এবং তারপর লেপেল খুলে অনুষ্ঠান মাঝপথে বন্ধ করে বেরিয়ে গেলেন।
২০১৯ সালে সাংবাদিকের প্রশ্ন শুনে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতির প্রেস কনফারেন্স ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া এবং ছাত্রীর প্রশ্ন শুনে মুখ্যমন্ত্রীর বেরিয়ে যাওয়ার মধ্যে কার্যত কোনো তফাত নেই। দুটোই প্রতিক্রিয়াশীলতার জঘন্য উদাহরণ।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন ঘটনা আরো বহু ঘটিয়েছেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই এক সভায় এক কৃষককে 'মাওবাদী' বলে দাবি করেছিলেন তিনি। ওই কৃষকের অপরাধ ছিল, তিনি সভার মাঝে কিছু প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশি হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিল ওই কৃষককে। আর কেন্দ্রীয় সরকার তো আকছাড় যাকে-তাকে 'দেশদ্রোহী', 'অ্যান্টি ন্যাশনাল', 'আর্বান নকশাল' বলে চিহ্নিত করছে। সরকারের বিপরীত কথা বললেই এই সমস্ত তকমায় ভূষিত করে কারো কারো বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।
গোটা দেশেই রাজনৈতিক পরিসরে এই দাগিয়ে দেওয়ার রাজনীতি চলছে। আর তার ছায়া এসে পড়ছে সামাজিক স্তরে। সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফিরছে এই সব কথা। কেবলই যে দক্ষিণপন্থি রাজনীতি এই কাজ করছে, এমন নয়-- বামপন্থি রাজনীতিও তৈরি করছে এমন অনেক দাগিয়ে দেওয়ার শব্দ, যার অন্যতম 'চাড্ডি' এবং 'তিনু'। বিজেপি বা বিজেপি মনোভাবাপন্ন মানুষকে চাড্ডি এবং তৃণমূলপন্থি মানুষকে তিনু বলে পরিহাস করা এখন কলকাতার বামপন্থি মধ্যবিত্তের স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। সম্প্রতি আরজি কর-কাণ্ড ঘিরে যখন গোটা কলকাতা উত্তাল, তখন এক মিছিলে এই ধরনের শব্দ শুনে এক বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী মিছিলে হাঁটতে হাঁটতেই বলেছিলেন, ''গোটা সমাজটাই আসলে এখন 'আদারিং'য়ের মোডে চলে গেছে। অর্থাৎ, কাউকে অপছন্দ হলেই তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার এক কৌশল। ঐতিহাসিকভাবে এই কৌশলটি দক্ষিণপন্থি হলেও ইদানীং তা বামপন্থি সংস্কৃতিতেও ঢুকে পড়েছে।''
তার এই কথা শুনতে শুনতে আরো গভীর কিছু ভাবনা মাথায় আসছিল। পশ্চিমবঙ্গে যুযুধান দুই ফুটবল ক্লাব ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগান। জন্মলগ্ন থেকে মোহনবাগান পরিচিত এপার বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের ক্লাব হিসেবে। অর্থাৎ, যারা বরাবরই পশ্চিমবঙ্গবাসী। আর ইস্টবেঙ্গলের পরিচিত রিফিউজি বাঙালের ক্লাব হিসেবে। দেশভাগের বোঝা মাথায় নিয়ে যারা পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিমবাংলায় চলে এসেছিলেন।
এই পর্যন্ত কোনো সমস্যা ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতায় ঘটি-বাঙাল বিতর্ক, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান বিতর্ক ঐতিহাসিক এবং মুখরোচক। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ম্যাচ মানে ইলিশ-চিংড়ির লড়াই। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ এক সময় দেখা গেল, ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের 'লোটা' বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লোটা শব্দটি এসেছে লোটাকম্বল শব্দবন্ধ থেকে। অর্থাৎ, লোটাকম্বল নিয়ে যাদের এক পার থেকে আরেক পারে চলে আসতে হয়েছিল। অর্থাৎ, বাস্তুহারা রিফিউজির সবচেয়ে সংবেদনশীল জায়গাটিকে আঘাত করা হচ্ছে। কখন ঘটছে এই ঘটনা? যখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ধর্মীয় মেরুকরণের আধারে ঢুকে পড়েছে। 'ঘুসপেটিয়া' অর্থাৎ, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী যখন রাজনীতির অন্যতম অস্ত্র। যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালি আক্রান্ত হচ্ছে 'ঘুসপেটিয়া' বা 'বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী' সন্দেহে। কেন আক্রান্ত হচ্ছেন তারা? হিন্দি না বলতে পারা এবং খাদ্যাভ্যাসের জন্য।
তুমি আমার মতো নও, তাই তুমি আমার দেশের নও- এই ধারণাটি যত দিন যাচ্ছে তত বেশি এঁটে ধরছে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য নামক একটি বিরাট দেশ, ভারতবর্ষকে। দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তুমি আমার নও। তাই তুমি ঘুসপেটিয়া অথবা দেশদ্রোহী।
তাসের দেশে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, চলো নিয়মমতে। দেশের রাজনীতি এখন সে কথাই বলার চেষ্টা করছে। সকলকেই চলতে হবে শাসকের নিয়ম মতে। সকলকেই হতে হবে একরকম। একটু অন্যরকম হলেই তাকে দাগিয়ে দাও, ট্যাগ করে দাও। তারপর সরিয়ে দাও সমাজের মার্জিনে। উল্টো কথা শোনার আর কোনো লোক থাকবে না তাহলে। রাজনৈতিকভাবেও নয়, সামাজিকভাবে তো নয়ই।