লাঠি হাতে নতুন লড়াইয়ে জুলু মেয়েরা
২৫ অক্টোবর ২০১২জুলু৷ ইতিহাস বলে, তাঁদের উৎপত্তি দক্ষিণ আফ্রিকার কোয়া-জুলু নাটাল প্রদেশের একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থেকে৷ জাতির জনক জুলু কান্টোমভেলা৷ ১৭০৯ সালে জুলুরা আত্মপ্রকাশ করে মূলত তাঁর কারণেই৷ উনবিংশ শতাব্দীতে জুলুদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়৷ শোনা যায়, কৃষ্ণকায় জুলুদের সে সময় নেহাতই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে দেখা হতো৷ করা হতো অকথ্য অত্যাচার৷
বর্তমানে অবশ্য তাঁরা দেশটির সর্ববৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃত এবং তাঁদের অধিকারও সংরক্ষিত৷ অন্ততপক্ষে খাতায়-কলমে৷ দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে আজ খুব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে চলেছেন জুলুরা৷ এই যেমন জ্যাকব জুমা৷ এখন তো তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট!
জুলু জনগোষ্ঠীর এমন অগ্রগতিতে নেলসন ম্যান্ডেলার বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের অবদান অনেক৷ কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে? আজও যে অসংখ্য জুলু নারী পুরুষতন্ত্রের নির্মমতার শিকার৷ পুরুষের হাতে নিগৃহীত৷ তবে সময় বোধহয় বদলাচ্ছে৷ জুলু নারীরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বৈরিতার একটা শেষ দেখতে চান এবার৷ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন হাতের লাঠিকে!
এই লাঠির সাহায্যেই এক সময় জুলুরা বর্ণবাদের বিরুদ্ধেও লড়েছে৷ সেটা ছিল শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের লড়াই৷ তবে আজ, নিজ দেশে, নিজ সমাজেই নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছেন নোন্হলে জুঙ্গুর মতো অসংখ্য নারী৷ বলতে গেলে খেলার ছলেই তাঁরা হাতে তুলে নিয়েছেন লাঠি, জুলু ভাষায় যাকে বলে ‘ইন্ডুকু'৷ জুঙ্গুর নিজের ভাষায়, ‘‘আমাকে অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, কেন আমি ‘ইন্ডুকু' বেছে নিলাম....কারণটা স্পষ্ট৷ এটা প্রথম থেকেই পৌরুষত্বের অঙ্গ ছিল৷ পুরুষরা এই লাঠি হাতে নিজেদের ক্ষমতাটা জাহির করত৷ রাজা শাকার আমল থেকে চলছে এই প্রথা৷ পরে এটা খেলা হিসেবে স্বীকৃতি পায়৷ আর আমি প্রথমবার খেলেই এর প্রেমে পড়ে যাই৷''
মেয়েদের হাতের এই লাঠি বা ‘ইন্ডুকু' যে অনেক জুলু পুরুষের ভ্রূকুঞ্চনের কারণ হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য৷ তবে মেয়েদের এই লাঠি-খেলা দেখে তাঁদের প্রতি পুরুষদের মনে যে একটা ভয় বা ক্ষীণ হলেও সম্ভ্রম কাজ করছে না – সেটাই বা কে হলফ করে বলতে পারে?
ডারবান শহরের কোয়া মাশু অঞ্চলে একটা খেলার মাঠে লাঠি-খেলা চলছে৷ খেলছেন ২৪ বছরের সবু ড্লামিনি৷ দু'হাত লম্বা ‘ইন্ডুকু'টি তিনি ছুড়ে দিচ্ছেন আকাশে৷ পর মুহূর্তেই সেটা এক লাফে লুফে নিচ্ছেন, নাচের মতো নিজের প্রতিপক্ষকে বৃত্তাকারে ঘুরে এসে আবারো দাঁড়াচ্ছেন আগের জায়গায়৷ চমৎকার!
মজার বিষয়, কোয়া মাশু ডারবানের এমন একটা অঞ্চল যেখানে অপরাধমূলক রাহাজানি, মারামারি, শ্লীলতাহানী, এমনকি বাড়ি বাড়ি নারীর ওপর অত্যাচারের মতো অপরাধমূলক কাজও নতুন কিছু নয়৷ অথচ শহরের ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়েই এমন লড়াকু খেলায় মেতে উঠেছেন জুঙ্গু এবং সবুর মতো মেয়েরা৷ সবুর কথায়, ‘‘খেলাটা মেয়েরা এখন ছেলেদের মতোই ভালো খেলছে৷ ফলে আমাদের সঙ্গে ছেলেরা এখন বেশ সম্মানের সঙ্গে মাথা নীচু করে কথা বলে৷ হবে না? তারা এটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে যে আমরাও এখন নিজেদের রক্ষা করতে পারি৷ এই তো, সেদিনই একটা ছেলে আমাকে রাস্তায় বেকায়দায় ফেলতে চাইছিল৷ হয়ত তার উদ্দেশ্য ছিল আরো ভয়ঙ্কর কিছু করার৷ কিন্তু আমি ছাড়ি নি৷ লাঠির এমন একটা বারি মারি যে সে সঙ্গে সঙ্গেই কুপোকাত৷ এরপর থেকে আর সে আমায় বিরক্ত করতে আসে না৷''
ঐতিহ্যবাহী একটি লাঠি-খেলার এমন ব্যবহার – ভাবা যায়? জুঙ্গু এবং সবুরাদের একটাই আশা – মেয়েরা যেন আরো বেশি হারে এগিয়ে আসেন লাঠি-খেলায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন লাঠি হাতে, ‘ইন্ডুকু' হাতে তাঁরা যেন ছেলেদের পাশাপাশি মাথা উঁচু করে এগিয়ে যেতে পারেন ভবিষ্যতের দিকে৷ খেলার মঞ্চে তো বটেই, জীবনের মঞ্চেও এই ‘ইন্ডুকু'-ই তাঁদের সাহস জোগাবে৷ বাড়াবে আত্মমর্যাদা৷