রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রহীনতা...
১৪ আগস্ট ২০১৭পত্রপত্রিকায় রোহিঙ্গা সদস্যদের হত্যা, নির্মমভাবে মার খাওয়া এবং আরো অন্যান্য নির্যাতনের খবর আসে৷ দেশটির অভ্যন্তরে এই সংকট সবচেয়ে বিপদে ফেলে প্রতিবেশী বাংলাদেশকে৷ হাজারো রোহিঙ্গা অধিবাসী অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে আসেন এ দেশের দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তে৷ কিন্তু এই সংকট একদিনের নয়৷
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ১৯৯৯ সালের রিপোর্ট বলছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার শুরু হয় ১৯৭৮ সালে৷ সংকটের শুরু অবশ্য ১৯৬২ সালে, যখন দেশটিতে মিলিটারি শাসন শুরু হয়৷ তখন থেকেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা শুরু করেন তাঁরা৷
এ সব অত্যাচার সইতে না পেরে সে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে তাঁরা বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় শরণার্থী হন৷ বাংলাদেশ সীমান্ত অনেক কাছাকাছি হওয়ায় এখানেই তাঁদের স্রোত সবচেয়ে বেশি৷
২০১৬ সালের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর রিপোর্টে দেখা যায়, ৩ থেকে ৫ লাখ নিবন্ধনহীন রোহিঙ্গা আছেন বাংলাদেশে৷ কিছু কিছু পত্রিকার হিসেবে সংখ্যাটি ৮ লাখও হতে পারে৷
রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সত্তরের দশক থেকেই এখানে দলে দলে রোহিঙ্গারা আসতে শুরু করেন৷ জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর ২০১৫ সালের হিসেব বলছে, কক্সবাজারের কুতুপালং ও নয়াপাড়া ক্যাম্পে ৩১,৭৫৯ জন নিবন্ধিত শরণার্থী আছেন৷ এর বাইরে প্রায় ৩ থেকে ৫ লাখ রোহিঙ্গা আছেন, যাঁদের কিছু অংশ লেদা ও কুতুপালং মেকশিফট ক্যাম্পে থাকেন৷ বাকিরা আশেপাশের গ্রাম বা শহরে বাঙালিদের সঙ্গে মিশে গেছেন৷ ১৯৯২ সালের পর যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছেন, তাঁদের আর শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি বাংলাদেশ৷ তাই এরপর যাঁরা এসেছেন বাংলাদেশে তাঁরা অবৈধ৷
এ সব অবৈধ মিয়ানমার নাগরিক শুধু মিয়ানমারেই নন, বাংলাদেশেও খুব সহজেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন৷ তাঁদের অসহায়ত্বের সুযোগ নেন অনেকেই৷
রোহিঙ্গা নারীরা যৌন নিপীড়নেরও শিকার হন৷ নারী পুরুষ উভয়েই জড়িয়ে পড়েন অপরাধ জগতের সঙ্গে৷ বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, রোহিঙ্গারা মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের সঙ্গেই শুধু জড়িত হন না, তাঁরা রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক সংকট তৈরিতেও ব্যবহৃত হন৷
মিয়ানমারের বিভিন্ন সম্প্রদায়
২০০৭ সালে প্রকাশিত বই ‘পলিটিকাল অথরিটি ইন বার্মাস এথনিক মাইনরিটি স্টেটস'-এ লেখক ও গবেষক মেরি পি ক্যালাহান লিখেছেন, মিয়ানমারের বিভিন্ন রাজ্যে যে সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট আছে, তা পরিবর্তনশীল ও জটিল৷ তাঁর মতে, একেক রাজ্যের একেক ধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু রয়েছে৷ তিনি মূলত রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের তিনটি প্যাটার্ন দেখতে পেয়েছেন৷ প্রথম প্যাটার্নে তিনি দেখেছেন, কোনো কোনো রাজ্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করেন৷ দ্বিতীয় প্যাটার্নে দেখা যাচ্ছে, তাতমাদাও বা বার্মিজ সেনাবাহিনী ও অন্যান্য স্টেট এজেন্সিগুলো রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন৷ রোহিঙ্গা ও রাখাইন অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যও এই প্যাটার্নে পড়ছে৷
তৃতীয় প্যাটার্নে দেখা যায়, এ সব রাজ্যে বিভিন্ন কৌশলগত গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে৷ যেমন বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন সংগঠন, ধর্মীয় নেতা, এনজিও এবং সরকারি কর্মকর্তারা এ সব রাজ্যে আধিপত্য বজায় রেখেছেন৷
ক্যালাহানের ভাষায়, ‘‘সাধারণভাবে বলতে গেলে, রাজনৈতিক ক্ষমতা তাঁদেরই হাতে, যাঁরা নৈরাজ্য তৈরি করতে সক্ষম, যেমন তাতমাদাও, সরকারবিরোধী সশস্ত্র গ্রুপ, অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রকরা এবং প্যারামিলিটারিরা৷''
মিয়ানমারে ১৩৫টি বিভিন্ন সম্প্রদায় রয়েছে, যাঁরা মূলত আটটি জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত৷ এঁরা হলেন কোচিন, কায়াহ, কায়িন, চিন, বামার, মোন, রাখাইন ও শান৷ এঁদের প্রত্যেকের নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতি আছে৷
ভৌগলিভাবে মিয়ানমার সাতটি অঞ্চল ও সাতটি রাজ্যে বিভক্ত৷ অঞ্চলগুলোতে প্রধানত থাকেন বামার বা বার্মানরা৷ আর সাতটি রাজ্য বাকি সাতটি মূল গোষ্ঠীর নামে নামকরণ করা হয়েছে৷ বামার বা বার্মানরা মোট জনসংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ৷ তাঁরাই মিলিটারি ও সরকার নিয়ন্ত্রণ করেন৷
বাকি এক তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই থাকেন সম্পদের আধার সীমান্ত এলাকাগুলোতে৷ যুগ যুগ ধরে এ সব অঞ্চলগুলোতে উন্নয়ন প্রকল্প ও সম্পদ উত্তোলনের নামে এ সমস্ত জনগোষ্ঠীকে বিতাড়িত করা হয়েছে তাঁদের এলাকাগুলো থেকে৷ তাঁরা সরে গেছেন দেশেরই অন্যান্য অঞ্চলে অথবা আশেপাশের দেশে৷
১৩৫টি জনগোষ্ঠীকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে তা জোটেনি৷ তাই নিজ দেশে কিংবা আশ্রিত দেশে, রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রহীন, ঘরহীন৷
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা
মিয়ানমারের একটি বড় অংশ মনে করেন, রোহিঙ্গারা কখনোই তাঁদের দেশের নন৷ তাঁরা কয়েক যুগ আগে বাংলাদেশ থেকে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা' উপদ্রপকারী৷ এই তকমা যতটা না ঐতিহাসিক, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক৷
ব্যাপারটি হলো, সেনানিয়ন্ত্রিত এ অঞ্চলটি সবসময়ই স্বাধীনতাকামী৷ এ রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ বৌদ্ধ রাখাইনরা৷ এই রাখাইনরা যেমন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে থাকেন, তেমনি এই দ্বন্দ্ব কেন্দ্রের সরকার বা সেনাদের জন্যও অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ সহজ করে দেয়৷
তার ওপর অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, সীমান্তের দুই পাড়ে একটি অবৈধ ব্যবসা চক্র গড়ে উঠেছে, যা চালাতে গেলে এ অঞ্চলটি অস্থিতিশীল থাকা দরকার৷ আরো কিছু ‘ফ্যাক্টর' পরবর্তীতে যোগ হয়েছে, যা কিনা এই অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাধা দিচ্ছে৷ তবে রোহিঙ্গারা কয়েক যুগ আগে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে গেছেন, সেখানকার জনগোষ্ঠীর এই দাবি একটি ঐতিহাসিক ভুল৷
রোহিঙ্গা নামটি নিজেরাই নিজেদের দিয়েছিলেন দেশটির সবচেয়ে নিপীড়িত এই জনগোষ্ঠী৷ পঞ্চাশের দশকের দিকে এই নামটি বেশ চালু হয়ে যায়৷ তবে কোনো কোনো ইতিহাসবিদের মতে, এই নামের উৎস কয়েকশ' বছর আগেকার৷
২০১৪ সালের এশিয়া রিপোর্টে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ‘রোহাঙ' শব্দটির বুৎপত্তি ‘আরাকান' শব্দটি থেকে এবং ‘গা' বা ‘গিয়া' অর্থ ‘থেকে'৷ অর্থাৎ রোহাঙ্গা বা রাখাঙ্গা অর্থ আরাকান অঞ্চলের মানুষ৷
রাখাইন ইতিহাস বিশ্লেষক জ্যাকুয়েস পি লাইডার তাঁর গবেষণাধর্মী লেখা ‘রোহিঙ্গা: দ্য নেইম, দ্য মুভমেন্ট, দ্য কোয়েস্ট ফর আইডেনটিটি'-তে লিখেছেন যে, ‘রোহিঙ্গা' নামটি রাখাইনের ভারতীয় সংস্করণ, ‘রাখাঙ্গা' থেকেই এসেছে৷
ইন্দো-আর্য ভাষার ঐতিহাসিক ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন, এটি রাখাঙ্গার ফোনোলজিকাল বিকৃতি৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘শব্দটির মানে স্থানীয় মুসলিম ভাষাভাষীদের কাছে রাখাইনই ছিল৷''
আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গাদের আগমন পনেরশ' শতকে৷ সংখ্যায় ছিলেন প্রায় ১০ থেকে ২০ লাখ৷ ঐতিহাসিকভাবেই রাখাইনরা শত বছর ধরে স্বাধীন ছিলেন৷
আরাকানের সবশেষ স্বাধীন শাসক ম্রক-উ পরাজিত হন ১৭৮৪ সালে৷ তাঁর সেনাবহরে মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্ম বর্ণ জাতির সদস্য ছিলেন৷ গবেষণায় দেখা যায়, তাঁর পরাজয়ের পর ২০ হাজারেরও বেশি রাখাইনবাসী চট্টগ্রামের দিকে সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেন এবং আবারো আরাকান রাজ্য জয়ের চেষ্টা করতে থাকেন৷ যখন ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে এবং আস্তে আস্তে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নেয়, তখন ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় রাখাইনরা গুরুত্বপূর্ণ পদ পায়৷
এই সীমান্ত এলাকাটিতে সবসময়ই বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মিশ্র জনগোষ্ঠী ছিল৷ তবে এখানে সাম্প্রদায়িক সংকট শুরু হয়, যখন ১৯২০ সালের দিকে ভারতবর্ষ থেকে (মূলত চট্টগ্রাম থেকে) অনেক মুসলিম সেটলারকে নিয়ে যায় ব্রিটিশরা৷ লাইডার মনে করেন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তখন এ অঞ্চলে তাঁদের কর্তৃত্ব হারানোর শঙ্কায় পড়েন৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিয়ানমারের জাতীয়বাদী নেতা অং সানের বার্মা ইন্ডিডেন্ডেন্স আর্মি ৫ লাখেরও বেশি ভারতীয় সেটেলারকে তাড়িয়ে দেয়৷ ব্রিটিশরা চলে যাবার পর রাখাইন বৌদ্ধ বা মুসলিম গোষ্ঠীদের কেউই অস্ত্র জমা দেয়নি৷ বরং রাখাইন অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যে ও রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতার জন্য কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়৷
তাঁরা সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের অংশ হওয়ার জন্য আন্দোলন করেন৷ ১৯৭৪ এর সংবিধানে অবশেষে আরাকানকে রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং রাজ্যের নাম রাখা হয় ‘রাখাইন'৷
পরবর্তীকালে, বার্মিজ মিলিটারি তাতমাদাও একের পর এক মিলিটারি অপারেশন চালায় রাখাইন রাজ্যে৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ১৯৯৬ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৯২ সালের জুলাই মাস নাগাদ, ২ লাখ ৬০ হাজার মুসলিম রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে যান৷
২০১৬ সালের ‘অক্টোবর অ্যাটাক'
ভোরের আলো ফোটার আগেই গেল ৯ অক্টোবর কয়েকশ' মানুষ বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা পুলিশ চৌকিতে আক্রমণ করেন৷ এতে ন'জন পুলিশ সদস্য মারা যান৷ জঙ্গি সংগঠন হরকাত আল-ইয়াকিন এই আক্রমণের সঙ্গে জড়িত বলে ধারণা করা হয়৷
আততায়ীদের ধরতে সরকার সেখানে সেনাসদস্য মোতায়েন করে৷ তারা সেখানে অভিযানও শুরু করে৷ অঞ্চলটি সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মীসহ সাধারণের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়৷
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এ সব এলাকায় আগুনের শিখা দেখা যায়৷ অনেক রোহিঙ্গাকে মেরে ফেলা হয়৷ অনেক নারী ধর্ষিতা হন৷ অনেক যুবক নির্যাতনের শিকার হন৷ হাজারো রোহিঙ্গা অধিবাসী সীমান্ত পাড়ি দিয়ে টেকনাফ ও কক্সবাজারে গিয়ে আশ্রয় নেন৷ কয়েকমাস ধরে এমন অবস্থা বিরাজ করে৷ সীমান্ত পাড়ি দেয়া অনেক রোহিঙ্গার মুখে সাধারণ মানুষের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভয়াবহ চিত্র শোনা যায়৷
সদ্য ‘গণতন্ত্র' ফেরত পাওয়া মিয়ানমারের অবিসংবাদিত নেতা অং সান কন্যা সুচি দাবি করেন, রাখাইন অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়নি৷ আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো পরিস্থিতি দেখার জন্য এ অঞ্চলে যেতে চাইলেও যেতে দেয়া হয়নি৷ গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৭৫ হাজার রোহিঙ্গা ঘরছাড়া হয়েছেন৷
গণমাধ্যমের ভুমিকা
মিয়ানমারের প্রায় সব গণমাধ্যমই সরকার বা সেনা নিয়ন্ত্রিত৷ ২০১১ সাল পর্যন্ত সরকারি বা ব্যক্তি মালিকানাধীন সংবাদপত্রগুলো সবই সরকার কঠিন নিয়মে আবদ্ধ ছিল৷
কোনো পত্রিকায় কোনো প্রতিবেদন সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না৷ ২০১১ সালের জুনে এই নিয়ম কিছুটা শিথিল করা হয়৷ গণমাধ্যম পর্যবেক্ষণ ও নিবন্ধন বিভাগ বন্ধ করে দেয়া হয়৷ তখন থেকে এ পর্যন্ত মিয়ানমারে ৩১টি দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশের অনুমোদন পায়, যার মধ্যে ২৪টি স্থানীয় ভাষায়৷
তবে ২০১১ সালের পরও অনেক সাংবাদিককেই জেল জরিমানা গুনতে হয়েছে প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য৷ অক্টোবরের ঘটনার পর একটি গবেষণায় দুই সপ্তাহ ধরে মিয়ানমারের দু'টি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করা হয়৷ এর একটি হলো গ্লোবাল নিউ লাইট অফ মিয়ানমার, যেটি দেশটির সবচেয়ে পুরোনো পত্রিকা নিউ লাইট অফ মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক সংস্করণ এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত৷
অন্যটি মিয়ানমার টাইমস৷ এটি ব্যক্তিখাতের এবং একমাত্র বিদেশি মালিকানার পত্রিকা৷ এই ঘটনায় এই পত্রিকার রিপোর্ট ব্যাপক আলোচিত হয়েছে৷
গবেষণাটি ছিল, অক্টোবরের ঘটনার পর রোহিঙ্গাদের কিভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে৷ এছাড়া চিত্রায়িত করার সময় কাদের বক্তব্য ব্যবহার করা হয়েছে৷ যদিও রোহিঙ্গাদের চিত্রায়নের জন্য ছয়টি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল, মোটা দাগে ‘ভিক্টিম' বা ‘অপরাধী' – এই দু'টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে৷
দেখা গেছে, গ্লোবাল নিউ লাইট অফ মিয়ানমার পত্রিকায় যতবার রোহিঙ্গাদের বিষয়টি এসেছে, ততবারই তাঁদের অপরাধী হিসেবেই তুলে ধরা হয়েছে৷ আবার, মিয়ানমার টাইমসে প্রায় ৬০ ভাগ সময় ভিক্টিম হিসেবেই চিত্রায়িত হয়েছেন রোহিঙ্গারা৷
গ্লোবাল নিউ লাইটে এমনও খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, দুষ্কৃতিকারীরা ঘরে আগুন জ্বালিয়ে চলে গেছে৷ তবে সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, পত্রিকাটির যে সব রিপোর্ট গবেষণার আওতায় ছিল, তার কোথাও ‘রোহিঙ্গা' শব্দটি ছিল না৷ এঁদের ‘বাঙালি সেটলার' বলে চিহ্নিত করা হয়েছে৷ এই ‘রাজনীতি' পরিষ্কার৷
বোঝাই যায়, এটা গণমাধ্যমের নীতি নয়, সরকারি নীতি৷ কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ রিপোর্টেই তারা ইরাবতী বা অন্যান্য সরকারি নিউজ এজেন্সির খবর হুবুহু ছাপিয়ে দিচ্ছে৷
অন্যদিকে, মিয়ানমার টাইমস আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধর্ষণের বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা ব্যাপক আলোড়ন জাগায় আন্তর্জাতিক মহলে৷
তবে মিয়ানমারের ভেতরে এই পত্রিকাটি তেমন কেউ পড়ে না৷ এর কারণ পত্রিকাটি তুলনামূলক নতুন৷ তাই সরকারি ভাষ্যগুলোই অন্যান্য এলাকার মানুষের কাছে পৌঁছায়৷ গবেষণায় এ-ও দেখা যায়, গ্লোবাল নিউ লাইট প্রায় ৯১ শতাংশ বক্তব্য প্রকাশ করেছে সরকার ও রোহিঙ্গা বিরোধী গোষ্ঠীর৷ অন্যদিকে, মিয়ানমার টাইমসের বেলায় সেটি ছিল ৫৮ শতাংশ৷
গবেষণার সীমাবদ্ধতার জায়গায় গবেষক লিখেছেন যে, বার্মিজ ভাষায় দক্ষতা না থাকায়, সে ভাষার কোনো পত্রিকা বিশ্লেষণ করা যায়নি৷
সরকারি পত্রিকায় যেভাবে ঢালাওভাবে ঘটনাটি প্রকাশ করেছে তা একটি গণতান্ত্রিক দেশে নিতান্তই গণতন্ত্রহীনতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা হয়৷ সব মিলিয়ে রাষ্ট্রহীনতার ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক চিত্রই বোধ হয় রোহিঙ্গাদের৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷