রহস্যের জালে মোড়া ‘মোসাদ'
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১০প্রেক্ষাপট
হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদির মৃত্যুর পর গোটা দুনিয়ার ইহুদি সম্প্রদায়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিজস্ব রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নের প্রকল্পে সামিল হয়েছিল৷ ইহুদি, খ্রীস্ট ও ইসলাম ধর্মের কাছে ‘পবিত্র ভূমি' বলে পরিচিত বৃহত্তর প্যালেস্টাইনকেই তারা বেছে নিয়েছিল নতুন এই বাসভূমির জন্য৷
এই ‘জায়নিস্ট' আন্দোলনেরই ফলশ্রুতি ইসরায়েল৷ প্রথমে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি, তারপর সম্মিলিত আরব শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তিকে ক্রমশঃ আরও শক্তিশালী করে তুলেছে ইসরায়েল৷ ইউরোপে ইহুদি নিধনযজ্ঞ বা ‘শোয়া'র দুঃস্বপ্ন ভুলতে পারে নি সেদেশের মানুষ৷ ফলে আরও একবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দূর করতে যে কোন পদক্ষেপ নিতে শুরু থেকেই প্রস্তুত ইহুদি এই রাষ্ট্র৷ কিন্তু নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করতে ইসরায়েল যে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করে এসেছে, তাকে ঘিরে বিতর্কের কোন শেষ নেই৷
পরিচয়
রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার ১৯ মাসের মাথায় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডাভিড বেন গুরিয়ন ‘মোসাদ' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ সেটা ছিল ১৯৪৯ সাল৷ তবে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার আগেই যেসব ইহুদি নিষিদ্ধ সংগঠন সংগ্রাম চালাচ্ছিল, তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে যে কাঠামো গড়ে উঠেছিল, তাকে ‘মোসাদ'এর পূর্বসূরি বলা চলে৷
হিব্রু ভাষায় ‘মোসাদ' শব্দের অর্থ ইন্সটিটিউট৷ আনুষ্ঠানিকভাবে এই বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার নাম ‘দ্য ইন্সিটিটিউট অফ ইনটেলিজেন্স অ্যান্ড স্পেশাল অপারেশনস'৷ উল্লেখ্য, ইসরায়েলে আরও দু'টি গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে – অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার নাম ‘শিন বেত' এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার নাম ‘আগাফ হা-মোদি'ইন' – সংক্ষেপে ‘আমন'৷
চরম গোপনীয়তার বেড়াজালে মোড়া ‘মোসাদ' সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়৷ এমনকি এই সংস্থার সদর দপ্তরেরও কোন ঠিকানা বা টেলিফোন নম্বর নেই৷ কর্মীসংখ্যাও কারো জানা নেই৷ ইসরায়েলের আইন অনুযায়ী শুধুমাত্র সংস্থার প্রধানের নাম প্রকাশ করা যায়৷ ‘মোসাদ'এর ওয়েবসাইটে সামান্য কিছু তথ্য ও যোগাযোগের জন্য ফর্ম রয়েছে৷ এমনকি ‘মোসাদ'এর হয়ে কাজ করতে চাইলে একটি ফর্মও রয়েছে৷ সরকারের জন্য কৌশলগত, রাজনৈতিক ও ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করার মত কাজের বাইরেও ‘মোসাদ'এর কাজের পরিধি বেশ বড়৷
‘মোসাদ'এর কাজ
অন্যান্য বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার তুলনায় ‘মোসাদ'এর দায়িত্ব বা কাজের পরিধির বেশ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়৷ সংস্থাটির স্বঘোষিত উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলের সীমানার বাইরে গোপনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা, শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলি যাতে বিশেষ ধরনের অস্ত্র তৈরি বা সংগ্রহ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা এবং দেশে-বিদেশে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর উপর হামলার ষড়যন্ত্র আগাম প্রতিরোধ করা৷ এছাড়া তালিকায় রয়েছে আরও কিছু উদ্দেশ্য৷ যেসব দেশে ইসরায়েলের অভিবাসন সংস্থা আইনত সক্রিয় হতে পারে না, সেই সব দেশ থেকে ইহুদিদের ইসরায়েলে নিয়ে আসার দায়িত্বও পালন করে ‘মোসাদ'৷ মনে রাখতে হবে, বিশ্বের যে কোন ইহুদি ব্যক্তির জন্য ইসরায়েলের দ্বার খোলা রয়েছে, যাতে তারা সেখানেই পাকাপাকি বসবাস করতে পারে৷ ইসরায়েলের সীমানার বাইরে বিশেষ অভিযানের পরিকল্পনা ও কার্যকর করার বিশেষ দায়িত্বও পালন করে ‘মোসাদ'৷
শেষোক্ত এই কাজের কারণেই ‘মোসাদ'এর উপস্থিতি বার বার টের পাওয়া যায়৷ দুবাইয়ে সম্প্রতি এক হামাস নেতার হত্যার পেছনে ‘মোসাদ' জড়িত বলে সেদেশের প্রশাসন প্রায় নিশ্চিত৷ অতীতেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এমন অনেক রহস্যজনক হত্যাকাণ্ড বা অপহরণের ঘটনায় ‘মোসাদ'এর এজেন্টদের হাত হয় স্পষ্টভাবে টের পাওয়া গেছে কিংবা আঁচ পাওয়া গেছে৷ রাষ্ট্রের আদর্শে অনুপ্রাণিত এই সব এজেন্টরা যে উচ্চ মাত্রার পেশাদারীত্ব ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে থাকেন, তা অনেকেরই আতঙ্ক, সমীহ ও কিছু ক্ষেত্রে ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ এমনকি অনেক দেশের গোয়েন্দা সংস্থা বিভিন্ন ভাবে ‘মোসাদ'কে অনুকরণ করারও চেষ্টা করে থাকে৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন, সম্পাদনা: রিয়াজুল ইসলাম