রামপুরহাট নৃশংসতা: বিশিষ্টদের একাংশের নীরবতায় প্রশ্ন
২৬ মার্চ ২০২২রামপুরহাটে অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন মানুষ৷ পুড়ে গিয়েছে ঘরবাড়ি৷ দমকলকর্মীরা বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে উদ্ধার করেছেন ছাই হয়ে যাওয়া দেহ যা শনাক্ত করাও কঠিন ছিল৷
বীরভূমে এক পঞ্চায়েতের উপপ্রধান খুন হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় জনা দশেক মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে সোমবার গভীর রাতে৷ ঘটনার বর্বরতায় স্তম্ভিত বাংলা৷ রাজনৈতিক দলগুলির বাইরেও নানা স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ জানিয়েছেন৷ মিছিল হয়েছে৷ কিন্তু ঘটনার তাৎক্ষণিকতায় বিদ্বজ্জন ও সংস্কৃতি জগতের একাংশের নীরবতায় প্রশ্ন উঠেছে, ঘটনার সঙ্গে শাসক দলের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় কি তারা মুখ খুলছেন না?
সোশ্যাল মিডিয়ায় তথাকথিত সরকারপন্থি বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে যখন সমালোচনা চলছে, তখন সামনে আসে সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমনের মন্তব্য৷ একটি বাংলা নিউজ চ্যানেলের সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কোনো বিষয়ে তিনি কিছু বলবেন না৷ শুধু কাফি রাগ নিয়ে কথা বলতে পারেন৷ এ কথা বলার পরই তিনি ওই রাগে সরগম গেয়ে শোনান৷ তখনও রামপুরহাটের বগটুই গ্রামে পোড়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছিল৷
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, সেদিন প্রতিক্রিয়া দিতে চাননি কবি সুবোধ সরকার৷ জানিয়েছিলেন, তিনি কবিতা উৎসবে ব্যস্ত আছেন৷ অভিনয় জগতের একঝাঁক পরিচিত মুখ তৃণমূলের টিকিটে এখন জনপ্রতিনিধি৷ এর মধ্যে রয়েছেন সাংসদ দীপক অধিকারী ওরফে দেব, বিধায়ক জুন মালিয়া, কাঞ্চন মল্লিক, লাভলি মৈত্র প্রমুখ৷ তাদের কাছ থেকেও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি বলে একাধিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে৷
এই জাতীয় নীরবতার মধ্যে কবীর সুমনের কাফি রাগের মূর্ছনাকে অনেকে সম্রাট নিরোর আদর্শ প্রতিবিম্ব বলে মনে করেছেন৷ তীব্র প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন রাজ্যের বিরোধী বিজেপি, বাম ও কংগ্রেস নেতৃত্ব৷ একাধিক নেতার আক্রমণে শালীনতার মাত্রাও ছাড়িয়েছে৷
সংস্কৃতির ভাষ্যকার ও প্রাবন্ধিক-অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের আপত্তি রয়েছে বিদ্বজ্জন শব্দটিতে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলায় সার্বিক ভাবে মেধার অধঃপতন হয়েছে৷ তাই এঁদের কি বুদ্ধিজীবী আদৌ বলা যায়? এ ছাড়া গায়ক, নট-নায়িকারা আর যাই হোক, বিদ্বজ্জন নন৷” চিত্র পরিচালক অনীক দত্ত ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘পৃথিবীতে বাংলাই বোধহয় সেই জায়গা যেখানে বুদ্ধিজীবী শব্দটি নোংরা, প্রায় গালাগালির সমান৷’’
তবে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের অগ্রণী অংশের প্রতিনিধিরা অনেকেই রামপুরহাট গণহত্যা নিয়ে মুখ খুলেছেন৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন চিত্র পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, সঙ্গীত পরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র, নাট্যব্যক্তিত্ব দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, গায়িকা সাহানা বাজপেয়ী প্রমুখ৷ শুক্রবার কলকাতায় গণহত্যা বিরোধী মিছিলে অংশ নেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার, চিত্র পরিচালক অনীক দত্ত, মানবাধিকারকর্মী, অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র-সহ অন্যান্য বিশিষ্টজন৷
কিন্তু বিদ্বজ্জনদের একাংশ নীরব কেন? অম্বিকেশ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ব্রাত্য বসু, অর্পিতা ঘোষ, যোগেন চৌধুরী, শুভাপ্রসন্নরা সরকারি প্রসাদ পেয়েছেন৷ পদ, ভাতা, সম্মান পেয়েছেন৷ তাদের মুখ্যমন্ত্রী কিনে নিয়েছেন৷ ফলে যে ঘটনায় সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে, তার বিরুদ্ধে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের পরিবর্তনকামীরা মুখ খুলবেন না৷ কেউ গান শোনাবেন, কেউ অন্য অজুহাত দেবেন এড়িয়ে যাওয়ার জন্য৷’’
তীব্র সমালোচনার আবহে মুখ খুলেছেন রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান, চিত্রশিল্পী শুভাপ্রসন্ন৷ তার বক্তব্য, ‘‘রামপুরহাটের ঘটনার নিন্দা করা হয়েছে৷ তবে এটাকে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক নয়৷ সেগুলি ছিল রাষ্ট্রের নিপীড়ন৷ তার বিরুদ্ধে আমরা পথে নেমেছিলাম৷ এ ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ হিংসা হয়েছে, তার পরপরই রাজ্য সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে৷ গ্রেফতারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ আধিকারিকদের বিরুদ্ধেও তৎক্ষণাৎ পদক্ষেপ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী৷ বিরোধীরা এটাকে হাতিয়ার করতে চাইছে৷’’
এই যুক্তি খারিজ করে দিয়েছেন রামপুরহাট নিয়ে পথে নামা মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর নেতা সুজাত ভদ্র৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন না হোক, এটা রাষ্ট্রের মদতে সন্ত্রাস৷ শাসক দলের উপপ্রধান খুন হওয়ার পর বদলা হিসেবে এতগুলি মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে৷ পুলিশ নাকের ডগায় থাকা সত্ত্বেও চুপচাপ বসে থেকেছে যাতে উপপ্রধানের অনুগামীরা প্রতিশোধ নিতে পারে৷ আর তার থেকেও এটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ৷ হিংসার বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতে এত সময় লাগে কেন?’’
বিদ্বজ্জনদের এই ভূমিকার মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা কখনই তেমন সরকারের বিরুদ্ধে সরব নন৷ বাম আমলে আনন্দমার্গী হত্যা, মরিচঝাঁপির ঘটনার বিরুদ্ধে কতটা প্রতিবাদ হয়েছিল? ১৯৭১-এ কাশীপুর-বরানগর গণহত্যার প্রতিবাদে কি মিছিল হয়েছে? সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম ছিল একটি ব্যতিক্রমী প্রবণতা৷ এখন আবার সেই আগের ছবি দেখা যাচ্ছে৷ সরকারের কাছাকাছি থাকা বিশিষ্টজনেদের সেভাবে প্রতিবাদ করতে দেখা যাচ্ছে না৷’’
কেন প্রতিবাদে নীরব অথবা আন্তরিক নন সরকারঘনিষ্ঠ বিদ্বজ্জনেরা? শুভাপ্রসন্নের বক্তব্য, ‘‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হলে আমরা চুপ করে থাকব না৷ কিন্তু রামপুরহাটের ঘটনায় কেউ যদি বলেন আমাদের যেতে, আমরা তো রুদালি নই৷ কোনো ঘটনা ঘটলে রুদালির মতো চলে যাব কাঁদতে৷’’
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, "এটা কী ধরনের হত্যাকাণ্ড, তা অগ্রজপ্রতিম শুভাপ্রসন্ন বুঝতে পারেন এবং জানেনও। তাঁর সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে লাভ নেই। ভারতবর্ষ ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে তর্ক-বিতর্কে জড়িয়ে দেখেছে, লাভ হয় না।"