রেমালে বাঁধ ভেঙে বড় ক্ষতি
২৮ মে ২০২৪পানি নামছে না৷ ফলে তারা বাড়ি-ঘরেও ফিরতে পারছেন না৷ পানি উন্নয়ন বোর্ড এখনো এখনো ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধের প্রকৃত সংখ্যা জানতে পারেনি৷ এই হিসাবের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপবিভাগীয় প্রকৌশলী পার্থ প্রতীম মজুমদার বলেন, "উপকূলীয় অনেক জেলায়ই বাঁধ ভেঙে গেছে৷ কিন্তু কী পরিমাণ ভেঙেছে, তা এখানো হিসাব হয়নি৷” জানা গেছে, খুলনা, বগেরহাট, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনায় বাঁধ বেশি ভেঙেছে৷
এর মধ্যে খুলনা বিভাগে ৬১ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ বরগুনায় ১২ কিলোমিটার, পটুয়াখালিতে ৯ কিলোমিটার এবং ভোলায় ১৩ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ পুরো বরিশাল বিভাগে ৫০ কিলোমিটার বাঁধের ক্ষতি হয়েছে৷
খুলনার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বাটাবুনিয়া এলাকায় বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে গেছে৷ ওই ইউনিয়নের মেম্বার জগদীশ মন্ডল বলেন, " আমার এলাকায় বাঁধ ভেঙে পুরো এলাকা পানির নিচে চলে গেছে৷ এমনিতেই বাঁধ নিচু৷ তারপরও জলোচ্ছ্বাসে মাটির বাঁধ টিকতে পারেনি৷ আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আগে থেকেই জানিয়েছি৷ নিজেরাও বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করেছি, পারিনি৷ আমার এলাকারই প্রায় ১০ হাজারের মতো মানুষ এখন পানিবন্দি৷ আর উপজেলার আরো অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙে গেছে৷”
খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নেও বাঁধ ভেঙে গেছে৷ ওই এলাকার ১৭ টি জায়গায় বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করেছে৷ স্থানীয় লোকজন চেষ্টা করেও বাঁধ রক্ষা করতে পারেননি৷ ওই এলাকার ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ফেরদৌস ঢালি বলেন, "মাটির বাঁধ পানিতে টেকে না৷ আমরা খবর দেয়ার পর কিছু ব্লক ফেলেছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড৷ কিন্তু তা পানির তোড়ে ভেসে গেছে৷ আমরা চেষ্টা করেছি, রাত জেগে বাঁধ পাহারা দিয়েছি৷ কিন্তু পানি বেড়ে যাওয়ায় বাঁধ ভেঙে যায়৷ আমাদের এলাকায় ১০ কিলোমিটারেরও বেশি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ পুরো উপজেলায় ৬০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন৷”
তিনি আরো বলেন, " বছরের পর বছর এই মাটির বাঁধ দিয়ে চলছে৷ প্রতি বছর ভাঙে আবার মেরামত করা হয়৷ কিন্তু কোনো কাজে আসে না৷ ঠিক সময়ে সিমেন্টের ব্লক ফেলা হয় না৷”
বরগুনার আমতলী উপজেলার আরপাঙ্গাসিয়া ইউনিয়নে বাঁধ ভেঙে প্রায় পুরো ইউনিয়নই পানির নিচে চলে গেছে৷ সেখানকার ২৭ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে৷ ইউপি চেয়ারম্যান সোহেলী পারভিন মালা জানান, তিন কিলোমিটারের মতো বাঁধ ভেঙে পায়রা নদী থেকে তীব্র জলোচ্ছ্বাস হয়েছে৷ তিনি বলেন, "পানি ঢোকার পর এখন পানি নামার জায়গা নাই৷ ফলে ক্ষতিগ্রস্তরা এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে৷”
তিনি বলেন, "এই এলাকায় সিমেন্টের ব্লক দিয়ে সাড়ে চারশ' কোটি টাকার নদী রক্ষা বাঁধের কাজ অনেক আগে শুরু হলেও তা শেষ হয়নি৷ সেটা হলে হয়ত বা আমার ইউনিয়ন রক্ষা পেতো৷”
তার অভিযোগ, "দুর্নীতি আর চাঁদাবাজির কারণে কাজ শেষ হচ্ছে না৷”
বরগুনা জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন বলেন, "আমতলিতে চার কিলোমিটারের মতো বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ আরো খবর আসছে৷ জেলায় মোট ৮০০ কিলোমিটার বাঁধ আছে৷” তার কথা, "সারা দেশের বাঁধই মাটির৷ কোথাও কোথাও ব্লক দেয়া আছে৷ আমরা চেষ্টা করি রক্ষণাবেক্ষনের৷ কিন্তু পানি বেশি হলে বাঁধ ভেঙে যায়৷” আর আরপাঙ্গাসিয়া ইউনিয়নের নদী রক্ষা বাঁধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "এটা হলে এলাবাসী রক্ষা পাবেন৷ তবে নানা কারণে কাজ শেষ হতে সময় লাগছে৷”
খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, "বাঁধগুলো অনেক জায়গায়ই নিচু৷ আবার কোথাও কোথাও বাঁধের প্রস্থ কমে গেছে৷ মাটির বাঁধ আমরা চেষ্টা করি ঠিক রাখতে৷ কিন্তু সবটা পারি না৷”
তিনি কয়রা এলাকার লোকজনের অভিযোগের জবাবে বলেন, "আমরা খবর পেয়েই ব্লক ফেলে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করি৷ কিন্তু পানির তোড়ে ব্লক ভেসে যায়৷”
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সারা দেশে উপকূলীয় এলাকায় ১৯ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে৷ কিন্তু এই বাঁধের অর্ধেকই ঝঁকিপূর্ণ৷ প্রত্যেক বছর বাঁধ মেরামত করা হলেও তা কাজে আসে না৷ কারণ, এখানে ব্যাপক দুর্নীতি হয় বলে অভিযোগ করেন নদী গবেষণা ইনস্টিউটের সাবেক মহাপরিচালক এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক কমর্কর্তা প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক৷ তিন বলেন, "আসলে যখন ব্লক ফেলা দরকার, তখন ফেলা হয় না৷ আবার যখন বালুর বস্তা ফেলা দরকার তখন ফেলা হয় না৷ ঠিকমতো বেড়ি বাঁধগুলোর রক্ষণাবেক্ষন করা হয় না৷ কিন্তু এই খাতে প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয়৷ ৫০০ ব্লক ফেলে পাঁচ হাজার ব্লকের বিল করা হয়৷ বালুর বস্তার কোনো হিসাব থাবে না৷”
তার কথা, " বহু কাল ধরে এই মাটির বাঁধগুলো আছে৷ কিন্তু এগুলো নিয়ে নতুন কোনো ভাবনা নাই৷”
আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহর নাঈম ওয়ারা বলেন, "আসলে এইসব বাঁধ রক্ষায় স্থানীয় মানুষকে যুক্ত করা প্রয়োজন৷ কিন্তু সেটা করা হয় না৷ সারা বছর এগুলো নিয়ে বাস্তবে কোনো কাজ হয় না, যদিও কাজের নামে অর্থ খরচ হয়৷”
রেমালের ক্ষয়-ক্ষতি
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে ২৬ লাখ ৫৪ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ঘূর্ণিঝড়ে৷ মারা গেছেন ১০ জন৷ ৩৫ হাজারের বেশি বাড়ি-ঘর নষ্ট হয়েছে৷ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার বাড়ি-ঘর৷ ১৮টি জেলার ৮৮ উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় তাণ্ডব চালায়৷